২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

জনপ্রশাসন ও সুশাসন

জনপ্রশাসন ও সুশাসন - ছবি : নয়া দিগন্ত

আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ জনপ্রশাসন বা আমলাতন্ত্র। সরকারের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন ও দেশের সার্বিক উন্নয়ন ও অগ্রগতিতে আমলাদেরই আইন ও বিধিবিধানের আওতায় মুখ্য ভূমিকা পালন করার কথা। কিন্তু রাজনীতিকদের খামখেয়ালিপনার কারণে যেমন রাজনীতির কক্ষচ্যুতি ঘটেছে, তেমনই আমলাতন্ত্রও স্বকীয়তা, ঐতিহ্য ও বৈশিষ্ট্য হারাতে বসেছে। একশ্রেণীর অসাধু ও মূল্যবোধহীন আমলার কারণে পুরো আমলাতন্ত্রই এখন আসামির কাঠগড়ায়। আমলারা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হলেও তারাই এখন রাষ্ট্রের মালিক-মোক্তার বনে গেছেন। ফলে জনগণের সেবার পরিবর্তে আমলাতন্ত্র এখন অনিয়ন্ত্রিত ক্ষমতাচর্চা ও আত্মপূজাকেই নিজেদের ধর্ম-কর্ম ও কর্তব্য বানিয়ে নিয়েছে।

আমলারা জনপ্রতিনিধি বা ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত নন। কিন্তু শাসনকাজে অলক্ষে মুখ্য ভূমিকা পালন করে থাকেন তারা। রাজনৈতিক সরকার পরিবর্তিত হলেও আমলারা পদ হারান না। ফলে তারা সব সময়ই ঝুঁকিমুক্ত থেকেই নিজেদের পেশাগত দায়িত্ব পালন করেন। দুর্নীতি ও অনিয়মের কারণে সরকারের সাবেক সদস্যদের জেলে যেতে হলেও আমলারা থাকেন সবসময় ধরাছোঁয়ার বাইরে। ফলে একশ্রেণীর অসাধু আমলা দায়িত্ব পালনে অতিমাত্রায় স্বেচ্ছাচারী হওয়ার সুযোগ পান।

রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গ হচ্ছে, নির্বাহী তথা শাসন বিভাগ, আইন বিভাগ ও বিচার বিভাগ। নির্বাহী বিভাগের মূল কাজ আইন অনুযায়ী শাসনকাজ পরিচালনা করা। আইন বিভাগের কর্তব্য নতুন আইন প্রণয়ন ও পুরনো আইন সংশোধন। আর আইনের যথাযথ প্রয়োগ করে সুবিচার নিশ্চিত করার দায়িত্ব বিচার বিভাগের। রাষ্ট্রের সব অঙ্গের চেয়ে নির্বাহী বিভাগের কর্মপরিধি ও ক্ষমতা বিস্তৃত। তাই অপরাপর সব বিভাগের ওপরই নির্বাহী বিভাগ কর্তৃত্বশীল। আর রাষ্ট্রের সব অঙ্গের সমন্বিত কার্যক্রমই সুশাসনের চালিকাশক্তি। কিন্তু এসব ক্ষেত্রে আমাদের অর্জন যৎসামান্যই।

অধ্যাপক গার্নার নির্বাহী বিভাগের কার্যাবলিকে পাঁচ ভাগে ভাগ করেছেন। (এক) অভ্যন্তরীণ শান্তি ও শৃঙ্খলাবিষয়ক, (দুই) পররাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ও বৈদেশিক সম্পর্ক, (তিন) সামরিক ব্যবস্থা, (চার) বিচারবিষয়ক ক্ষমতা ও (পাঁচ) আইনবিষয়ক ক্ষমতা। নির্বাহী তথা শাসন বিভাগকে সফল ও সার্থক করে তুলতে উপরোক্ত সব উপবিভাগের মধ্যে কার্যকর সেতুবন্ধন জরুরি। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রযন্ত্রের যেমন সক্রিয়তা দরকার ও তেমনিভাবে নাগরিকদেরও হতে হবে দায়িত্বশীল। অন্যথায় রাষ্ট্রের সফলতা প্রশ্নবিদ্ধই থেকে যায়। যেমনটি হয়েছে আমাদের ক্ষেত্রে।

