২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

অর্থনীতির রহস্য ধরিয়ে দেয়ার শিক্ষক

তুরস্কের প্রেসিডেন্ট আব্দুল্লাহ গুলের সাথে একান্ত আলোচনায় প্রফেসর ড. এম এ মান্নান - ফাইল ছবি

কাল ছিল নয়া দিগন্তে আমার এই শিক্ষকের নির্ধারিত কলাম প্রকাশের দিন। এটি প্রকাশের আগেই তিনি চলে গেলেন। এই শিক্ষক হলেন প্রফেসর ড. এম এ মান্নান। কত বড় মাপের মানুষ তিনি ছিলেন যারা তার সান্নিধ্যে যাননি অথবা তার লেখা বই পড়েননি বা বক্তৃতা শুনেননি তারা উপলব্ধি করতে পারবেন না। সংবাদপত্রে সাড়ে তিন দশকের বেশি সময় যুক্ত থাকার সুবাদে দেশী বিদেশী অনেক বিখ্যাত ব্যক্তির কাছে যাওয়ার ও কথা শোনার সুযোগ ঘটেছে। প্রফেসর সৈয়দ আলী আহসান অথবা প্রফেসর এম এ বারীর মতো মানুষের বক্তব্য শোনার সময় এতটা মন্ত্রমুগ্ধের হয়ে পড়তাম যে রিপোর্টারের নোট নেয়ার কলম আর যেন চলত না। আমরা ড. অমর্ত্য সেনের ভাষণ শুনে তার কথার রহস্য ভেদ করার চেষ্টা করেছি। অথবা প্রফেসর ইউনূসের সাদামাটা কথার গভীরে যে অসাধারণ স্বপ্ন পূরণের ইঙ্গিত সুপ্ত থাকে তা ধরার চেষ্টা করেছি। কিন্তু প্রফেসর এম এ মান্নান ছিলেন একেবারে অন্য রকম একজন মানুষ। তিনি আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন না। ছিলেন মানুষ ও মানুষের জীবন বুঝবার অনন্য প্রেরণা। অর্থনীতির অন্তর্নিহিত গভীর রহস্য তিনি গল্পের মাধ্যমে, সহজ উদাহরণ দিয়ে ধরিয়ে দিতেন।

আশির দশকের শেষার্ধে প্রফেসর মান্নান ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংকের আকর্ষণীয় মুখ্য অর্থনীতিবিদের চাকরি ছেড়ে দেশে ফিরে এসে তার তত্ত্ব বা ধারণার বাস্তব প্রয়োগ করার জন্য সোশ্যাল ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক (পরে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক) প্রতিষ্ঠা করেন। এ সময় ব্যাংকটি প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করলে তার সাথে প্রথম দেখা হয়। এই অনুষ্ঠানে তিনি নিজের লেখা কিছু ইংরেজি বই সামনে রেখেছিলেন। সোশ্যাল ইনভেস্টমেন্ট এবং আল আরাফাহ এই দুটি ইসলামী ব্যাংক এক সাথে যাত্রা শুরু করে। প্রথমটির কাণ্ডারি ছিলেন প্রফেসর মান্নান আর দ্বিতীয়টির মূল উদ্যোক্তা ছিলেন প্রখ্যাত সিএসপি কর্মকর্তা এ জেড এম শামসুল আলম। প্রথমটি ছিল ইসলামী অর্থনীতির বৈশ্বিক ধারণার সর্বসাম্প্রতিক ভাবনা সামনে রেখে দরদি সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন, অন্যটি ছিল দেশের ধর্মপ্রাণ মানুষদের সুদমুক্ত একটি ব্যাংকিং ব্যবস্থা উপহার দিয়ে সুন্নাহভিত্তিক জীবন যাপনে সহায়তা করার উদ্যোগ। দুটি উদ্যোগই ছিল অনন্য।

একজন তরুণ রিপোর্টার হিসেবে সে দিন প্রফেসর মান্নানের কথা শুনে আমার তাকে সমাজ বদলানোর এক স্বপ্নচারী ব্যক্তিত্ব মনে হয়েছিল। তিনি নিজে একজন সামাজিক ঋণখেলাপি হিসেবে এই ঋণ শোধ করার জন্য দেশে ফিরে আসার কথা বলতেন। তিনি বলতেন, ‘জীবনের একবারে প্রারম্ভ থেকে শুরু এই ঋণ নেয়া। অগণিত গরিব ও মেহনতি মানুষের পয়সায় দেয়া ব্যাপক ভর্তুকির শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রাইমারি স্কুল থেকে পিএইচডি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছি। সেই ঋণ শোধ করতে দেশে ফিরে এসেছি।’ এ কারণে বাংলাদেশে প্রফেসর মান্নানের সব কর্মকাণ্ড ছিল আর্থ-সামাজিক বৈষম্য ও খেটে খাওয়া মানুষের দুরবস্থা দূর করার জন্য।

দৈনিক ইনকিলাব সম্পাদক এ এম এম বাহাউদ্দিনের সাথে স্যারের ছিল হৃদ্যতাপূরর্ণ সম্পর্ক। বাহাউদ্দিন ভাই আমাকে কোনো এক বিষয়ে রিপোর্ট করার জন্য মান্নান স্যারের কাছে যেতে বলেন। আমি চিফ রিপোর্টার মঞ্জু ভাইয়ের সাথে বারিধারায় ড. মান্নানের বাসা ‘মেঘমল্লার’ এ যাই। লতানো ফুলে সজ্জিত তিন তলা বাড়িটির নিচে ছিল সোনালী ব্যাংক। দু’তলা ও তিন তলায় স্যার থাকতেন। বাসাটি ছিল অত্যন্ত সুবিন্যস্ত। দেয়ালে পিতল, তেল ও জলরঙে আঁকা নানা শিল্পকর্ম। স্যারের মিসেস নার্গিস মান্নান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির ছাত্রী হলেও শিল্পকর্মে ছিলেন পারদর্শী।

স্যারকে একান্ত পরিবেশে প্রথম দেখায় আমি তার বিরল ব্যক্তিত্ব ও ব্যবহারে মুগ্ধ হই। বাবা মা আমাকে যে ‘মাসুম’ নামে ডাকতেন সে নাম স্যারের মুখে যখন শুনতাম তখন কেন জানি আমার কেবল আব্বার কথা মনে পড়ত। ৮০’র দশকের শেষে স্যারের সাথে যে যোগাযোগ তা এর পরের ৩০ বছরের বেশি সময় ধরে অব্যাহত ছিল। অবশ্য স্যার যে স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য বাংলাদেশে ফিরে এসেছিলেন সেটি বারবার ব্যাহত হয়েছে। যে ব্যাংকটিকে তিনি ত্রিমুখী মডেলে দরদি সমাজ গঠনের হাতিয়ার হিসেবে বাংলাদেশে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন সেটিও থমকে দাঁড়ায়। একজন বিশ্বমানের তত্ত্ব¡ ও প্রায়োগিক অর্থনীতিবিদের হাত থেকে ব্যাংকটির নিয়ন্ত্রণ চলে যায় টিপিক্যাল একজন ব্যবসায়ীর হাতে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তখনকার শীর্ষ ব্যক্তির আয়োজনেই এই কাজটি সম্পন্ন হয়।

একটি ব্যাংকে নিজে নীতিনির্ধারক হিসেবে থেকে ব্যাংকিং ব্যবসার পাশাপাশি দরদি সমাজ গঠনে প্রতিষ্ঠানটিকে হাতিয়ারে রূপান্তর করার তার প্রচেষ্টা থমকে গেলেও প্রফেসর মান্নান তার মিশন থেকে নিবৃত্ত হননি। তিনি মুসলিম বিশ্বের সমাজ পরিবর্তনে যে কয়েকটি ধারণা তত্ত্বগতভাবে দিয়েছিলেন সেসব বাস্তবায়নের জন্য তার ডাক পড়ে মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে। তিনি কখনো সৌদি আরব, কখনো ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, মিসর বা বাহরাইন, আবার কখনো ওআইসি বা ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংকের ফোরামে নতুন নতুন ধারণা ও তার বাস্তবায়ন কৌশল উপস্থাপন করেন। নিজ দেশে মন্ত্রী বা গভর্নর হওয়ার প্রস্তাবও তিনি পেয়েছিলেন। কিন্তু এসব ফিরিয়ে দিয়ে তিনি সমাজ উন্নয়নের একটি মডেল তৈরি করতে চেয়েছিলেন।

ইসলামের খেলাফত যুগে ওয়াকফ ব্যবস্থা ছিল ধর্মীয় শিক্ষা ও জনকল্যাণমুখী প্রতিষ্ঠান গঠন ও বিস্তারের প্রধান অবলম্বন। সর্বশেষ তুরস্কের ওসমানীয় খেলাফতের সময়ও দেশটির স্থাবর সম্পদের বড় একটি অংশ ছিল ওয়াকফ সম্পত্তি। এই উপমহাদেশেও ধর্ম প্রচার ও শিক্ষা বিস্তারে ওয়াকফ ব্যবস্থার অনন্য ভূমিকা ছিল। সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক সঙ্গতি কমে আসা এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধিতে স্থাবর সম্পত্তির অপ্রতুলতা সৃষ্টি হতে থাকলে ওয়াকফ ব্যবস্থা আগের মতো সমাজ কল্যাণে ভূমিকা রাখতে পারেনি। এই অবস্থায় প্রফেসর মান্নান ক্যাশ ওয়াকফের ধারণা উপস্থাপন করেন। বিভিন্ন ব্যাংক ও প্রতিষ্ঠানের ক্যাশ ওয়াকফ সার্টিফিকেটের মাধ্যমে ওয়াকফের ছোট বড় তহবিল একসাথে হয়ে একটি বিশাল পুঁজি তৈরি হয়। এই দাতব্য তহবিল স্থাবর সম্পত্তির মতোই স্থির অর্থসম্পদ সৃষ্টিকারীতে রূপান্তর হয় যার মুনাফা দিয়ে ধর্মীয় ও সমাজ কল্যাণের কাজ নির্বাহ করা যায়। যেকোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান এই অফেরতযোগ্য ওয়াকফ তহবিলকে কল্যাণমুখী কাজে ব্যবহারের পাশাপাশি স্থির আমানত হিসেবে পেতে পারে। ড. মান্নান সোশ্যাল ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকে প্রথম ক্যাশ ওয়াকফ সার্টিফিকেট চালু করেন যা পরে অন্য কয়েকটি মুসলিম দেশে চালু হয়।

ড. মান্নানের দ্বিতীয় একটি উদ্যোগ ছিল বাংলাদেশসহ মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে থাকা ওয়াকফ সম্পত্তির অর্থনৈতিক উন্নয়নের মাধ্যমে এর সর্বোচ্চ প্রোডাকটিভিটি নিশ্চিত করা, যা থেকে লভ্য অর্থ কল্যাণমূলক কাজে ব্যবহার করা যেতে পারে। এতে অনেকটা অকার্যকরভাবে পড়ে থাকা কোনো ওয়াকফ সম্পত্তির প্রাপ্ত আয় দিয়ে আগে একটি প্রতিষ্ঠান চালানো গেলে সেটি উন্নয়নের মাধ্যমে প্রাপ্ত অর্থ দিয়ে তিনটি প্রতিষ্ঠান চালানো সম্ভব হয়।

ওয়াকফ সম্পদের উন্নয়ন এবং ক্যাশ ওয়াকফ ব্যবস্থা শুধু মুসলিম রাষ্ট্রের সামাজিক উন্নয়ন নিশ্চিত করতে পারে তাই নয়, একই সাথে এটি অন্যান্য ধর্মীয় দেবোত্তর বা গির্জার সম্পদের উন্নয়নের মাধ্যমে নিজ নিজ সম্প্রদায়ের সামাজিক উন্নয়নে কাজে লাগানো যায়। ধর্মকে মানুষের আত্মিক উন্নয়নের পাশাপাশি অর্থনৈতিক কল্যাণ ও স্বনির্ভরতার সাথে সংযুক্ত করার বিষয়টি প্রফেসর মান্নানের এক অনন্য ধারণা।

প্রফেসর মান্নান বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ব্যাপারেও কিছু মৌলিক ধারণার কথা বিভিন্ন সময় ব্যক্ত করেন। বাংলাদেশে গতানুগতিক ব্যবস্থায় রাজস্ব আহরণে বড় কোনো প্রবৃদ্ধি ঘটানোর অবস্থা এখন দেখা যায় না। এই অবস্থায় একটি তাৎপর্যপূর্ণ সংস্কারের কথা জানান ড. মান্নান। তার প্রস্তাব হলো, কর আদায় ব্যবস্থায় সংস্কার এনে বিভিন্ন কল্যাণমুখী প্রতিষ্ঠান পরিচালনার সাথে বড় বড় করদাতাদের প্রদেয় করের একটি সংযোগ ঘটানো গেলে অল্প সময়ের মধ্যে রাজস্ব দ্বিগুণ করা সম্ভব। যেমন ধরে নেয়া যায়, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল পরিচালনায় সরকারের এক হাজার কোটি টাকার বাজেট রয়েছে।

পাঁচটি করপোরেট প্রতিষ্ঠান যাদের ৬০০ কোটি টাকা কর আসে তাদের যদি বলা হয়, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল পরিচালনার পুরো অর্থ প্রদান করতে হবে যা সরকারকে দেয়া কর হিসেবে গণ্য করা হবে আর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল পরিচালনা ব্যবস্থার সাথে তাদের যুক্ত করা হবে। এভাবে করের সাথে সামাজিক উন্নয়নের যোগসূত্র তৈরি করা গেলে রাজস্ব দেয়াকে দায় মনে না করে করদাতারা সমাজের জন্য অবদান মনে করবে এবং তারা উৎসাহের সাথে বাড়তি কর দেবে।

প্রফেসর মান্নানের জীবন ছিল বৈচিত্র্যপূর্ণ ও বর্ণাঢ্য। সরকারি কলেজে শিক্ষকতা দিয়ে কর্মজীবন শুরু করেন। এরপর সিভিল সার্ভিসে যোগ দিয়ে জনপ্রশাসনে দায়িত্ব পালন করেন। পরে যোগ দেন পাকিস্তান পরিকল্পনা কমিশনে কর্মকর্তা হিসেবে। পাকিস্তানের প্ল্যানিং কমিশনের কাজ নিয়ে বই লিখে তিনি শীর্ষ কর্মকর্তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। উচ্চতর গবেষণার বৃত্তি নিয়ে যান যুক্তরাষ্ট্রে। এ সময় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে রাষ্ট্রহীন হয়ে পড়েন তিনি এবং পিএইচডির ফান্ডিং বন্ধ হয়ে যায়। এই কঠিন অবস্থায় জীবন সংগ্রাম করেও আমেরিকার খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয় মিশিগান স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে তিনি মাস্টার্স ও পিএইডি ডিগ্রি নেন।

অস্ট্রেলিয়া, বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থ, ব্যাংকিং, অর্থনৈতিক পরিকল্পনা, নাগরিক প্রশাসন, শিক্ষা এবং গবেষণার বিষয়ে তার প্রায় ৫০ বছরের কাজ ও শিক্ষাদানের অভিজ্ঞতা রয়েছে। তিনি জেদ্দায় ইসলামিক উন্নয়ন ব্যাংকে (আইডিবি) প্রধান অর্থনীতিবিদ, সৌদি আরবের কিং আবদুল আজিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি ও ইসলামী অর্থ বিভাগের অধ্যাপক, পাপুয়া নিউগিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যবসায় স্টাডিজ অনুষদের ডিন; ম্যানিলায় এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) আর্থিক ও আর্থিক অর্থনীতি বিষয়ের পরামর্শদাতা, আমেরিকার জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয় ও লন্ডনের মুসলিম ইনস্টিটিউটে ভিজিটিং অধ্যাপক; ইসলামাবাদে পাকিস্তান সরকারের সহকারী আর্থিক উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

অবসরের বয়সে প্রফেসর মান্নানের কাজ আরো বেড়ে যায়। তিনি ছিলেন হাউজ অব মান্নান চ্যারিটেবল ট্রাস্টের (এইচএমসিটি) প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান। সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেডের (এসআইবিএল) প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ছাড়াও সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক ট্রাস্ট (এসআইবিটি) এবং বাংলাদেশ সামাজিক শান্তি ফাউন্ডেশনের (বিএসপিএফ) চেয়ারম্যান।

ডা. মান্নান অর্থনীতি, ইসলামিক ফিন্যান্স এবং ব্যাংকিংয়ের ওপর এক ডজনের বেশি বই লিখেছেন যেগুলো ইংরেজিতে বিভিন্ন দেশ থেকে প্রকাশ হয়েছে। বিভিন্ন ভাষায় এগুলো অনূদিত হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে রেফারেন্স বই হিসেবে পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। ‘ইসলামিক অর্থনীতি : তত্ত্ব ও প্রয়োগ’ এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য, যেটি এক ডজন বিদেশী ভাষায় অনুবাদ হয়েছে। ড. মান্নানকে তার অবদানের জন্য বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় ছয়জন সমসাময়িক সেরা ইসলামী অর্থনীতিবিদের তালিকার শীর্ষে স্থান দেয়া হয়।

প্রফেসর মান্নান যে স্বপ্ন দেখেছিলেন সেটি বাস্তবায়নের জন্য হয়তো আরো সময়ের প্রয়োজন ছিল। তিনি অনেকগুলো স্বপ্নের বীজ বপন করে গেছেন। বিদেশে অতি উচ্চ বেতনের চাকরি ও পেশাগত কনসালট্যান্সি থেকে যে অর্থকড়ি ও সম্পদ অর্জন করেছেন তার প্রায় পুরোটা তিনি মানবতার কল্যাণে গঠিত ট্রাস্টে দান করে গেছেন। সিরাজগঞ্জের বিরাট এলাকার ভূসম্পদ ছাড়াও বারিধারায় ১১ তলার সুউচ্চ ভবন আর লন্ডনের বাড়ির আয় ট্রাস্টের দাতব্য কর্মকাণ্ডে দান করে গেছেন। এর অর্থ দিয়ে তার প্রতিষ্ঠিত হাসপাতাল ও বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালিত হচ্ছে।

প্রফেসর মান্নান জীবনের শেষ দিকে নানা ধরনের শারীরিক সমস্যার পরও চাইতেন তার বাসায় গিয়ে বিভিন্ন ধারণা নিয়ে আমরা আলোচনা করি। এক সময় এক দুই সপ্তাহ পরপরই দেখা হতো। বিভিন্ন ইস্যুতে তার দীর্ঘ সাক্ষাৎকার নিয়েছি। এক সময় স্যারের বর্ণাঢ্য জীবনের গল্প, বিরল অভিজ্ঞতা এবং তার উন্নয়নের ধারণাগুলো নিয়ে আসার জন্য নয়া দিগন্তে নিয়মিত কলাম লেখার প্রস্তাব দিই। স্যার রাজি হন তবে শারীরিক সমস্যার কারণে একটু সময় নেন। নিজ হাতে খুব বেশি সময় তিনি লিখতে পারেন না বলে আমার সাবেক সহকর্মী মাসুম বিল্লাহকে অনুরোধ করি স্যারের অনুলিখন নেয়ার জন্য। মাসুম বিল্লাহ প্রতি সপ্তাহে এক বা দু’দিন গিয়ে এই কাজটি অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে করেন। স্যারের প্রতিটা কলামে থাকত বিরল সব অভিজ্ঞতা ও বিশ্বখ্যাত ব্যক্তিত্বের কথা। শেষের কয়েকটি কলামে তিনি নাইজেরিয়ার প্রেসিডেন্ট বুহারি, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জিয়াউল হক, সৌদি আরবের শেখ আহমদ সালাহ জামজুম, আবদুল্লাহ ওমর নাসিফের স্মৃতি নিয়ে লিখেছেন। বুহারির স্মৃতিতে জানা যায়, বিশ্বে অন্যতম বৃহৎ মুসলিম রাষ্ট্র নাইজেরিয়া ওআইসির সদস্য হয়েছিল ড. মান্নানের পরামর্শে। তিনি এ ধরনের আরো অনেক ঘটনার কথা তুলে আনার পরিকল্পনা করেছিলেন পরের কলামগুলোতে। যে কলামটি তিনি শেষ করতে পারেননি সেখানে তিনজন নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদের স্মৃতিচারণ করেছিলেন যাদের প্রত্যেককে এক লাখ ডলার করে সম্মানী দিয়ে আইডিবি তাদের ব্যাংকে নিয়ে গিয়েছিল বক্তৃতা দেয়ার জন্য। তাদের কাছ থেকে অর্থনীতির জটিল বিষয়গুলোকে কিভাবে সহজ করে তুলে ধরতে হয় তা জেনেছিলেন বলে উল্লেখ করেন তিনি। কিন্তু এ লেখা শেষ করার আগেই মৃত্যুর ফেরেশতা স্যারকে পরম করুণাময়ের কাছে নিয়ে গেছেন।

সমাজের প্রতি প্রফেসর মান্নানের যে দায়বোধ সেটি অনন্য। তিনি বিশ্বাস করতেন, দুনিয়ায় যে স্বল্প সময়ের জন্য সর্বশক্তিমান আমাদের প্রেরণ করেছেন তা হলো অন্যের প্রতি দায়িত্ব পালন করে পরীক্ষায় নিজেকে উত্তীর্ণ করার জন্য। আট দশকের জীবনের শিশুকালটুকু ছাড়া পুরোটাই তিনি এই দায়িত্ব পালন করে গেছেন। মহান রাব্বুল আলামিন প্রফেসর মান্নানের মানবতার প্রতি এই অবদান কবুল করুন। কোনো ভুলত্রুটি হয়ে থাকলে তাকে ক্ষমা করে জান্নাতুল ফেরদাউস নসিব করুন। আমীন

mrkmmb@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement