মিয়ানমারের রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠী। বিশ্বসমাজে আজ ওরা নানা নামে পরিচিত : চিলড্রেন অব নো ল্যান্ড, দ্য মোস্ট পারসিকিউটেড পিপল অব দ্য টুয়েন্টিফার্স্ট সেঞ্চুরি কিংবা বিশ্বের সবচেয়ে নিগৃহীত ও নিজ জন্মভূমি থেকে বিতাড়িত এক জাতিগোষ্ঠী। তারা মিয়ানমার সরকারের ও সেনাবাহিনীর পরিকল্পিত জাতিগত নিধনের শিকার। এক সময়ে ‘বার্মা’ নামে সুপরিচিত দেশটি এখন মিয়ানমার নামে পরিচিত। বার্মা নাম নিয়ে এই দেশটি যখন ব্রিটিশ শাসকদের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে, তখনো রোহিঙ্গারা ছিল সে দেশের নাগরিক ও সব ধরনের নাগরিক মর্যাদার অধিকারী। কিন্তু পরবর্তী সময়ে ১৯৭৮ সাল থেকে সে দেশের উগ্র বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদী সরকার ও সামরিক স্বৈরশাসকরা ধীরে ধীরে তাদের এসব অধিকার কেড়ে নিয়ে কার্যত মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গা নিধনের কার্যসূচি বাস্তবায়ন করে চলেছে। মিয়ানমারে হাজার হাজার বছর ধরে বসবাস করে আসা এই রোহিঙ্গাদের প্রসঙ্গে মিয়ানমার আজ ইতিহাস বিক্রি করে বলছে, এরা বাংলাদেশ থেকে অবৈধভাবে মিয়ানমারে গিয়ে সেখানে আবাস গড়ে তুলেছে। এরা মিয়ানমারের নাগরিক নয়, হতে পারে না। এদের বাংলাদেশে ফিরে যেতে হবে।’ এই অজুহাতে তাদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেয়া হয়। কেড়ে নেয়া হয়েছে তাদের রাজনৈতিক ও অর্থনীতিক অধিকারসহ যাবতীয় মানবাধিকার। এমনকি কেড়ে নেয়া হয় দেশটিতে তাদের স্বাভাবিক চলাচল, ব্যবসায়-বাণিজ্য পরিচালনা ও উচ্চশিক্ষার অধিকার। সেই সাথে মাঝে মধ্যে উগ্র বৌদ্ধরা সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের ওপর চালাতে থাকে নানা ধরনর নির্যাতন-নিপীড়ন আর সন্ত্রাসী হামলা। প্রায় নিয়মিতভাবেই চলে তাদের বাড়িঘর, ব্যবসায়-প্রতিষ্ঠান লুটপাটের ঘটনা। গ্রামের পর গ্রামে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিতে থাকে। সেই সাথে চলে তাদের ওপর নানা ধরনের অত্যাচার-নিপীড়ন, হত্যা-ধর্ষণ। এর ফলে রোহিঙ্গারা প্রাণভয়ে মাঝে মধ্যেই পালিয়ে যেতে শুরু করে প্রতিবেশী দেশগুলোতে : বাংলাদেশ, ভারত, ইন্দোনেশিয়া ও থাইল্যান্ডে। এমনকি অনেকে রাতের আঁধারে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নৌকা করে চলে যায় অস্ট্রেলিয়ায়- প্রাণে বাঁচা ও শান্তিতে মর্যাদার সাথে বাঁচার আশায়। এসব দেশে অনেক রোহিঙ্গা বসবাস করছে শরণার্থী হয়ে, নানা সমস্যা আর অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ মাথায় নিয়ে।
ইতিহাস সাক্ষী- রোহিঙ্গারা হাজার হাজার বছর ধরে মিয়ানমারের পশ্চিমাংশের রাখাইন রাজ্যে বসবাস করে আসছিল। এটি ঠিক সামান্যসংখ্যক রোহিঙ্গা বাংলাদেশেও বসবাস করে। ১৯৭০-এর দশকে মিয়ানমারে বসবাস করত ৩৬ লাখ রোহিঙ্গা। কিন্তু এর পরবর্তী সময়ে এরা বেশ কয়েকবার উগ্র বৌদ্ধ জনগোষ্ঠী এবং প্রধানত মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও নানা নামের নিরাপত্তা বাহিনীর হামলার শিকার হয়। ফলে বিভিন্ন সময়ে বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা মিয়ানমার ছেড়ে পাশের দেশগুলোতে আশ্রয় নেয়। ১৯৭৭ সালে তাদের ওপর প্রথম বড় ধরনের সামরিক হামলা চালানোর পর থেকে আজ পর্যন্ত মোট ২৫ লাখ রোহিঙ্গা মিয়ানমার ছেড়ে পালিয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে মিয়ানমার সেনাবাহিনী সবচেয়ে বড় ধরনের হামলা শুরু করে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টে। এ সময়ে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে নির্বিচার গণহত্যা চালায়। তখন প্রাণভয়ে সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নেয়, যারা আজো বাংলাদেশের শরণার্থী শিবিরগুলোতে বসবাস করছে। এর আগেও বাংলাদেশে পালিয়ে এসে আশ্রয় নেয় বহু রোহিঙ্গা। সর্বশেষ তথ্য মতে, বর্তমানে বিভিন্ন দেশে রোহিঙ্গা শরণার্থীর সংখ্যা নিম্নরূপ- বাংলাদেশ : ১৬ লাখেরও বেশি, পাকিস্তান : সাড়ে চার লাখ, মালয়েশিয়া : দুই লাখ, সংযুক্ত আরব আমিরাত : ৫০ হাজার, ভারত : ৫০ হাজার, থাইল্যান্ড : পাঁচ হাজার, অস্ট্রেলিয়া : পাঁচ হাজার, যুক্তরাষ্ট্র : পাঁচ হাজার, ইউরোপীয় ইউনিয়ন : তিন হাজার, ইন্দোনেশিয়া : এক হাজার ২০০। এখনো নানা অত্যাচার-নিপীড়ন আর মৃত্যুর আশঙ্কা মাথায় নিয়ে মিয়ানমারে রয়ে গেছে দেড় লাখ আইডিপি (ইন্টারন্যালি ডিসপ্লেসড পিপল)সহ সাড়ে আট লাখ রোহিঙ্গা। কারণ জাতিসঙ্ঘসহ বিশ্বের নানা মহলের অভিমত উপেক্ষা করে মিয়ানমার বৌদ্ধ সংখ্যাগুরু জনগোষ্ঠী ও সরকার রোহিঙ্গাদের সে দেশের ‘জাতিচ্যুত’ ও পূর্ববঙ্গ থেকে ঔপনিবেশিক আমলের অবৈধ অভিবাসী বলেই বিবেচনা করে।
মিয়ানমার থেকে পালিয়ে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে আসাটাকেই রোহিঙ্গারা বরাবর সবচেয়ে অগ্রাধিকার দিয়ে আসছে। কিন্তু মিয়ানমারে তাদের কোনো কোনো বসবাসস্থল থেকে সহজে সীমানা অতিক্রম করে ভারতে যাওয়ার সুযোগ বেশি থাকায় হাজার হাজার রোহিঙ্গা ভারতে গিয়েও আশ্রয় নেয়। ২০১৭ সালের মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নির্যাতন-নিপীড়ন ও নির্বিচার গণহত্যার সময়ে অনেক রোহিঙ্গা বাধ্য হয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছে। তখন ভারতে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের সর্বশেষ সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪০ হাজার থেকে ৫০ হাজারের মতো। সেখানে এই ‘চিলড্রেন অব নো ল্যান্ড’ কেমন আছে, তাই জানাচ্ছি এই লেখায়। রোহিঙ্গারা ভারতে গিয়ে সাধারণত বসবাস করতে শুরু করে মুসলিমপ্রধান এলাকাগুলোতে : দিল্লি, হায়দ্রাবাদ, কলকাতা, জম্মু, রাজস্থানের জয়পুর ও হরিয়ানার মেওয়াতে। তাদের অনেকের রয়েছে জাতিসঙ্ঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশন ইউএনএইচসিআরের ইস্যু করা শরণার্থী কার্ড। এই কার্ডধারীরা ভারতে গ্রেফতার ও আটক হওয়া এবং সেইসাথে উচ্ছেদ হওয়ার ঝামেলা থেকে মুক্ত। এই কার্ড দেখিয়ে তারা এসব এলাকায় নিরাপদে কাজ করে জীবিকা নির্বাহের সুযোগও লাভ করে। ফলে রোহিঙ্গাদের অনেকেই সংশ্লিষ্ট এলাকায় নির্মাণশ্রমিক, কৃষিশ্রমিক, ফেরিওয়ালা ও ঝাড়–দার ইত্যাদি কাজ করে তাদের সংসার চালাচ্ছে। এ ধরনের কষ্টের কাজ করে পাওয়া সামান্য আয় দিয়ে অভাব-অনটনের মধ্য দিয়ে সংসার চালিয়েও এরা নিজেদের সুখীই মনে করে আসছে। কারণ এখানে মিয়ানমারের মতো নরকযন্ত্রণা থেকে তারা আপাতমুক্ত। কিন্তু সেই প্রশান্তিটুকুও বুঝি তাদের আর অবশিষ্ট থাকবে না। কারণ এরই মধ্যে ওরা বিজেপি সরকারের চক্ষুশূলে পরিণত হয়েছে।
২০১৪ সালে চরম হিন্দুত্ববাদী বিজেপি সরকার ভারতের ক্ষমতায় আসীন হয়। এর পরই বিভিন্ন মহল থেকে ভারতের বিভিন্ন স্থানে আশ্রয় নেয়া তথাকথিত অবৈধ অভিবাসী রোহিঙ্গাদের উচ্ছেদ করার দাবি তোলা শুরু হয়। এই অবস্থানের প্রতি সমর্থন জানায় দেশটির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রোহিঙ্গাদের ‘বিদেশী উইপোকা’ তথা ‘ফরেনার টারমাইট’ নামে অভিহিত করেন। সেই সাথে জোর দিয়ে বলতে থাকেন- ‘রোহিঙ্গা মুসলমানেরা কখনোই ভারতের নাগরিক হতে পারে না। কারণ এরা ভারতে প্রবেশ করেছে পরোক্ষ পথে।’ রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর যে দাবি ভারতের আলট্রা-ন্যাশনালিস্ট শাসক দল ও তার মিত্রদলগুলো তুলেছে, এরই ফলে রোহিঙ্গা বসতিগুলো থেকে নির্বিচার গ্রেফতার ও আটক অভিযান শুরু হয়। নারী-পুরুষ ও শিশু কেউই বাদ পড়েনি এই অভিযান থেকে। তাদের যেসব কাগজপত্র হাজির করতে বলা হয়, তারা তা দেখাতে পারেনি। এমনকি, যাদের কাছে ইউএনএইচসিআরের শরণার্থী কার্ড ছিল, তাদেরকেও গ্রেফতার ও আটক হওয়া থেকে রেহাই দেয়া হয়নি। বসতিগুলো থেকে রোহিঙ্গাদের তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। রোহিঙ্গারা এই গ্রেফতার ও আটকের প্রতিবাদ জানালে, সরকারি বাহিনী তাদের ওপর নির্যাতন চালায়। সর্বশেষ ঘটনাটি ঘটে জম্মুতে, যেখানে নারী-পুরুষ ও শিশুদের এলোপাতাড়ি আটকের ঘটনা ঘটেছে। সর্বশেষ খবর মতে- দেড় শতাধিক রোহিঙ্গাকে আটক রাখা হয়েছে হীরানগর কারাগারে। দেশ থেকে বহিষ্কারের আগে এটি হচ্ছে খাটোয়ার নিকটবর্তী একটি ‘হোল্ডিং সেন্টার’। এ ধরনের এলোপাতাড়ি আটকের ঘটনা ঘটে রাজধানী দিল্লিতেও। ভারত সরকার মনে করে, অবৈধ রোহিঙ্গাদের উপস্থিতি ভারতের জন্য ‘মারাত্মক নিরাপত্তা হুমকি’। কারণ ভারত মনে করে- তাদের যোগাযোগ রয়েছে আইএস, পাকিস্তানের আইএসআই এবং এমনি আরো সন্ত্রাসী সংগঠনের সাথে। ভারত আরো মনে করে, শরণার্থী আন্দোলন দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সীমান্ত এলাকার আন্দোলনকে আরো অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে। ভারত সরকারের আশঙ্কা, এরা ভুয়া ভারতীয় আইডি কার্ড দেখিয়ে ‘হাওয়ালা’র মাধ্যমে তহবিল সঞ্চালন করতে পারে সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর জন্য। তারা ভারতে বসবাসরত বিভিন্ন বৌদ্ধ জনগোষ্ঠী ও রোহিঙ্গা মুসলমানদের মধ্যে নানা দ্বন্দ্ব-সঙ্ঘাতের সৃষ্টি করতে পারে। ভারত এমনটিও স্মরণে রাখে, যেহেতু দেশটি জাতিসঙ্ঘের শরণার্থী কনভেনশনের স্বাক্ষরদাতা নয়, তাই রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয় দেয়া ও তাদের নিরপত্তা বিধানে ভারতের কোনো দায় নেই।
তা সত্ত্বেও, মানবাধিকার ও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় বিশ্বে বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশের দাবিদার হিসেবে রোহিঙ্গা শরণার্থী প্রশ্নে ভারতের এই অবস্থান খুবই দুঃখজনক এবং এই অবস্থান পুনর্বিবেচনার দাবি রাখে। ভারতের বৌদ্ধসমাজ মনে করে, ভারতের এই অবস্থান তার ইতিহাস ঐতিহ্যের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। একটি দেশ ও সভ্যতা হিসেবে ভারতের সুদীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে বিশ্বের নানা শরণার্থী জনগোষ্ঠীকে আশ্রয় দেয়ার। তিব্বতের বৌদ্ধদের, পাকিস্তানের বেলুচ, বাংলাদেশের বাঙালি শরণার্থী ও আফগান শরণার্থীদের এ যাবৎ আশ্রয় দিয়েছে ভারত। ঐতিহ্য অনুসরণ করেই ভারতের মতো একটি বড় দেশের উচিত সে দেশে থাকা মাত্র ৫০ হাজার রোহিঙ্গাদের নিরাপদ আশ্রয় নিশ্চিত করা, যত দিন না এরা নিরাপদে নিজ মাতৃভূমিতে নাগরিকত্ব ও অন্যান্য অধিকার নিয়ে ফিরে যাওয়ার সুযোগ পায়। তা ছাড়া ভারতকে মনে রাখতে হবে- ভারতীয় সংবিধানের ২১ নম্বর অনুচ্ছেদে নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছে যে, কোনো ব্যক্তির ‘রাইট টু লাইফ অ্যান্ড লিবার্টি’র। তা ছাড়া রোহিঙ্গাদের ন্যায্য অধিকার আদায়ে আসিয়ান, বিমস্টেক ইত্যাদির মতো আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ফোরামে জোরালো কূটনৈতিক তৎপরতা চালিয়ে বিশ্ব দরবারে ভারতের জাতীয় মর্যাদা আরো বাড়িয়ে তুলতে পারে। ভারত কূটনৈতিক তৎপরতা চালিয়ে মিয়ানমার সরকারকে আলোচনার টেবিলে ফিরিয়ে আনতে পারে। সেই সূত্রে হয়তো একটি শান্তিপূর্ণ স্থায়ী সমাধান পাওয়া যেতে পারে রোহিঙ্গা সমস্যার। তা না করে ভারত যদি দেশ থেকে রোহিঙ্গাদের বহিষ্কার করে আবার মিয়ানমার নামক নরকে পাঠায়, তবে তা হবে অমানবিক, সেই সাথে জাতীয়ভাবে ভারতের জন্য মর্যাদা হানিকর। বুদ্ধ ও গান্ধীর দেশে এমনটি ঘটুক, তা কেউ আশা করে না। তাই ভারতের বিবেকবান মানুষ চায়, ভারত সরকার রোহিঙ্গাদের প্রতি মানবিক আচরণ নিশ্চিত করুক। তারা মনে করে, বাংলাদেশের মতো একটি ছোট্ট দেশ যদি ১৬ লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিতে পারে, তবে ভারত কেন মাত্র ৫০ হাজার রোহিঙ্গার নিরাপদ নিশ্চিন্তে থাকার ব্যবস্থাটুকু সাময়িকভাবে করতে পারবে না?
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা