২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

বাইডেনের মধ্যপ্রাচ্যনীতি : কী পরিবর্তন আনতে পারে

বাইডেনের মধ্যপ্রাচ্যনীতি : কী পরিবর্তন আনতে পারে - ছবি : সংগৃহীত

আমেরিকান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন তার মধ্যপ্রাচ্যনীতি বাস্তবায়নের কাজ শুরু করতে যাচ্ছেন বলে মনে হচ্ছে। গত সপ্তাহে জো বাইডেন মধ্যপ্রাচ্যে দু’টি পদক্ষেপ নিয়েছেন। প্রথমটি হলো, তিনি দেশের বাইরের সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর সরকারি তালিকা থেকে ইয়েমেনে লড়াইরত হুতিদের (আনসারুল্লাহ) বাদ দেয়ার বিষয়ে তার উদ্দেশ্য কংগ্রেসকে অবহিত করেন। দ্বিতীয়টি হলো, তিনি বলেছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইয়েমেনে সৌদি নেতৃত্বাধীন অভিযানে সমর্থনদান বন্ধ করবেন আর সৌদি মানবাধিকার রেকর্ডের প্রেক্ষিতে দেশটির সাথে আমেরিকান সম্পর্ক পর্যালোচনা করবেন। আলাদাভাবে দেখলে এই দু’টি কাজের খুব কমই গুরুত্ব রয়েছে বলে মনে হতে পারে। আর একসাথে মিলিয়ে দেখলে মনে হবে, দুই পদক্ষেপই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যপ্রাচ্যের নীতিতে মৌলিক পরিবর্তনেরই ইঙ্গিত। এমন প্রশ্ন অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ যে, এই পরিবর্তন এ অঞ্চলের বাস্তবতাকে কিভাবে এবং কতটা প্রভাবিত করবে।

হুতিরা ইয়েমেনের দীর্ঘস্থায়ী গৃহযুদ্ধে একটি বড় পক্ষ। তারা সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের বিপক্ষে ইরানের সাথে জোটবদ্ধ। ইয়েমেনের যুদ্ধটি অনেকাংশে গৃহযুদ্ধ থেকে অন্য দেশের প্রক্সি যুদ্ধে পরিণত হয়। সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত উভয়ই হুতিদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বিমান হামলা চালিয়ে আসছে আর তাদের বিপক্ষ শক্তিকে সহায়তা দিয়ে আসছে। অন্য দিকে ইরান হুতিকে (দৃশ্যত ইরানি প্রক্সি বাহিনী) সৌদি আরবে নিক্ষেপ করতে ক্ষেপণাস্ত্র সরবরাহ করে আসছে।

ইয়েমেন হলো মধ্যপ্রাচ্যে একটি কৌশলগত অবস্থানের দেশ। এটি সৌদি আরব এবং ওমানে শক্তি প্রয়োগ করতে পারে অথবা আরো শক্তিশালী মিত্রদের তা করার সুযোগ করে দিতে পারে। আরো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, ইয়েমেনের অবস্থান থেকে একটি কাল্পনিক শক্তি বাব এল মান্দের জলদস্যুতা বন্ধ করতে পারে এবং লোহিত সাগর বন্ধ করে দিতে পারে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, লোহিত সাগরে প্রবেশ এই অঞ্চলের জন্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৬৭ সালে মিসর ইসরাইলের সাথে ছয় দিনের যুদ্ধ শুরুর সময় তিরান প্রণালী বন্ধ করে ইসরাইলকে লোহিত সাগর থেকে প্রবেশে বাধা দেয়।

ইয়েমেন নিজে এই প্রণালী আটকানোর মতো অবস্থানে নেই, তবে আঞ্চলিক বিশৃঙ্খলা বপন করার চেষ্টায় বাইরের একটি পক্ষ হতে পারে এটি। আর যদি তা হয়ে থাকে তবে এটি মিসর, ইসরাইল এবং ইথিওপিয়াকে এমন একটি সঙ্ঘাতের দিকে টানতে পারে যা তারা না-ও চাইতে পারে। আর সৌদি আরব ও ওমানকে হুমকির মুখে ফেলে পারস্য উপসাগরে আরবদের অবস্থান দুর্বল করে তুলতে পারে।

ইরানের নিজের জন্য ইয়েমেনের প্রয়োজন নেই। তবে স্বল্পমেয়াদে ইয়েমেন এমন একটি ভিত্তি যেখানে থেকে ইরান দৃশ্যত তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী সৌদি আরবের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে। করতে পারে সংযুক্ত আরব আমিরাতের ওপরও। যদি হুতিরা ইরানের সমর্থনে গৃহযুদ্ধে বিজয়ী হতে পারে, তবে তারা এ অঞ্চলে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করতে পারবে। আর খুব কম সময়ে এই অঞ্চলে ক্ষমতার ভারসাম্য পরিবর্তন করে কিছু সুন্নি আরব শক্তিকে ইরানের সাথে সমন্বয় করার জন্য বাধ্য করতে পারে।

ইসরাইল সংযুক্ত আরব আমিরাত ও অন্য কয়েকটি আরব দেশের সাথে যে চুক্তি করেছে তা সৌদি আরবের সাথেও করতে চাইছে। ইরানি হুমকি যত বাড়বে সৌদিরা অভ্যন্তরীণ কারণে চুক্তিতে স্বাক্ষর না করলেও ইসরাইলের সাথে সম্পৃক্ত হওয়ার দিকে এগিয়ে যেতে বাধ্য হবে বলে একটি ধারণা সক্রিয় রয়েছে। সুন্নি আরব রাষ্ট্রগুলোর অনেকে ইরানকে মারাত্মক হুমকি হিসেবে দেখে এবং তারা ইয়েমেনকে কেবল ইরানের সাথে একটি পরীক্ষামূলক যুদ্ধক্ষেত্র হিসেবেই দেখেনি, পাশাপাশি সিরিয়া ও ইরাক থেকে ইয়েমেন পর্যন্ত মূল স্বার্থের প্রত্যক্ষ আক্রমণ হিসেবে দেখেছে। সুন্নি আরব দেশগুলোর ইরানের ভয় মূলত পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ে নয়, তারা যে বিষয়টিকে ভয় করে তা হলো সিরিয়া ও ইয়েমেনের মতো জায়গায় ইরানের অনুপ্রবেশ ও সাফল্যের ঘটনায় এই দেশগুলো এবং একই সাথে অন্যান্য দেশ ইরানের প্রভাব বিস্তারের ক্ষেত্রে পরিণত হবে। আর ইরান বাস্তবে যা চায় মধ্যপ্রাচ্যের সে প্রভাবশালী অবস্থান এটি তৈরি করে দেবে।

ট্রাম্প প্রশাসনের অবস্থান ছিল ইরানের পারমাণবিক অস্ত্রকে বিস্তৃত হুমকির অংশ হিসেবে বিবেচনা করা। অন্য কথায়, পারমাণবিক অস্ত্রের সাথে অথবা তা ছাড়াই, ইরানি গোপন কার্যক্রম দেশটিকে এই অঞ্চলে একটি প্রভাবশালী অবস্থান দিতে পারে বলে ধারণা করা হয়। এটি প্রতিরোধের জন্য ইরানকে অভ্যন্তরীণভাবে পঙ্গু করতে আরোপিত নিষেধাজ্ঞাগুলো ডিজাইন করা হয়েছিল। আর ইরানি অভিযান বন্ধ করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি হস্তক্ষেপের ওপর নির্ভরশীল না হয়ে ইসরাইলের সাথে একটি জোট গঠনের চেষ্টা ছিল ট্রাম্প-কুশনারের আব্রাহাম চুক্তি।