সংবিধানের ২১(১) অনুচ্ছেদে সুনাগরিকের দায়িত্ব সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘সংবিধান ও আইন মান্য করা, শৃঙ্খলা রক্ষা করা, নাগরিক দায়িত্ব পালন করা এবং জাতীয় সম্পত্তি রক্ষা করা প্রত্যেক নাগরিকের কর্তব্য।’ তাই দেশে সুশাসন নিশ্চিত করতে হলে সরকার, আমলাতন্ত্র, রাষ্ট্রযন্ত্র, রাজনৈতিক শক্তি ও জনগণকে ঐক্যবদ্ধভাবে নিজ নিজ অবস্থান থেকে দায়িত্ববান হতে হবে। কিন্তু দেশে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির বিচ্যুতি ও আইনের শাসনের অনুপস্থিতির কারণেই স্বাধীনতার প্রায় ৫ দশক পরও আমরা সে লক্ষ্যে পৌঁছতে পারিনি। ফলে স্বাধীনতার স্বপ্নগুলো অনেক ক্ষেত্রেই আমাদের কাছে অধরা রয়ে গেছে।

দেশে সুশাসন নিয়ে জটিলতা রয়েছে। কারণ, দুর্নীতি, আত্মস্বার্থ, গোষ্ঠীস্বার্থ, সঙ্কীর্ণ দলীয় স্বার্থ, লুটপাট, চাঁদাবাজি, হত্যা, সন্ত্রাস, নৈরাজ্য ও নারী নিগ্রহ পুরো রাষ্ট্রযন্ত্রকেই অক্টোপাসের মতো চেপে ধরেছে। সাংবিধানিক শাসন নিয়ে প্রশ্ন জোরালো ভিত্তি পেয়েছে নির্বাচন প্রক্রিয়াকে কেন্দ্র করে। অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য ‘নির্বাচন কমিশন’ নামক একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান থাকলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে জাতীয় বা স্থানীয় কোনো নির্বাচনই গ্রহণযোগ্যতার প্রশ্নে উত্তীর্ণ হতে পারেনি। দশম ও একাদশ সংসদ নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন সৃষ্টি হয়েছে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক মহলে। এমনকি সদ্যসমাপ্ত পাবনা-৪, ঢাকা-৫ ও নওগাঁ-৬ উপনির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের অনুকূলে প্রশাসনের ভোট কারচুপির অভিযোগ গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। অভিযোগ উঠেছে, সদ্য সমাপ্ত উপনির্বাচনে কেন্দ্র থেকে বিরোধী দলীয় এজেন্টদের মারধর করে বের করে দিয়ে ক্ষমতাসীন দলের অনুকূলে জাল ভোট দিয়ে ভোট দেয়া হয়েছে। আর একাজে সহযোগিতা করেছে একশ্রেণীর আমলা বা জনপ্রশাসনের একাংশ।

একই ধরনের অভিযোগ উঠেছে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত স্থানীয় সরকার নির্বাচন নিয়ে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের যেসব এলাকায় স্থানীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে সেসব নির্বাচনে সরকার সমর্থকদের ব্যাপক তা-ব, ভোট সন্ত্রাসসহ নানা ধরনের অনিয়মের ঘটনা ঘটেছে। বিরোধী দলীয় সমর্থক ও ভোটারদের ওপর হামলা এবং ব্যাপক ভোট জালিয়াতির আশ্রয় নিলেও আইনশৃঙ্খলাবাহিনীসহ সরকার অনুগত প্রশাসন সেসব দেখেও না দেখার ভান করেছে। আর এর সুবিধা ভোগ করছে ক্ষমতাসীনরা। বিষয়টিকে আমলাতান্ত্রিক বিচ্যুতি ও আইনের শাসনের ক্ষেত্রে বড় ধরনের অন্তরায় হিসেবেই দেখছেন সংশ্লিষ্টরা, যা স্বাধীন ও সভ্য সমাজে কোনোভাবেই কাম্য নয়।

এ দেশে সেই ঔপনিবেশিক শাসনামল থেকেই আমলাতন্ত্রে পেশাদারিত্ব গড়ে ওঠেনি বা গড়ে উঠতে দেয়া হয়নি। মূলত আমলারা রাষ্ট্রের কর্মচারী হিসেবে আখ্যা পেলেও উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসন দীর্ঘায়িত করতেই যাত্রা শুরু হয়েছিল ব্রিটিশ আমলাতন্ত্রের। ফলে আমলারা রাষ্ট্রের কর্মচারী হওয়ার পরও সেই উপনিবেশবাদের অশুভ বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি। তাই গণপ্রশাসনের কাছ থেকে কাক্সিক্ষত সেবা পাওয়া যাচ্ছে না বরাবরই এমন অভিযোগ করা হচ্ছে। ঔপনিবেশিক শাসনের অবসানের পরও আমাদের দেশে আমলাতন্ত্র সেই সঙ্কীর্ণ বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি।

দেশের চলমান নেতিবাচক রাজনীতিই গণপ্রশাসনকে আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছে। ক্ষমতার প্রভাব বলয় থেকেই আমলাতন্ত্রের সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। কোনো সরকারই ব্যুরোক্রেসিকে একটি পেশাদারি সত্তা হিসেবে দাঁড় করানোর চেষ্টা করেনি। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এই নেতিবাচক প্রবণতা আরো বেড়েছে।
সরকারকে নীতি প্রণয়নে তথ্য-উপাত্ত দিয়ে সহায়তা এবং সেই নীতি ও কার্যক্রম বাস্তবায়ন প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের দায়িত্ব। দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে আমলাদের অপেশাদারি ও দলবাজ হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তা সম্পর্কে একজন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বলেন, রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তারা হবে সুদক্ষ, পেশাদারি, অধীনস্থ কর্মকর্তা, যারা স্থায়ীভাবে চাকরি করেন এবং রাজনীতির সাথে যাদের কোনো সংশ্রব নেই।

বস্তুত, নেতিবাচক রাজনীতির কারণেই আমাদের দেশের আমলাতন্ত্র কাক্সিক্ষত মান অর্জন করতে পারেনি। দীর্ঘ দিন ধরে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের রাজনৈতিক বিবেচনায় পদায়ন, পদোন্নতি এবং ক্ষেত্রবিশেষে নিয়োগ গণপ্রশাসনের কার্যকারিতা হ্রাস করে ফেলেছে। একশ্রেণীর দলবাজ কর্মকর্তাও এ জন্য কম দায়ী নন। দুঃখজনক হলেও এটি সত্য, এসব কর্মচারীর একটি অংশ ইদানীং দলীয় বিবেচনাতেই তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছেন। ১৯৯৬ সালের আমলা বিদ্রোহের ঘটনাও এ ক্ষেত্রে উল্লেখ করা যুক্তিযুক্ত হতে পারে। এতে ব্যক্তিগতভাবে তারা হয়তো অনেকেই লাভবান হয়েছেন। কিন্তু পরিণতিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আমলাতন্ত্রের পেশাদারিত্ব। দেশ ও জাতি বঞ্চিত হয়েছে সুশাসন থেকে। আর তার মাশুল দিচ্ছে জনগণ।
আমলাতন্ত্র পেশাদারি হয়ে ওঠেনি বা প্রাতিষ্ঠানিক রূপও পায়নি তা সর্বশেষ অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও তৎপরবর্তী বিভিন্ন নির্বাচন ও উপনির্বাচনগুলোতে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। অভিযোগ উঠেছে, বর্তমান নির্বাচন কমিশনের অধীনে কোনো নির্বাচনই অবাধ, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য হয়নি। আর এর নেপথ্যে কাজ করেছে রাষ্ট্রীয় প্রশাসন, যা দুর্ভাগ্যজনক।

সাম্প্রতিক নির্বাচনগুলোতে প্রশাসন বিরোধীদলীয় প্রার্থীদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করেছে বলে জোরালো অভিযোগ করা হচ্ছে। সেসব অভিযোগের সত্যতা অস্বীকার করার মতোও নয়। নির্বাচনে যেকোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার ক্ষেত্রে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের দায়িত্ব হবে দৃঢ়তার সাথে আইন ও ন্যায়ের প্রতি নিষ্ঠাবান থেকে এবং কোনো ধরনের আবেগ, অনুরাগ ও বিরাগের বশবর্তী না হয়ে দায়িত্ব পালন করা। তারা আইনকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেবেন, কোনো ব্যক্তি বা দলকে নয়। শান্তিপূর্ণ ও আইনসম্মত প্রতিবাদে কোনো প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করাও জনপ্রশাসনের কাজ নয়। গ্রেফতার কিংবা শক্তি প্রয়োগের প্রশ্নে কারো ইন্ধনে তাদের প্ররোচিত হওয়ার কথা নয়। কিন্তু বর্তমান আমলাতন্ত্রে এসব তত্ত্বীয় নীতিমালার প্রতিফলন তো দূরের কথা বরং উল্টোটাই ঘটছে।

সা¯প্রতিক কোনো নির্বাচনেই প্রশাসনের ভূমিকা প্রশ্নাতীত হয়নি, যা সরকারি কর্মচারী বিধিমালা ও সংবিধানের মারাত্মক লঙ্ঘন। সংবিধানের ২১(২) অনুচ্ছেদে সরকারি কর্মচারীদের কর্তব্য সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘সবসময় জনগণের সেবা করার চেষ্টা করা প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তির কর্তব্য’।

মূলত জনপ্রশাসন ও নির্বাচন কমিশনের ধারাবাহিক ব্যর্থতার কারণেই দেশের কোনো নির্বাচনই নিরপেক্ষতা ও গ্রহণযোগ্যতায় উত্তীর্ণ হতে পারেনি।

smmjoy@gmail.co


আরো সংবাদ



premium cement