২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

দেশে সেকুলার-ধর্মপন্থী বিরোধ

দেশে সেকুলার-ধর্মপন্থী বিরোধ - ছবি : সংগৃহীত

বাংলাদেশের মানুষ স্পষ্টতই দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। এই প্রবণতা কয়েক দশক ধরেই একটু একটু করে দৃশ্যমান হচ্ছিল। সেই ধারাবাহিকতায় সাম্প্রতিক সময়ে তিক্ততা মাত্রাছাড়া পর্যায়ে চলে গেছে। বিভক্তি এখন চূড়ান্তরূপে দৃশ্যমান। বছর বিশেকের মধ্যে পরিণতির দিকে গেলে আশ্চর্য হওয়ার কিছু থাকবে না। বরং বলা যায়, দ্রুত সে দিকেই ধাবিত। আমাদের সহনশীল ঐতিহ্যবাহী সমাজব্যবস্থা হিংসা-বিদ্বেষে ক্ষতবিক্ষত। অথচ গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে গড়ে ওঠা বহুধাবিভক্ত সমাজেও ভিন্ন মতের প্রতি শ্রদ্ধা এবং সহনশীলতা থাকলে এমন হওয়ার কথা নয়। নানা মতের সহাবস্থানে সমাজ তখন হয়ে ওঠে বৈচিত্র্যময়। দুর্ভাগ্য আমাদের, অন্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ তলানিতে গিয়ে ঠেকায় দিন দিন সবাই যেন চরমপন্থার দিকে ঝুঁকে পড়ছে। ফলে সমাজে চরমপন্থীদেরই জয়জয়কার।

লক্ষণীয়, হোক সে নিচুতলার নতুবা উঁচুতলার; সবাই অর্থের কাঙাল। সম্পদ কব্জা করাই একমাত্র আরাধনার বিষয়। সমাজে সম্পদশালীদের কদর আকাশছোঁয়া। তাদের সবাই খাতির করে। কখনো কুর্নিশ করতেও সঙ্কোচহীন। কে কাকে ল্যাং মেরে সামনে এগুবে, প্রাণান্তকর সেই চেষ্টা। এ নিয়ে যত ঝগড়া-ফ্যাসাদ। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সীমিত থাকায় জনমানসের অর্থলিপ্সার বাসনা ছিল সুপ্ত। কিন্তু দুরবস্থা কাটিয়ে দেশে পুঁজির প্রবাহ বাড়তে থাকলে স্বার্থপরতা বাসা বাঁধে। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে, ন্যায্য অধিকার নয়; এখন একটু বাড়তিই চাইছি আমরা। এই চাওয়ায় এগিয়ে সেকুলাররা। তারা ষোলো নয়; আঠারো আনা চায়। দুই আনা অন্য, মানে ধর্মপন্থী সুনির্দিষ্ট করে বললে বলতে হয়; ইসলামপন্থীদের অধিকারবঞ্চিত করে, ঠকিয়ে আদায় করতে মরিয়া। অবশ্য, ধর্মপন্থীদের বঞ্চনার ইতিহাসের শুরু পরাধীন বাংলায় ইংরেজ আমলে। স্বাধীন বাংলাদেশের পঞ্চাশ বছরেও তাদের বঞ্চনায় ইতি টানতে পারেনি রাষ্ট্র। এখানেই গোল বেঁধেছে। একসময়ের অধিকারহারা ধর্মপন্থীরা ঠকতে ঠকতে নিজেদের পাওনা কড়ায় গণ্ডায় বুঝে পেতে চায়। প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে তারাও প্রান্তসীমায়; ‘কেহ কারে নাহি জিনে সমানে সমান’। ফলে সমাজে জন্ম নিয়েছে মাত্রাতিরিক্ত অধিকারবোধ। রাষ্ট্রকাঠামোও যে প্রবণতার লাগাম টানতে পারছে না। পরিণতিতে বর্তমান সময় হয়ে উঠেছে অস্থির। অস্থিরতার গর্ভে অনিবার্যভাবে জন্ম নিচ্ছে দ্বন্দ্ব-সঙ্ঘাত। সময়ে সময়ে সঙ্ঘাত তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে।

সেকুলার এবং ধর্মপন্থীদের এই সঙ্ঘাতের বেশ কিছু কারণ রয়েছে। বর্তমান সমাজ বাস্তবতায় সেসব চিহ্ন স্পষ্ট। প্রথমেই সেকুলারদের বৈশিষ্ট্য নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে। কারণ, এখনো আমাদের দেশে তারাই শক্তি-সামর্থ্যে এগিয়ে। বলে রাখা ভালো, সেকুলার বলতে সমাজে এগিয়ে থাকা দেশের শহুরে সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণী এবং উচ্চবিত্তের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা মানুষকে বুঝতে হবে। জানা প্রয়োজন, দেশে ধর্মনিরপেক্ষতার ধ্বজাধারী সেকুলারদের কাক্সিক্ষত পরম চাওয়া কী। এ দেশে সেকুলারদের একান্ত চাওয়ার প্রথমটি হচ্ছে- তার সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে রাষ্ট্র। সামাজিক নিরাপত্তা সেকুলার ধর্মপন্থী নির্বিশেষে সবারই চাওয়া। এ ক্ষেত্রে সেকুলারদের চাওয়ার ভিন্নতা হলো- সামাজিক নিরাপত্তার নামে তার যাপিত জীবন নিয়ে কোনো প্রশ্ন তোলা যাবে না। সে কিভাবে বিত্তের মালিক হলো; এ নিয়ে কারো কোনো কথা চলবে না। ব্যক্তি স্বাধীনতার দোহাই দিয়ে অর্জিত অর্থ কীভাবে ব্যয় করবে; তা নিয়েও কেউ টুঁশব্দ করতে পারবে না। চাই তা নৈতিকতার মানদণ্ডে উত্তীর্ণ হোক বা না হোক। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, এই যেমন সে পানশালায় যাবে, জীবনসঙ্গিনী নিয়ে পশ্চিমা কেতায় সংক্ষিপ্ত পোশাকে পাবলিক প্লেসে ঘুরে বেড়াবে, শীলিত-অশীলিত কি না তা নিয়ে কোনো বাতচিত শোরগোল করা যাবে না। তাদের মতে, এটিকে দেখতে হবে শুধুই আইনি কাঠামোর ভেতর। এখানে ধর্মীয় বিধিবিধানের বাদ সাধা বারণ। দ্বিতীয় যে বিষয়টির নিশ্চয়তা সে চায়, তার আয়ের পথে নৈতিকতার বিধিনিষেধের বেড়াজাল তুলে উপার্জনের পথ রুদ্ধ করা যাবে না। আয়ের ক্ষেত্রে ধর্মীয় অনুশাসন, মানে ইসলামী বিধিবিধান মানতে নারাজ তারা।

বাংলাদেশে সেকুলারদের বড় সঙ্কট; তারা নিজেদের অধিকার দেশের সংবিধানের আলোকে শতভাগ সংরক্ষণ করতে যতটা না মরিয়া; ধর্মপন্থীদের বেলায় সেই অধিকার রক্ষায় ততটাই অনীহা। কোনো ইসলামপন্থী বউ-বাচ্চা নিয়ে বিনোদনকেন্দ্রে বেড়াতে গেলে তার সেকুলারদের বিদ্রƒপের শিকার হওয়ার শঙ্কা উড়িয়ে দেয়া যায় না। এ ক্ষেত্রে সেকুলারদের চিন্তা কাঠামোটি বড় অদ্ভুত। যেন ধার্মিকদের জীবনে বিনোদন থাকতে নেই। হোক তা বৈধ। তারা শুধু অপার্থিব কাজে জীবন ব্যয় করবে। পার্থিব সব বিষয়-আশয় শুধুই সেকুলারদের অধিকারভুক্ত। একচেটিয়া ব্যাপার।

সাম্প্রতিক কিছু ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে মনে হওয়া অসঙ্গত নয়, ইসলামপন্থীদের আবার কিসের ব্যক্তি ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা! ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফর নিয়ে যে তুলকালাম কাণ্ড হয়ে গেল, অনেক প্রাণ ঝরল- সেই বিষয়ে দেশের মূলধারার প্রায় সব গণমাধ্যমের একপেশে বয়ান আমরা দেখলাম। দু-একটি ব্যতিক্রম ছাড়া দেশের সব গণমাধ্যমই সেকুলারদের প্রতিনিধিত্ব করে। গণমাধ্যমের ভাবখানা এই, এসব মৃত্যু নিয়ে চিৎকার-চেঁচামেচির কী আছে! এখানে সঙ্গত ও অসঙ্গতের প্রশ্ন তোলা অবান্তর। যদিও বাংলাদেশ রাষ্ট্রের নিজস্ব আইনি বাধ্যবাধকতা হলো সব অস্বাভাবিক মৃত্যুরই নিরপেক্ষ তদন্ত হতে হবে। কিন্তু মুশকিলটা হলো, আমাদের দেশে আইনের শাসন অনুসারে সবসময় সব কিছু হয় না। সেকুলারদের সম্পর্কে শেষ কথা হলো তারা এ দেশে ইসলামের কোনো উপযোগিতা খুঁজে পায় না। কৌতূহলোদ্দীপক হলো- তারা নিজের সম্পর্কে মূল্যায়ন করতেও জানে না। নিজেদের ভোগের জন্য যে ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখতে চায়; সেটি আসলে পাশ্চাত্যের সেকুলারিজম নয়। না হলে পশ্চিমা দুনিয়ায় সবপক্ষের সাথে বোঝাপড়ায় গড়ে ওঠা সমাজে যেখানে সর্বজনীন স্বীকৃত অধিকার সবার বেলায় সমভাবে প্রযোজ্য; রাষ্ট্র তা অক্ষরে অক্ষরে পালনও করে থাকে। সেখানে আমাদের এখানে সেটি কল্পনাবিলাস মাত্র। দরিদ্র ইসলামপন্থীদের অধিকার সংরক্ষণের কোনো দায়বোধ সেকুলারদের চিন্তা-চেতনায় স্থান পায় না। যেহেতু রাষ্ট্র পরিচালনায় তাদের একচ্ছত্র প্রবেশাধিকার, তাই রাষ্ট্রও তা পালনে গরজ বোধ করে না।

এ তো গেল সেকুলারদের সাতকাহন। অপরপক্ষে ধর্মপন্থী মানে ইসলামপন্থীরা নিজেদের বঞ্চনার অবসানে মরিয়া। আমরা ধর্মপন্থী হিসেবে যাদের কথা বলছি, তারা মাদরাসা শিক্ষিত। এত দিন তারা শুধু ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে স্বল্প আয়ে সন্তুষ্ট ছিল। সেই তারা অধিকার রক্ষায় ক্ষেত্রবিশেষে সেকুলারদের চেয়ে একধাপ এগিয়ে। দুর্দান্ত সাহসী। তারা বুঝে গেছে, রাষ্ট্র ক্ষমতায় ভাগ বসাতে না পারলে পাওনা আদায় হবে না। সে জন্যই দেখা যায়, অধিকার প্রতিষ্ঠায় রাজনীতির চর্চায় তারা অগ্রসেনানী। ইদানীং তো ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতিতে তারা বেশ পারঙ্গম। এই প্রবণতা স্পষ্ট হওয়ায় সেকুলাররা ভীতসন্ত্রস্ত। ধর্মপন্থীদের মোকাবেলায় সব রকমের কৌশল, কূটকৌশল প্রয়োগে দ্বিধাহীন। তবে এ কথা অস্বীকার করার কোনো উপায় আছে বলে মনে হয় না যে, ধার্মিকরা ধর্মের মূল চেতনায় যত না মনোযোগী, এর চেয়ে বেশি আনুষ্ঠানিকতায় নিষ্ঠাবান।

ফলে ধর্মের সর্বজনীন মানবতাবাদী রূপ তাদের জীবনে সেভাবে উপস্থিত নেই। অথচ আমাদের এ সত্য কবুল না করে উপায় নেই যে, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের রক্ষাকবচ ইসলাম। এটিই হচ্ছে এখনকার বাস্তবতা। তা না হলে আলাদা স্বাতন্ত্র্য নিয়ে এ ভূখণ্ডের অধিবাসীদের টিকে থাকা কঠিন বৈকি। কিন্তু এ জন্য ইসলামপন্থীদের যতটুকু ঐশী জ্ঞান থাকা অত্যাবশ্যক, তাদের আচরণ দেখলে সে বিষয়ে হতাশ হতে হয়। ফলে ইসলাম তাদের কাছে শুধু ক্ষমতায়িত হওয়ার বাহন হয়ে হাজির মাত্র। এতে করে তাদের বিরোধীপক্ষের অভিযোগ ধর্ম ব্যবসায়ীর তকমা জনসমাজে হালে কিছুটা হলেও পানি পেয়েছে। এসব দেখে অনেকে বলতে চান, বাংলাদেশে সেকুলার এবং ইসলামপন্থীদের মধ্যে দ্বন্দ্ব-সঙ্ঘাতের মূলে রয়েছে পার্থিব ভোগ নিশ্চিতে ক্ষমতাকেন্দ্রিক ভাগবাটোয়ারার লড়াই। একপক্ষ ধর্মনিরপেক্ষতার ধ্বজাধারী। অপরপক্ষ ধর্মের আবরণে ক্ষমতার স্বাদ পেতে উদ্গ্রীব।

camirhamza@yahoo.com


আরো সংবাদ



premium cement