হুতিকে সন্ত্রাসবাদী তালিকা থেকে বাদ দেয়া এবং সৌদিদের মানবাধিকার রেকর্ড পর্যালোচনা করার সিদ্ধান্ত এই বিবেচনায় বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। এর মাধ্যমে বাইডেন প্রশাসন কোনো নতুন নীতির দিকে যাচ্ছে অথবা যাওয়ার পরিকল্পনা করছে বলে ইঙ্গিত দিতে চাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র এর মধ্যে ইরানের সাথে পারমাণবিক চুক্তি পুনরুদ্ধারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। তবে এটি মধ্যপ্রাচ্যে যে পরিস্থিতিতে স্বাক্ষরিত হয়েছিল সে অবস্থা ছিল এখনকার চেয়ে বেশ খানিকটা ভিন্ন। আজকের মধ্যপ্রাচ্যে, ইরানি সমস্যার সমাধান খানিকটা স্থানিক হয়ে উঠছে বলে মনে হয়। ভূ-মধ্যসাগর থেকে পারস্য উপসাগর এলাকায় ইরান ছাড়া আরো তিনটি শক্তিমান রাষ্ট্র রয়েছে। এই তিন দেশ হলো ইসরাইল সৌদি আরব ও তুরস্ক।

ইসরাইলের সাথে বাইডেন প্রশাসন কী ধরনের সম্পর্ক বজায় রাখবে তার কিছু ইঙ্গিত এর মধ্যে পাওয়া গেছে। আমেরিকার পররাষ্ট্রনীতির মৌলিক মতবাদগুলোতে ট্রাম্প কোনো পরিবর্তন এনেছেন এমনটি এখন আর মনে হয় না। যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘমেয়াদি পররাষ্ট্রনীতির বাস্তবায়ন কাজ তিনি তার মতো করে গেছেন। তবে এই বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় তিনি নিজস্ব একটি ধরন তৈরি করেছিলেন নেতানিয়াহু, বিন সালমান এবং বিন জায়েদের সাথে জামাতা কাম উপদেষ্টা জ্যারেড কুশনারের জোট গঠনের মাধ্যমে। সেই চক্র বাইডেন প্রশাসন না-ও চাইতে পারে। আগামী মাসে ইসরাইলে যে চতুর্থ দফা সাধারণ নির্বাচন হচ্ছে তাতে নেতানিয়াহুকে ক্ষমতায় না-ও চাইতে পারেন বাইডেন। এ নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন একটি কোয়ালিশন সরকার ক্ষমতায় আসতে পারে ইসরাইলে। অন্য দিকে বিন জায়েদের সাথে ইসরাইলের বোঝাপড়া অব্যাহত থাকলেও বাইডেন প্রশাসন তাকে অতটা গুরুত্ব দেবে না বলে ইঙ্গিত পাওয়া যায় এস-৩৫ সরবরাহ থেকে পিছিয়ে আসার বক্তব্যে। আর সৌদি আরবের মানবাধিকার বিষয়গুলোকে গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা আর ইয়েমেন যুদ্ধে সমর্থন বন্ধ করে দেয়ার বক্তব্যে স্পষ্ট হয় যে, মোহাম্মদ বিন সালমানকে সম্ভবত বাইডেন প্রশাসন পরবর্তী বাদশাহ হিসেবে চাইছে না। ওয়াশিংটন তার পুরনো মিত্রদের আবার সামনে নিয়ে আসতে চাইতে পারে।

এ দিকে তুরস্ক যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাটো মিত্র হলেও প্রেসিডেন্ট এরদোগানকে বাইডেন খুব বেশি চাইছেন বলে মনে হচ্ছে না। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে দুই দলের ৫৪ জন সিনেটর যুক্তভাবে তুরস্কে এরদোগান সরকারের কথিত মৌলিক অধিকার লঙ্ঘনমূলক পদক্ষেপের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে আহ্বান জানিয়েছেন। তারা বলেছেন, তুরস্ক আঞ্চলিকভাবে শক্তি প্রদর্শনমূলক নীতি বেছে নিয়েছে। তুরস্কের ব্যাপারে বাইডেন প্রশাসনের কিছুটা বৈরী মনোভাবের প্রতিফলন কয়েকটি ঘটনায় দেখা যায়। তার হানিমুন সময়ের মধ্যেই উত্তর সিরিয়ায় এবং সুন্নি অধ্যুষিত ইরাক অঞ্চলে তুর্কি অবস্থানে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটেছে। এই হামলার জন্য পিকেকে সংযুক্ত সন্ত্রাসীদের দায়ী করেছে তুরস্ক। তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা হলো উভয় ক্ষেত্রে তুর্কিদের ওপর হামলার জন্য দায়ীদের পক্ষে পরোক্ষভাবে কথা বলেছে তেহরান।

বাইডেন প্রশাসনের প্রাথমিক কাজগুলোতে যে সঙ্কেত পাওয়া যায় সেটি হলো ইসরাইল জেরুসালেমকে রাজধানী করা এবং পশ্চিম তীরের যেসব অঞ্চল তার অঙ্গীভূত করেছে সেসব মেনে নিয়েই একটি ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে আলোচনা শুরু করতে পারে যেখানে ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষকে একটি পক্ষ করা হবে। এই আলোচনায় যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা ট্রাম্পের সময়ের চেয়ে নমনীয় হবে। তবে মৌলিক ক্ষেত্রে ইসরাইলের স্বার্থের ব্যত্যয় সম্ভবত তাতে হবে না।

বাইডেন প্রশাসনের প্রাথমিক কার্যক্রমে অনেকে সন্দেহ পোষণ করেন যে, যুক্তরাষ্ট্র ও তার কোনো কোনো মিত্র তুরস্কে শাসন পরিবর্তনে সক্রিয় হয়ে উঠতে পারে। এর আগে যুক্তরাষ্ট্রের নিজস্ব টুলস এবং ইসরাইল সৌদি বলয়ের সহযোগিতা নিয়ে সেখানে অভ্যুত্থান সফল করা সম্ভব হয়নি। বরং ২০১৬ সালের এই ব্যর্থ প্রচেষ্টার পর আঙ্কারা রাশিয়া চীনের সাথে একটি ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক রক্ষার দিকে অগ্রসর হয়েছে। বাইডেন একই প্রচেষ্টা আবার নিলে যে সফল হবেন এমন বাস্তবতা সম্ভবত তুরস্কে এখন নেই। তবে এক ধরনের অস্থিরতা তাতে তৈরি হতে পারে। এ ক্ষেত্রে সৌদি তুরস্ক আঞ্চলিক কোনো সমীকরণ তৈরি হলে তাদের নিজস্ব নিরাপত্তা রক্ষা এবং আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক প্রভাব বিস্তারের এটি একটি কার্যকর শক্তি হতে পারে। এর সাথে ওআইসির শক্তিমান দেশ পাকিস্তান ইন্দোনেশিয়া আজারবাইজান মালয়েশিয়া নাইজেরিয়াকে সংশ্লিষ্ট করা গেলে বৈশ্বিক রাজনীতিতে ইসলামী দেশগুলোর একটি শক্তিমান ব্লক তৈরি হতে পারে। আর চীন-রাশিয়া অথবা যুক্তরাষ্ট্র উভয় পক্ষকে পারস্পরিক স্বার্থ নিয়ে একধরনের সমঝোতায় যেতে হবে।

বাইডেন প্রশাসন ইরান অধ্যুষিত ইয়েমেনের সাথে রিয়াদকে চুক্তিতে বাধ্য করতে চাইছে কিনা অথবা অস্থিতিশীল সৌদি আরব তৈরি করতে চায় কিনা এই ধারণা করা কঠিন। ফলে বাইডেন প্রশাসনের সাম্প্রতিক দু’টি বক্তব্য কেবলই অঙ্গভঙ্গি নাকি তার চেয়ে বেশি সে ধারণা করাও কঠিন। অবশ্য আরো একটি সম্ভাবনা থাকতে পারে যে, বাইডেন বিশ্বাস করেন যে, তিনি ইরানকে সুন্নি আরবদের সাথে কিছুটা ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্কে জড়াতে চান। পারমাণবিক চুক্তিটি মূলত লিখিত ছিল বলে তাতে প্রত্যাবর্তন করলে তা ইরানের স্বার্থের দ্বার উন্মুক্ত করতে পারে তবে তা এই অঞ্চলের বাকি অংশকে আতঙ্কিত করবে। এটি এমন একটি অঞ্চল যেখানে স্মৃতিগুলো শতাব্দী আগের দিকে ফিরে যায় এবং যেখানে বর্তমান ইরানবিরোধী জোটগুলো আকর্ষণের ওপর ভিত্তি করে নয়; বরং শীতল হিসাবের ওপর ভিত্তি করে আবর্তিত ছিল।

ট্রাম্পের চার বছরে দেখা যায়, ইরান একটি বাক্সে রয়েছে, বাকি অঞ্চলটি নজিরবিহীনভাবে সারিবদ্ধ। এখানে অস্থিরতা তৈরি করলে আমেরিকান প্রশাসনের লিবিয়ায় যে শিক্ষা হয়েছে, পরিস্থিতি তার চেয়ে আরো খারাপ হতে পারে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অর্জন হলো মধ্যপ্রাচ্যে বড় আকারের সামরিক সঙ্ঘাতে জড়িত হওয়ার বিষয়টি এড়ানো। এর ধারাবাহিকতায় অনেকে মনে করেন, ইসরাইল, সৌদি আরব, তুরস্ক, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং বাকি সবাইকে এটি পরিচালনা করতে দিতে হবে। মূল জিনিসটি হলো নৌকাটিকে ছেড়ে না দেয়া। বিপদ হলো যুক্তরাষ্ট্রের সব নতুন প্রশাসন তাদের চিহ্ন তৈরি করতে চায়। বাইডেন প্রশাসন লিবিয়ার কথা মনে করে এবং সেখানে মানবাধিকারের জন্য এটির প্রতিশ্রুতির কথা স্মরণ করে। সেখানকার সমস্যার সমাধানে এখন যুক্তও হয়েছে।

বাইডেনের কার্যক্রমে মনে হচ্ছে, ইরানকে মধ্যপ্রাচ্যে আধিপত্য বিস্তারের আরো সুযোগ করে দেয়া হবে। শক্তিধর ছয় রাষ্ট্রের সাথে পারমাণবিক চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে ওবামা প্রশাসন এই প্রক্রিয়া শুরু করেছিল। ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর তাতে উল্টো গতি দিয়েছিলেন। সেটিকে বাইডেন আবার ট্র্যাকে ফিরিয়ে আনতে চাইতে পারেন। এর মধ্যে দুই পক্ষে সমঝোতার কথাবার্তা অনানুষ্ঠানিকভাবে অনেক দূর অগ্রসর হয়ে আছে। ইরানি বিজ্ঞানিকে ইসরাইলি গোয়েন্দা সংশ্লিষ্টতায় হত্যার পর ইরানি প্রতিশোধ গ্রহণের যে কার্যক্রম সেটি বাইডেন প্রশাসনসংশ্লিষ্ট এক সূত্রের আলোচনায় বন্ধ করা হয়। বলা হয় যে, এ নিয়ে ট্রাম্পকে তার শেষ সময়ে উত্তেজনার সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়া হলে বাইডেনের দায়িত্ব গ্রহণ বিঘ্নিত হতে পারে। ইরানের সাথে পরমাণু চুক্তি সক্রিয় করার ব্যাপারে বাইডেনের পক্ষ থেকে যে শর্ত দেয়া হয়েছে সেটি মোটেই অনমনীয় কিছু নয়। পরমাণু এনরিচমেন্ট বন্ধ করা বা নামিয়ে আনার শর্ত আর তেহরানের ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের প্রাক কাজ দু’টি দেশই করবে বলে মনে হচ্ছে। এর অর্থ হলো মধ্যপ্রাচ্যে ইরান যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে একটি সহযোগিতার ক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে।

প্রশ্ন হলো, এর প্রভাব কোথায় কতটা পড়বে। এর প্রধান লক্ষ্যবস্তু হতে পারে এই অঞ্চলের অপর দুই শক্তিমান রাষ্ট্র সৌদি আরব ও তুরস্ক। ইসরাইলের নিরাপত্তা স্বার্থ রক্ষার ব্যাপারে দল নির্বিশেষে আমেরিকার অঙ্গীকারের ব্যাপারে প্রশ্ন তোলার অবকাশ নেই। উগ্রভাবে হোক বা নমনীয় প্রক্রিয়ায়, ইসরাইলের স্বার্থ ওয়াশিংটন কোনোভাইে বিঘ্নিত হতে দেবে না। তবে প্রশ্ন হলো সৌদি আরব ও তুরস্ক কী ধরনের চ্যালেঞ্জে পড়তে পারে। সৌদি আরবের সামনে দু’টি প্রধান ইস্যু হলো রাজতন্ত্র ও অখণ্ডতা বহাল রাখা আর তার আঞ্চলিক বৈশ্বিক প্রভাব ধরে রাখা। বাইডেন ক্ষমতা গ্রহণের পর যেভাবে তার প্রশাসনকে সাজিয়েছেন তাতে অনেকের অনুমান তিনি মধ্যপ্রাচ্যে আরেকটি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ঢেউ তুলতে চান। এর লক্ষ্যবস্তু হতে পারে সৌদি আরব। সৌদি আরবের সামনে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় দু’টি পথ সামনে থাকতে পারে। একটি হলো ইসরাইলের সাথে জোট বেঁধে ক্ষমতা আর অখণ্ডতা রক্ষা করা যাবে এমন ভরসা রেখে অগ্রসর হওয়া। দেশটির অধিকাংশ নাগরিক এবং ডিপ স্টেটের কেউ কেউ এটিকে শিয়ালের হেফাজতে মুরগি রাখার নামান্তর মনে করেন। এটি করা হলে, ইসরাইল রাজতন্ত্র রক্ষার চেষ্টা যতটুকু করুক না কেন দেশটির জনগণের বড় অংশের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নামতে হবে ক্ষমতাসীনদের। ধর্মীয় এস্টাবলিশমেন্ট, মুসলিম ব্রাদারহুড, তুরস্ক আর ইরানের একসাথে বৈরিতার মুখে সৌদি শাসন টিকিয়ে রাখা হতে পারে কঠিন।

এই অবস্থায় দ্বিতীয় বিকল্প হতে পারে এমন একটি আঞ্চলিক জোট ও সমঝোতা তৈরি করা যেটি নিজস্বভাবে সৌদি ক্ষমতা ও অখণ্ডতা বজায় রাখতে সহায়ক হতে পারে। এই পথটি হলো অপর আঞ্চলিক শক্তি তুরস্কের সাথে একধরনের বোঝাপড়া তৈরি করা। ইরানি হুমকি মোকাবেলায় তুরস্ক ও সহায়ক শক্তিগুলো সৌদি নিরাপত্তার জন্য সবচেয়ে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। এই সমঝোতার কিছু কাজ এগিয়েছে বলে মনে হয়। এ ক্ষেত্রে ইয়েমেন ও সিরিয়ার বিষয়ে দুই পক্ষের মধ্যে সমঝোতা হতে হবে। ইয়েমেনে সবচেয়ে বড় স্বার্থ রয়েছে সৌদি আরবের আর ইরাক ও সিরিয়ায় রয়েছে তুরস্কের। এই দুই ক্ষেত্রে উভয় দেশ একসাথে কাজ করলে ইয়েমেনে যুদ্ধের অবসান ঘটিয়ে লেবানন স্টাইলে ক্ষমতার অংশীদারিত্বের একটি ব্যবস্থা তৈরি করা সম্ভব। তুরস্ক ও পাকিস্তান এ ব্যাপারে সক্রিয় হলে ইরানের সাথেও একটি সমঝোতায় পৌঁছা সম্ভব হতে পারে। কারণ সেখানে তুরস্ক সম্পৃক্ত হলে ইরানের পক্ষে জয়ী হওয়া সম্ভব হবে না। আর সার্বিক মুসলিম বিশ্বের স্বার্থ রক্ষিত হবে পরস্পর সঙ্ঘাতে না গিয়ে সমঝোতার মাধ্যমে উম্মাহর স্বার্থ রক্ষা করার মধ্য দিয়ে। এ ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের সাথেও একধরনের বোঝাপড়া তৈরি করতে হবে। সেটি সম্ভব আর সেই উদ্যোগ এর মধ্যে রিয়াদ-আঙ্কারা নিয়েছে বলে অনুমান করা যায় দুই দেশের নীতি প্রণেতাদের বক্তব্যে।

mrkmmb@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement