২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ক্যাশ ওয়াক্ফ ও ইসলামী ব্যাংকগুলোর দায়িত্ব

ক্যাশ ওয়াক্ফ ও ইসলামী ব্যাংকগুলোর দায়িত্ব - নয়া দিগন্ত

প্রথমে ওয়াক্ফ সম্পর্কে আলোচনা করছি। আমরা সবাই জানি, ওয়াক্ফ হচ্ছে আল্লাহ তায়ালার পথে এবং নামে কোনো স্থায়ী সম্পদ চিরতরে দান করা যার ওপর তার আর কোনো মালিকানা থাকে না। এর মালিকানা হয়ে যায় শুধু আল্লাহ পাকের।

ইসলামের ইতিহাসে শুরু থেকে ওয়াক্ফ প্রযোজ্য। সাধারণত জমিজমা ওয়াক্ফ করা হতো। ওয়াক্ফের খুব ব্যাপক প্রচলন ছিল। একসময় মুসলিম বিশ্বে- বিশেষ করে মধ্য এশিয়ায় প্রায় অর্ধেক জমিজমা ওয়াক্ফের আওতায় চলে যায়। এই সব ওয়াক্ফকৃত সম্পত্তির আয় থেকে সব মাদরাসা, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও হাসপাতাল চালানো হতো। গরিব-দুঃখীদের প্রয়োজনে বৃত্তি দেয়া হতো। ইসলামী সমাজে সমাজব্যবস্থার ব্যাপক অংশ ওয়াক্ফ করার জন্য নিয়ন্ত্রিত ছিল। সে সমাজে দারিদ্র্য উঠে গিয়েছিল এবং সব সেবাপ্রতিষ্ঠান ও সব মসজিদ ওয়াক্ফের আয় দিয়েই চলত।

রাশিয়ায় ১৯১৭ সালের কমিউনিস্ট বিপ্লবের পরে পুরো সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নে, বিশেষ করে তাদের নিয়ন্ত্রিত মুসলিম রাষ্ট্রগুলোতে ওয়াক্ফ বাতিল করে দেয়া হলো এবং রাষ্ট্র কর্তৃক ওসব জমিজমা দখল করে নেয়া হয়। এর ফলে ওয়াক্ফের মাধ্যমে যে সব ইসলামী প্রতিষ্ঠান চলত যেমন- মসজিদ, মাদরাসা, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, হাসাপাতাল ও এতিমখানা-এগুলো আস্তে আস্তে বন্ধ হয়ে যায়। কারণ এগুলো চালানোর জন্য কোনো অর্থ ছিল না। কেননা রাষ্ট্র ওয়াক্ফ সম্পত্তি দখল করে নিয়েছিল।

এখন দরকার একটি নতুন ওয়াক্ফ আন্দোলন। আমাদের দেশের বিত্তশালীরা নিজেদের হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ শুধু দুই-তিন সন্তানের জন্য রেখে যান। এর চেয়ে অনেক ভালো হতো যদি এসব বিত্তশালী তাদের দুই-তিন ছেলেমেয়ের জন্য ১০০ কোটি টাকার মতো সম্পদ রেখে বাকি ৯০০ কোটি টাকা ওয়াক্ফ করে দিতেন (আমি ধরে নিয়েছি সম্পদের মূল্য এক হাজার কোটি)। যদি আমাদের দেশের বিত্তশালীরা এভাবে ওয়াক্ফ করেন, তাহলে বাংলাদেশের সব সামাজিক সংগঠনের অর্থায়নে কোনো সমস্যা থাকত না এবং স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় অর্থায়নে কোনো সমস্যা থাকত না। দরিদ্রদের ভাতাও দেয়া যেত। এতে দারিদ্র্য দূর হয়ে যেত।

এখন আমি ক্যাশ ওয়াক্ফ সম্পর্কে বলব। ইসলামের শুরুতে ‘ক্যাশ ওয়াকফ’ ছিল না। কোনো না কোনো স্থায়ী সম্পদ ওয়াক্ফ করা হতো। কিন্তু এখন ইসলামী চিন্তাবিদরা মনে করেন, নগদ অর্থ বা ক্যাশও একটি সম্পদ। সুতরাং নগদ অর্থ বা ক্যাশও ওয়াক্ফ করা যায়। এ কথা বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত হয়ে গেছে। বিশ্বব্যাপী ক্যাশ ওয়াক্ফ দিন দিন বাড়ছে। ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ও তুরস্কে ক্যাশ ওয়াক্ফ ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। আমাদের দেশে কিছু ইসলামী ব্যাংক ক্যাশ ওয়াক্ফ শুরু করেছে। বর্তমানে ক্যাশ ওয়াক্ফের পরিমাণ প্রায় এক হাজার কোটি টাকা। এটা এক লাখ কোটি টাকাও হতে পারে বা তার বেশিও হতে পারে। ক্যাশ ওয়াক্ফে মূল সম্পদ ব্যবহার করা হয় না; এর আয় ব্যবহার করা হয়। মূল সম্পদ অটুট থাকে।

ক্যাশ ওয়াক্ফের ক্ষেত্রে ড. এম এ মান্নান- যিনি ইসলামী ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের বড় অফিসার ছিলেন- তিনি পিএইচডি করেন আমেরিকায়। তিনি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কাজ করেছেন। বর্তমান বিশ্বে ক্যাশ ওয়াক্ফ আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তিনি আরো অনেক কাজ করছেন। কিন্তু তার মূল কাজ ক্যাশ ওয়াক্ফ নিয়ে।

এখন বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংকগুলো ক্যাশ ওয়াক্ফের ক্ষেত্রে কী ভূমিকা রাখতে পারে সে সম্পর্কে আলোচনা করছি। ক্যাশ ওয়াক্ফ স্থানীয়ভাবে প্রত্যেক জেলায় কার্যকর করা যায় এবং এ জন্য প্রত্যেক এলাকায় ফাউন্ডেশন গঠন করা যেতে পারে।

এ ব্যাপারে সরকারও উদ্যোগী ভূমিকা পালন করতে পারে। তবে এসব ফাউন্ডেশনকে অবশ্যই দলীয় রাজনীতিমুক্ত হতে হবে এবং সরকার অনুমোদিত যোগ্য ব্যক্তিরাই এগুলো পরিচালনা করবেন। তবে মূল ভূমিকা ইসলামী ব্যাংকগুলোকে নিতে হবে। তারা এখন পর্যন্ত তা নিচ্ছেন না। যদি তারা তা নিতেন, তাহলে ক্যাশ ওয়াক্ফের পরিমাণ বাংলাদেশে প্রায় এক লাখ কোটি বা তার বেশি হতো। ক্যাশ ওয়াক্ফ এক হাজার টাকা করা যায়, আবার ১০০ কোটি টাকাও করা যায়। যদি ইসলামী ব্যাংকগুলো একটি ক্যাশ ওয়াক্ফ আন্দোলন শুরু করে, তাহলে এই আন্দোলনে তারা বিশাল ভূমিকা পালন করতে পারবেন। যদি এক লাখ কোটি টাকার ক্যাশ ওয়াক্ফ আন্দোলন হয়, তাহলে তার আয় হবে প্রায় সাত হাজার কোটি টাকা। ধরে নিয়েছি, তাদের আয় শরিয়তসম্মত পন্থায়ই করবেন এবং ক্যাশ ওয়াকফের অর্থ শরিয়ত অনুমোদিত পন্থায় বিনিয়োগ করবেন। আমি প্রস্তাব করছি, সব ইসলামী ব্যাংক মিলে একটি ক্যাশ ওয়াক্ফ আন্দোলন গড়ে তোলা এবং ক্যাশ ওয়াক্ফের যে বিশাল সম্ভাবনা রয়েছে তা কার্যকর করার জন্য। সবাইকে অনুরোধ করছি তারা যেন ক্যাশ ওয়াক্ফে অংশ নেন।

লেখক : সাবেক সচিব, বাংলাদেশ সরকার

 


আরো সংবাদ



premium cement