২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`


জিডিপি নিয়ে বিতর্ক আর কত?

জিডিপি নিয়ে বিতর্ক আর কত? - ছবি : অন্য দিগন্ত

গত এক দশক ধরেই বাংলাদেশের অর্থনীতির গতিবিধি নির্ধারণে জিডিপির প্রবৃদ্ধির বিষয়টি মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে চলে এসেছে। তা সত্ত্বেও বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিপিডি (সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ) কয় বছর থেকেই জোর দিয়েই বলে আসছে, জিডিপির প্রবৃদ্ধির হারের গুণগত ও বিতরণ সম্পর্কিত বিষয়গুলো (কোয়ালিটেটিভ ও ডিস্ট্রিউটিভ আসপেক্টস) প্রবৃদ্ধি-অঙ্কের চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। তাই আজকে আমরা যেভাবে জিডিপির হার নির্ধারণ করছি, তার প্রয়োজনীয় সংস্কার প্রয়োজন। নইলে আমরা বিশ্বাসযোগ্য একটি প্রবৃদ্ধি হার নির্ধারণ করতে পারব না।

এ দিকে কোভিড-১৯ মহামারীর প্রেক্ষাপটে বিশ্বাসযোগ্য জিডিপি হার নির্ধারণের বিষয়টি আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। কারণ এমন একটি কঠিন সময়ে অর্থনৈতিক নীতিনির্ধারকদের জন্য জিডিপির প্রবৃদ্ধি-হারের একটা বড় ধরনের প্রভাব রয়েছে। দেখা গেছে, কয়েক বছর ধরে জিডিপির প্রবৃদ্ধি হার নিয়ে একটি সাংবাৎসরিক বিতর্ক চলে আসছে। যারা বিতর্ক তুলছেন তারা বলছেন- সরকার ঘোষিত প্রবৃদ্ধি হারের সাথে বেশ কিছু সামষ্টিক অর্থনৈতিক ও উন্নয়ন পরিস্থিতি বা সূচক সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। যেমন বেসরকারি খাতের ঋণ, রাজস্ব সঞ্চালন, মূলধনী যন্ত্রপাতির আমদানি ব্যয় পরিশোধ, জ্বালানি ভোগ, আমদানি আয়, কর্মসংস্থান সৃষ্টিসহ অনেক ক্ষেত্রের পরিস্থিতির সাথে সরকারঘোষিত প্রবৃদ্ধি হারের মিল নেই। সম্প্রতি সরকারের পরিসংখ্যান ব্যুরো বিগত অর্থবছরের জন্য যে জিডিপি হার ঘোষণা করেছে, তা নিয়ে এবারো আগের বিতর্কেরই পুনরাবৃত্তি ঘটতে দেখা গেছে।

সিপিডি অভিযোগ তুলে বলেছে- ‘প্রবৃদ্ধি হারের তথ্য রাজনৈতিভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। প্রবৃদ্ধি এখন একটি রাজনৈতিক সংখ্যায় পরিণত হয়েছে। প্রবৃদ্ধি নিয়ে নীতিনির্ধারকদের মধ্যে এক ধরনের মোহ সৃষ্টি হয়েছে।’ সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড: ফাহমিদা খাতুন এভাবেই সদ্য ঘোষিত প্রবৃদ্ধি হারের ব্যাখ্যা দিলেন। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) প্রকাশিত বিদায়ী অর্থবছরের জিডিপির সাময়িক হিসাব নিয়ে গত ১৬ আগস্ট সিপিডি আয়োজিত এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, প্রবৃদ্ধির হিসাব অতিরঞ্জিত করে লাভ নেই। এটি নীতিনির্ধারকদের সহায়তা করবে না। তিনি মনে করেন, তথ্য-উপাত্ত সৃষ্টিকারী প্রতিষ্ঠান বিবিএসের (বাংলাদেশ ব্যুরো অব স্ট্যাটিস্টিকস) স্বাধীনতা খর্ব করা হচ্ছে। বিবিএসের দেয়া জিডিপির প্রাক্কলনে করোনার প্রভাব তেমনভাবে প্রতিফলিত হয়নি।

