২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

প্রাচীন শেরপুর

৯০ বছরের প্রাচীন শেরপুর পৌরসভার ঐতিহ্যবাহী চারু ভবন - ছবি : সংগৃহীত

সে-ই যে ছোটবেলা রূপকথার গল্প শুনেছি মা, খালা, বড় বোনের কাছে! একটু বড় হয়ে রূপকথার কল্পকাহিনীর বই পড়ে নিজেকে রূপকথার অনিন্দ্য সুন্দর রাজকুমারীর জায়গায় কল্পনা করে সুখ আর আনন্দে ভাসতে থাকতাম। এরপর আরো বড় হয়ে বুঝতে পারি যে, রূপকথার সেই কাল্পনিক রাজকুমারী আর আমার মধ্যে কোনোই পার্থক্য নেই।

হ্যাঁ, ঠিক তাই। আল্লাহর অপরিসীম মেহেরবানিতে সব ভাইবোনের জন্ম আমাদের সোনার চামচ মুখে নিয়ে। জ্ঞানে, প্রভাবে, অর্থে, সম্মানে এক নম্বরেই ছিলাম আমরা। শুধু তাই নয়, আমরা ছিলাম ওই এলাকার সবচেয়ে পুরনো। আমরা ছিলাম পাঁচ বোন ও দুই ভাই। আমি শুধু একজনের বড়, এ ছাড়া সকলেরই ছোট। সুতরাং বোনদের মধ্যে আমিই ছিলাম ছোট। আমার ছোট যে, সে হলো ভাই।

আমার দাদার নাম রহমতুল্লাহ বেপারি (‘বেপারি’ শব্দের ব্যাখ্যায় পরে আসছি)। তার বাবা ছিলেন অঢেল সম্পত্তির মালিক। সেই যুগে ‘লাখবাতি’ জ্বালানোর একটা প্রচলন ছিল। সেই সামর্থ্য অবশ্য সবার থাকে না, যা ছিল আমার দাদার বাবার। নিয়মটা হলো, সারা বছরের সকল আর্থিক প্রয়োজন পূরণ করার পর সেই পরিমাণ নগদ অর্থ থাকলে তবেই লাখবাতি জ্বালানোর যোগ্যতা অর্জিত হয়। তার মানে হিসাবটা হলো, বছরের ৩৬৫ দিনই দিনে ও রাতে ২৪ ঘণ্টা অবিরাম জ্বলতে থাকবে এই লাখবাতি। তার জন্য লাগতো মণে মণে ঘি, একটা বিশাল আকারের এবং গভীর সোনার পাত্র। সেই পাত্রে সংযুক্ত করা হতো অনেক মোটা সলতে ঢুকানোর ব্যবস্থা যা ছিল বেশ মোটা এবং বেশ উঁচু বা লম্বা। এখন ওই লম্বা সোনার নলে সলতে ঢুকিয়ে আবার সেই সোনার পাত্রটি ভর্তি করে খাঁটি ঘি ঢেলে দিয়ে, তারপর সলতের মাথায় আগুন লাগিয়ে দেয়া হতো যা একটানা ৩৬৫ দিন লাগাতার বা বিরতিহীন জ্বলতেই থাকবে। যুগের লাখ টাকা, ভাবা যায়!

যাই হোক, ধনাঢ্য এবং প্রভাবশালীদের সাথে থাকত সেখানকার জমিদারের সুগভীর সম্পর্ক। যাওয়া আসা, খানাপিনা, উপঢৌকন বিনিময়সহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানাদিতে এসব লোক সসম্মানে আমন্ত্রিত ও নিমন্ত্রিত হতো। তার লাখবাতি জ্বালানোর ব্যাপারটা জানতে পেরে জমিদার সাহেব লোক পাঠিয়ে তাকে ডেকে নিয়ে তার হাত ধরে বিনীতভাবে অনুরোধ করেন যাতে তিনি লাখবাতি জ্বালানো থেকে বিরত থাকেন। কেননা, তার নিজেরই সামর্থ্য ছিল না এই লাখবাতি জ্বালানোর। সুতরাং তার আত্মসম্মানে লাগে। এই বিশেষ আকুতিভরা অনুরোধক্রমে তার সে ইচ্ছে দমন করেন।

এবার আসা যাক, আমার দাদা রহমতুল্লাহ বেপারি প্রসঙ্গে। দাদার আমলে নৌপথে বাণিজ্য চলত। এক বন্দর থেকে আরেক বন্দর। এভাবে বন্দরে বন্দরে সুবিশাল এবং বিশেষভাবে কারুকাজ খচিত নজরকাড়া নৌকায় তারা বাণিজ্য করে বেড়াতেন।

‘বেপারি’ শব্দের অর্থ জানা দরকার। ‘বেপারি’ শব্দের অর্থ হলো ব্যবসায়ী, বণিক, কারবারি, সওদাগর ইত্যাদি। দাদার কাহিনী শুনতে শুনতে মনে পড়ে যেত ছোটবেলার সিনেমায় দেখা সেই সাহসী নায়কের কথা, যে বাণিজ্য করতে গিয়ে নদীর ঘাটে দেখা পায় অপূর্ব সুন্দরীর। প্রথম দেখাতেই মনে লেগে যায়। এক সময় গেয়ে উঠে,
‘বাণিজ্যের নামেতে আমি এলাম এ কোন হাটে,
কী যে করি বেচা-কিনা মনমাঝির ঘাটে।’
তারপর শুরু হয় সুন্দরী ললনার মন জয় করার কলাকৌশল। আমার দাদারও এমন হয়েছে কিনা তা অবশ্য জানি না।

আমার দাদারা ছিলেন চার ভাই। তাদের ছিল একমাত্র বোন, যার নাম আয়েশা খাতুন। এই আয়েশা খাতুন আবার আমার একমাত্র মায়ের একমাত্র গর্ভধারিণী মা। অর্থাৎ আমার দাদা এবং আমার নানী ছিলেন সহোদর ভাইবোন মানে দাঁড়াল, আমার বাবা-মা হলেন সম্পর্কে আপন মামাতো ফুফাতো ভাইবোন। আমার বাবার নাম মু. জয়নাল আবেদীন। তিনি শৈশবেই পিতৃহারা হন। আমার দাদীর নাম ছিল জয়নব। অত্যন্ত সুশ্রী মহিলা ছিলেন তিনি। তার গর্ভজাত সন্তান ছিল দুইজন। আমার ফুফু এবং আমার বাবা। দাদা বেঁচে থাকতেই দাদীর মৃত্যু হয়। পরে দাদা আবার বিয়ে করেন। এই দাদী দুই মেয়ে ও এক ছেলের জন্ম দেন।

এবার ‘নানা’ প্রসঙ্গ। নানার নাম ছিল মু. কছিমুদ্দিন সরকার। নানীর নাম আয়েশা খাতুন যা আগেই উল্লেখ করেছি। আমার নানা ছিলেন বাপের একমাত্র ছেলে। তবে তার চাচাতো ভাই ছিল কয়েকজন। তার এবং তার ভাইদেরও ছিল অসামান্য সামাজিক মর্যাদা এবং সেই সাথে অর্থনৈতিক অবস্থা ছিল উপরে। তাদের ছিল ঘোড়াশালে ঘোড়া এবং সকলের মতো গোয়ালঘর। এমন, অথচ সম্পত্তি ছাড়াও নানা ছিলেন জমিদারের নায়েব এবং সেই সাথে তৎকালীন বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলা আদালতের জুরির হাকিম। জুরির হাকিম আবার কী? এবার সেই কথাই বলি। কোনো মামলার আসামির বিচারকালে সেই আসামির জন্য কী ধরনের শাস্তি দেয়া যায়, মৃত্যু নাকি আজীবন জেল, তা চূড়ান্তভাবে ফয়সালা করার জন্য আদালতের হাকিম একা দায়িত্ব নিতেন না। এর রায় চূড়ান্ত করার জন্য জুরির হাকিমদের নিয়ে আসার জন্য লোক পাঠানো হতো টমটম গাড়ি দিয়ে। সে যুগে দূর-দূরান্তের যোগাযোগের উত্তম বাহন ছিল ঘোড়ার গাড়ি। যাই হোক, এরকম জুরির হাকিম থাকত একাধিক। এরপর সবাই বৈঠক করে অপরাধীর শাস্তি নির্ধারণ করা হতো। এতক্ষণে নিশ্চয়ই স্পষ্ট হয়ে গেল যে জুরির হাকিম কী?

তৎকালীন গ্রামীণ সমাজে দালানবাড়ি ছিল না। ধনী, মানী ও প্রভাবশালীদের বাড়িঘর ছিল টিনের চোয়ারি। ঘরগুলো ছিল অনেক মস্ত বড় সাইজের। মাটির পিঁড়া হতো বেশ উঁচু। ঘরের খামগুলো এতটাই বিশাল ছিল যে, কারো একার পক্ষে সম্ভব ছিল না দু’হাতে সে খামগুলো জড়িয়ে ধরে। ঘরগুলোতে থাকত পাটাতন। কাঠের সিঁড়ি দিয়ে পাটাতনে ওঠানামা করতে হতো। আর ছিল বিশাল বিশাল লোহার এবং কাঠের সিন্দুক। বহু মূল্যবান দেশীয় গাছের তক্তা দিয়ে তৈরি হতো বিরাট চৌকি। বেঁটে মানুষের পক্ষে সম্ভব হতো না সেসব চৌকিতে কোনো কিছুর সাপোর্ট ছাড়া উঠে। চৌকিগুলো যেমন ছিল বিশালাকারের, তেমনই ছিল সেইরকম মজবুত ও টেকসই। আমার নানার ঘরের চার দিকে ছিল প্রশস্ত বারান্দা। সে বারান্দায় কিছু পরপরই একটি করে ভিন্ন ভিন্ন নামের বাতি জ্বলন্ত অবস্থায় ঝুলন্ত থাকত রাতভর। শহরের মতো সারা রাত গোটা বাড়ি এবং এর চার পাশ থাকত আলো ঝলমল। প্রতিটি বাতিই ছিল ভিন্ন নামের এবং ভিন্ন গড়নের। সব মিলিয়ে একটা অসাধারণ বাড়ি ছিল।

বাড়ির সবাই ছিল উন্নত রুচিসম্মত এবং আধুনিক। গ্রামাঞ্চলে সাধারণত দুটো উঠোন থাকে। তার মধ্যেও আবার পরিবারে থাকত কথাবার্তা বলার জন্য কাচারিঘর। আর নানার তো কাচারিঘর থাকা আবশ্যকও বটে। সেই বাড়িতে থানা থেকে দারোয়ান পুলিশের যখন তখন আসা যাওয়া ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। সেই কাচারিঘরে এসব মেহমানদের আপ্যায়ন করা হতো সাদরে এবং প্রয়োজনীয় কথাবার্তা চলত। অথচ আমি কিন্তু ছোটবেলা থেকেই কোনো পুলিশ দেখলেই ভয়ে হুঁশ থাকত না, এক দৌড়ে পালিয়ে যেতাম।

ভাবতাম যে, পুলিশ মানেই হলো, এরা মানুষ দেখলেই লাঠি দিয়ে বেদম প্রহার করা লোক। শুধু কী তা-ই? পুলিশের ইউনিফর্ম কালারের জামা পড়া কাউকে দেখলেই এক দৌড়ে গিয়ে সোজা চৌকির নিচে ঢুকে পড়তাম। যা বলছিলাম। থানার লোকজন আমার মাসহ সব শিশুর জন্য লোভনীয় হরেক রকমের খাদ্যসামগ্রী নিয়ে হাজির হতেন নানাবাড়িতে। ঘোড়ায় চড়ে দারোগা পুলিশ যাওয়া মাত্র আমার মা খুশিতে টগবগ করে অন্দরমহলে সংবাদ পৌঁছে দিতো। সব ভাইবোনের মধ্যে আমার মা ছিল বেশি বুদ্ধিমতী এবং সাহসী। বাড়ির মধ্যে সংবাদ পৌঁছে দেয়ার মহান দায়িত্ব পালন শেষ করে আবারো চলে যেত দারোগার সামনে প্রাথমিক কাজটি সেরে নিতে। সেটা আবার কী? সেটা হলো, এক লাফে দারোগার কোলে উঠে সবার পক্ষ থেকে খাদ্যসামগ্রী গ্রহণ করা। আর দারোয়ান সাহেবও কী কম? বাড়ি গিয়েই প্রথমে আমার মাকেই ডেকে নেয়া চাই-ই চাই! যখনই ডাক শোনা যাবে... ‘খুকী... তখনই আর হুঁশ থাকত না সেই আদুরে খুকীর।

ঘরের অভ্যন্তরে ছিল কী সব খাট! সেই সুন্দর নামগুলো এখন ভুলেই গেছি। একটার নাম শুধু মনে পড়ে। তা হলো, ‘ক্যাম্পখাট’। আমরা তো আমাদের বাড়িতে পুরনো আসনের মধ্যে শুধু ইজিচেয়ারই দেখেছি, যার বাংলা অর্থ হলো, ‘আরামকেদারা’।


আরো সংবাদ



premium cement