গত সপ্তাহে বিবিএস বলেছে, গত অর্থবছরের জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৫ দশমিক ২৪ শতাংশ। কিন্তু উল্লিখিত সংবাদ সম্মেলনে সিপিডির বিশেষ ফেলো ড: মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, প্রবৃদ্ধির এই হিসাব বাস্তবতার সাথে মিলছে না। বিবিএস বলছে করোনার মধ্যেও ব্যক্তি বিনিয়োগ গতবারের চেয়ে কিছুটা বেড়েছে, যা নীতিনির্ধারকদের ভুল বার্তা দিচ্ছে। এত বিনিয়োগ হলে তবে ব্যবসা-বাণিজ্য চাঙ্গা রাখার জন্য প্রণোদনা প্যাকেজ দরকার হতো না; সেবা খাতের সম্পূরকে মূল্যায়ন করতে গিয়ে সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জম বলেন, বিবিএসের তথ্য-উপাত্ত দেখে মনে হচ্ছে, করোনার মধ্যেও সেবা খাতের পতন ঘটেনি। কিন্তু আমরা জানি, এ সময় কত মানুষ কর্মহীন হয়েছে। তাদের জন্য সরকারকেও নানা ধরনের সহায়তা কর্মসূচি নিতে হয়েছে।

সংবাদ সম্মেলনে সিপিডির মূল্যায়ন তুলে ধরে সংস্থার গবেষক তৌফিকুল ইসলাম খান বলেছেন, অর্ধেকেরও বেশি খাতে জিডিপি প্রাক্কলন করার মতো গ্রহণযোগ্য তথ্য-উপাত্ত নেই। বিবিএসের দেয়া জিডিপির হিসাব বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে পারে। তাই সিপিডি একটি পরিসংখ্যান কমিশন তৈরির সুপারিশ করেছে।

সিপিডির এ বক্তব্যে সরকার পক্ষ এবারো অনেকটা ক্ষুব্ধ। অর্থমন্ত্রীর প্রতিক্রিয়ায় সেই ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তাফা কামাল গত ১৭ আগস্ট বলেছেন, ‘বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিপিডি আমাদের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করছে। এটি তাদের ব্যবসা ও সহজ ব্যবসা। আমাদের তথ্য-উপাত্ত ব্যবহার করেই তারা অনেক অনুষ্ঠান করে।’

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সাথে চলতি অর্থবছরের রাজস্ব আদায়ের পরিকল্পনাবিষয়ক অনলাইন বৈঠক শেষে এক প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী এ কথা বলেন। তিনি বলেন, মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) হিসাব বের করার দরকার নেই। এ দেশের খাল-বিল, নদী-নালা, গ্রামীণ অবস্থা, এসব দেখলেই বোঝা যায় বাংলাদেশের কী অবস্থা। অর্থমন্ত্রী আরো বলেন, ‘সিপিডি বলে বেড়ায়। আর আমরা যা বলি, তা প্রমাণ করার চেষ্টা করি। যখন যা বলেছি, সব সঠিক হয়েছে।’

অর্থমন্ত্রী সাংবাদিকদের কাছে প্রশ্ন রাখেন, সিপিডি কিসের ভিত্তিতে কথা বলে? তিনি নিজেই এবার জবাব দেন, আন্দাজের ভিত্তিতে কথা বলে। উন্নয়নচিত্রের উদাহরণ দিতে গিয়ে অর্থমন্ত্রী বলেন, তারা (সিপিডি) এ দেশের রাস্তাঘাট দেখে না। বিবিএস তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে কাজ করে, আর সিপিডি করে আন্দাজে।

কথাটি কি যথার্থ হলো- এমন প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘যথার্থই। তবে সিপিডি সিপিডির কাজ করছে, আমরা আমাদের কাজ করছি। আমাদের হিসাব যে সঠিক, সারা বিশ্বই তা বিশ্বাস করছে।’
অর্থমন্ত্রীর এই দাবি মতে, প্রবৃদ্ধি-সম্পর্কিত সরকারি হিসাবই সারা বিশ্ব বিশ্বাস করছে, তাইবা বলা যায় কী করে? করোনা মহামারীর প্রভাবের বিভিন্ন দিক বিবেচনা করে বিগত অর্থবছরে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিয়ে বিশেষজ্ঞরা এর আগেই অনেকটা ঐকমত্য পোষণ করে বলেছিলেন, প্রবৃদ্ধির পরিকল্পিত লক্ষ্যমাত্রা ৮.২০ শতাংশের চেয়ে উল্লেখযোগ্য মাত্রায় কম হবে। তখন অর্থ মন্ত্রণালয় বলেছিল, এই প্রবৃদ্ধির হার হতে পারে ৫.২০ শতাংশ। এটি ছিল স্বাধীন প্রাক্কলনের পুরোপুরি বিপরীত। সিপিডির এর আগের প্রাক্কলনে বলা হয়েছিল, এই প্রবৃদ্ধি হার হতে পারে ২.৫ শতাংশ।

চলতি বছরের এপ্রিলে বিশ্বব্যাংক বলেছিল, এই হার হতে পারে ২ থেকে ৩ শতাংশ, আর আইএমএফের জুনের প্রাক্কলন মতে ৩.৮ শতাংশ। লক্ষ করার ব্যাপার হলো, জিডিপির প্রবৃদ্ধির যে সাময়িক প্রাক্কলিত ৫.২৪ শতাংশ হার সম্প্রতি ঘোষিত হয়েছে তা সরকারের পূর্বাভাষিত হার ৫.২০ শতাংশের প্রায় কাছাকাছি এবং বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ ও সিপিডির পূর্বাভাষিত হারের চেয়ে অনেক বেশি। এ বিষয়টিও এবারের প্রবৃদ্ধি হার নিয়ে জনমনে সন্দেহের ক্ষেত্র তৈরি করেছে। তা ছাড়া এতে সন্দেহ নেই, পুরো দুই মাসব্যাপী লকডাউনের ‘সাধারণ ছুটি’ চলার সময় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে বড় ধরনের অভিঘাত সৃষ্টি হয়। এর ফলে প্রায় সব খাতে বিভিন্ন মাত্রায় বড় ধরনের উদ্বেগজক পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে দেখা গেছে। তখন সিপিডি বলেছিল, এর ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়েছে পাঁচটি খাত : বৃহদাকার উৎপাদন, নির্মাণ, হোটেল ও রেস্তোরাঁ, পরিবহন, মজুদ ও যোগাযোগ এবং সামাজিক ও ব্যক্তি সেবা খাত।

তা ছাড়া প্রবৃদ্ধি নিয়ে প্রশ্ন শুধু সিপিডিই তুলছে এমনটি নয়। অর্থনীতিবিদেরকেও এ ব্যাপারে নানা ধরনের প্রশ্ন তুলতে দেখা গেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক সায়েমা হক প্রথম শ্রেণীর একটি দৈনিকে প্রকাশিত এক লেখায় উল্লেখ করেছেন- করোনার কারণে বিগত অর্থবছরের শেষ চার মাসে কৃষি ছাড়া অন্যান্য খাতের অর্থনৈতিক কার্যক্রম প্রায় স্থবির ছিল। তাই ২০১৯-২০ অর্থবছরের ৫ দশমিক ২৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অসঙ্গতিপূর্ণ।

বিবিএসের প্রবৃদ্ধি হার কেনো অসঙ্গতিপূর্ণ তার কয়েকটি সুনির্দিষ্ট কারণও তিনি তুলে ধরেছেন- প্রথমত, অর্থনীতির অন্যান্য সূচকের সাথে এই প্রবৃদ্ধি সঙ্গতিপূর্ণ নয়। যেমন- ভ্যাট আদায়, ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ এবং ব্যক্তি খাতে ঋণপ্রবাহের সংখ্যাগুলোর সাথে এই প্রবৃদ্ধির সংখ্যা মিলছে না। এ ছাড়া রফতানি আয়, উৎপাদনের কাঁচামাল আমদানি- যা শিল্প-উৎপাদনের প্রবৃদ্ধির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত, সেসব সূচকের ক্ষেত্রেও আমরা নেতিবাচক চিত্র দেখেছি। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর পূর্বাভাসও ছিল অনেক কম। তৃতীয়ত, গাণিতিকভাবে অর্থবছরের শেষ চার মাসে করোনার কারণে অর্থনৈতিক কার্যক্রম একেবারেই স্থবির ছিল। এ পরিস্থিতিতে সরকারি হিসাব মতে, আলোচ্য অর্থবছরে সেবা খাতে ৫ দশমিক ৩২ শতাংশ ও শিল্প খাতে ৬ দশমিক ৪৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হতে হলে করোনা-পরবর্তী প্রথম আট মাসে এই দুই খাতে বড় ধরনের প্রবৃদ্ধি হওয়া দরকার, যদিও সে ধরনের তথ্য বা ইঙ্গিত আমরা দেখিনি। সর্বোপরি প্রবৃদ্ধির সংখ্যাগত হিসাব নয়- আমাদের গুরুত্ব দিতে হবে গুণগত মানের দিকে, অর্থাৎ অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধিই লক্ষ্য হওয়া উচিত।

অন্য দিকে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি, প্রফেসর মঈনুল ইসলাম এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করেন, বাংলাদেশে অনেক দিন আগে থেকেই জিডিপির প্রবৃদ্ধি বাড়িয়ে বলার প্রবণতা শুরু হয়েছে। বর্তমান পরিকল্পনামন্ত্রীর আগে যিনি ওই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন তার সময় থেকেই এ চর্চা ও বিতর্ক শুরু হয়েছে। প্রবৃদ্ধির বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন থাকায় বিশ্বব্যাংক এ প্রবৃদ্ধিকে মেনে নেয় না। তবে এটাও ঠিক, আমাদের অর্থনীতি যে খুব খারাপ করেছে তা বলা যাবে না।

তিনি আরো বলেন, গত অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে অর্থনীতি ভালো করেছে। ১৭ মার্চ থেকে করোনার কারণে ব্যবসা-বাণিজ্যে এক ধরনের ধস নামে। দেশে ‘লকডাউন’ দেয়া হয়। প্রশ্ন হলো, এর পরও কিভাবে কিছু খাতে আগের বছরের চেয়ে বেশি প্রবৃদ্ধি হলো? আমাদের যেহেতু জিডিপির হিসার বের করার বিকল্প কোনো ব্যবস্থা নেই, তাই না চাইলেও যা-ই বলা হচ্ছে তা-ই মেনে নিতে হচ্ছে।
তিনি আরো বলেন, ‘পরিসংখ্যান ব্যুরো যেহেতু পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের অধীন, তাই তাদের নির্দেশনা মেনে কাজ করতে হয়। তথ্য-কারসাজি করতে হয়। প্রবৃদ্ধি নিয়ে যে সন্দেহ, তা অযৌক্তিক নয়। জিডিপির হিসাবে নানা কারসাজির সুযোগ আছে। সরকার সেই সুযোগ কাজে লাগাচ্ছে। যেহেতু জিডিপির তথ্য কারসাজি করে বাড়িয়ে দেখানো শুরু হয়েছে, তাই শিগগিরই এ থেকে কেউ বের হয়ে আসবে না। এমনকি পরবর্তী সরকারও এ থেকে বের হয়ে আসতে পারবে না। কারণ জিডিপি এখন রাজনৈতিক বক্তব্যের অংশ।’

জিডিপির স্পর্শকাতরতা নিয়ে বলতে গিয়ে বিআইডিএসের মহাপরিচালক কে এস মুরশিদের অভিমত হচ্ছে, ‘বিগত অর্থবছরে জিডিপি বেড়েছে বলেই আমার মনে হয়। তবে বিবিএস যে হার বলেছে, সেখানে কিছুটা বাড়িয়ে ধরার (ওভার এস্টিমেশন) প্রবণতা থাকতে পারে। বিবিএস ছাড়া জিডিপির হিসাব আর কেউ করে না। তাই আমাদের দেখতে হবে অন্যান্য সূচকের সাথে জিডিপির হিসাবটা কতটুকু সামঞ্জস্যপূর্ণ। মূলধনী যন্ত্রপাতি, শিল্পের কাঁচামাল, মধ্যবর্তী পণ্য প্রভৃতি কতটুকু আমদানি হলো, বিনিয়োগ কতটুকু বাড়ল- এসবের সাথে জিডিপির প্রবৃদ্ধি হারের সামঞ্জস্য থাকতে হবে। সব মিলিয়ে সামান্য অস্বস্তি আছে। বিভিন্ন হিসাবের সাথে জিডিপির প্রবৃদ্ধির সামঞ্জস্য পাওয়া যায় না। এ অঞ্চলের দেশগুলোতে জিডিপির হারকে একটু বাড়িয়ে দেখিয়ে রাজনৈতিক সুবিধা নেয়ার একটা প্রবণতা রয়েছে। অথচ আমাদের কথা বলা উচিত আয়-বৈষম্য, দারিদ্র্য, পুষ্টি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য খাতের অবস্থা প্রভৃতি নিয়ে। একজন মানুষের জীবনে সুখ, স্বাচ্ছন্দ্য ও শান্তি কতটুকু বাড়ল সেটিই বিবেচ্য হওয়া উচিত। জিডিপি দিয়ে সেটি নির্ণয় করা যায় না।

বাস্তবতা হচ্ছে- বিগত এক দশক ধরে বাংলাদেশের অর্থনীতি গড়ে প্রতি বছর ৬ শতাংশ হারে বেড়েছে। এই প্রবৃদ্ধি হার অতি সাম্প্রতিক কয়েক বছরে ৭ শতাংশের চেয়ে কিছুটা উপরে ওঠে। একসময় সরকার বলে ২০১৭-১৮ অর্থবছরের দিকে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার হবে মোটামুটি ৮ শতাংশ, যা দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের ধারণাকে ভিত্তি করে বলা হয়, ২০০৮-২০১৭ সময়ে বাংলাদেশ বিশ্বের সেরা প্রবৃদ্ধি অর্জনকারী ২০ দেশের তালিকার এক দেশ। কিন্তু এ প্রবৃদ্ধি হার- তা লক্ষ্যমাত্রার কিংবা বাস্তবেরই হোক- সব সময়ই ছিল একটি বিতর্কের উপাদান। সরকারের নির্ধারিত প্রবৃদ্ধি হার নিয়ে উন্নয়ন সহযোগী, বিশেষত বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ ও এডিবির মধ্যে রশি টানাটানি কিছুটা কমে এর বিতর্ক যে শেষ হয়ে যায়নি, তা স্বীকার করতে হবে। সরকার ঘোষিত উচ্চ প্রবৃদ্ধির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ কাঠামোগত উন্নয়নের অভাব কার্যত দেশে প্রবৃদ্ধি সম্পর্কিত বিতর্কের জন্ম দেয়। সমালোচকদের অভিযোগ, সরকারের দাবি করা উচ্চ প্রবৃদ্ধি হার নির্ধারণে অতিরঞ্জনের আশ্রয় নেয়া হয়।’ অনেক অর্থনীতিবিদও এমনটি মনে করেন। মোটামুটিভাবে ধারণা করা হয়, প্রবৃদ্ধির হার ১ শতাংশের মতো বাড়িয়ে বলা হচ্ছে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের জন্য।

এবারের বিতর্কে করোনা পরিস্থিতি বাড়তি বিতর্ক সামনে নিয়ে এনেছে। অন্যান্য দেশে যেভাবে করোনার প্রভাব জিডিপির হার ব্যাপকভাবে কমিয়ে এনেছে, তেমনটি বাংলাদেশে দেখা যাচ্ছে না। অথচ বাংলাদেশও করোনার প্রভাবমুক্ত ছিল না। সমালোচকরা বলছেন, জিডিপি ব্যাপকভাবে কমেছে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র্র, সিঙ্গাপুরসহ অনেক দেশে। চলতি বছরে জুলাই-জুন সময়ে পাকিস্তানের জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার নামেমাত্র ০.৪০ শতাংশে, জানুয়ারি-জুন সময়ে ভিয়েতনামের প্রবৃদ্ধি ছিল ১.৪১ শতাংশ। অন্যান্য দেশেও এ ধরনের চিত্র বিবেচনায় রেখে সিপিডির প্রাক্কলনে, বিগত অর্থবছরে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি মোটামুটি ২.৫০ শতাংশ হওয়ার কথা। মনে রাখতে হবে, সব অর্থবছর একই সময়ে নয়। তা ছাড়া কোভিডের প্রভাবও সব দেশে একই সময়ে ঘটেনি। তাই প্রবৃদ্ধির চেয়ে অন্যান্য দেশের উদাহরণ একদম সরলরেখায় টানা যাবে না, যদিও এর একটা প্রভাব ছিল।

এর পরও স্বীকার করতে হবে, আমাদের জিডিপি অঙ্ক নির্ধারণ নিয়ে বিতর্কের সমূহ অবকাশ রয়েছে। জিডিপির হারকে অন্যান্য খাতের পরিস্থিতি ও সূচকের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ করতে হবে। প্রয়োজনে জিডিপি হিসাবের পদ্ধতিতে সংস্কার আনতে হবে। কারণ অভিযোগ আছে- আমাদের জিডিপি হিসাবে অনেক খাতেই বাস্তব তথ্য-উপাত্ত ব্যবহার হয় না। জিডিপি হিসাবের অর্ধেকেরও বেশি খাতে নেই নির্ভরযোগ্য তথ্য। তা ছাড়া সরকার পক্ষকে বাস্তবতা স্বীকার করতে হবে। জিডিপির হারের রাজনৈতিক ব্যবহার নিয়ে জনমনে যে এক ধরনের অবিশ্বাস জন্মেছে, তা দূর করার দায়িত্ব সরকারেরই। বিদ্যমান প্রেক্ষাপটে সিপিডি যে একটি কমিশন গঠনের সুপারিশ করেছে, সে বিষয়টিও আমলে নিতে হবে। কারণ জিডিপি নিয়ে সাংবাৎসরিক বিতর্ক আর কত দিন?


আরো সংবাদ



premium cement