১৯ মার্চ ২০২৪, ০৫ চৈত্র ১৪২৯, ০৮ রমজান ১৪৪৫
`

বাঙালি মুসলমানরা কেন পাকিস্তান চেয়েছিল

বাঙালি মুসলমানরা কেন পাকিস্তান চেয়েছিল - প্রতীকী ছবি

আজ ১৪ আগস্ট। পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবস। কিন্তু ঠিক ৭৬ বছর আগে ১৯৪৭ সালের এ দিনে বাঙালি মুসলমানদের কাছে কি নিছকই ‘পাকিস্তানের স্বাধীনতা’ ছিল? সে দিন কি পূর্ব বাংলার ঘরে-বাইরে, শহরে-বন্দরে, অফিস-আদালতে চাঁদ-তারা খচিত পতাকা পতপত করে ওড়েনি? আমাদের পূর্বপুরুষের ‘লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান’ স্লোগানে কি আকাশ-বাতাস মুখরিত হয়ে ওঠেনি? এমনকি মালদহ-মুর্শিদাবাদসহ বাংলার যেসব জেলা সে দিন পাকিস্তানের পতাকা ওড়ানো সত্ত্বেও পাকিস্তানভুক্ত হতে পারেনি, সেখানে কী আহাজারি-রোনাজারি চলেছে।

কিন্তু বাঙালি মুসলমানরা কেন চেয়েছিল পাকিস্তান? কেনই বা তারা পড়শিদের উপেক্ষা করে হাজার মাইল দূরের মানুষের সাথে মিলে রাষ্ট্র গঠন করেছিলেন? আসুন, প্রত্যক্ষদর্শী মনীষীদের বয়ানে দেখে আসি। প্রখ্যাত সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও রাজনীতিক আবুল মনসুর আহমদ তার ‘আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর’ গ্রন্থের ১২৫ পৃষ্ঠায় দুই শ’ বছরের ব্রিটিশ শাসনামলে বাংলার প্রকৃত আর্থসামাজিক অবস্থা তুলে ধরেছেন এভাবে, ‘বাংলার জমিদার হিন্দু- বাংলার প্রজা মুসলমান, মহাজন হিন্দু-খাতক মুসলমান, উকিল হিন্দু-মক্কেল মুসলমান, ডাক্তার হিন্দু-রোগী মুসলমান, হাকিম হিন্দু-আসামি মুসলমান, খেলোয়াড় হিন্দু-দর্শক মুসলমান, দাতা হিন্দু-ভিক্ষুক মুসলমান, জেলার হিন্দু-কয়েদি মুসলমান, অফিসার হিন্দু-ঝাড়–দার মুসলমান।’

১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর যুদ্ধে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলা পতনের পূর্বপর্যন্ত তৎকালীন মুসলিম শাসকরা একটা উদার ও অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থা বিনির্মাণ করেছিলেন ও টিকিয়ে রেখেছিলেন। কিন্তু পলাশী-উত্তর পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতির দ্রæত পতন ঘটতে থাকে; যত দিন গড়াতে লাগল মুসলিমরা অন্ধকারের অতল গহ্বরে হারিয়ে যেতে লাগলেন। ১৯০৫ সালে লর্ড কার্জন যখন ‘প্রশাসনিক সুবিধার্থে’ বাংলাকে বিভক্ত করে ঢাকাকে রাজধানী করে ‘পূর্ববঙ্গ ও আসাম’ প্রদেশ গঠন করলেন, তখন পূর্ববঙ্গের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের আর্থসামাজিক শোচনীয় অবস্থার পরিবর্তন ঘটবে ভেবে বঙ্গভঙ্গকে ‘বঙ্গমাতার অঙ্গচ্ছেদ’ বলে আখ্যায়িত করে বাংলা প্রদেশকে একটি সুপ্রাচীন ও অবিভক্ত অঞ্চল বলে উদ্দেশ্যমূলক প্রচারণা চালানো হয়।

১৯১১ সালে নবসৃষ্ট ‘পূর্ববঙ্গ ও আসাম’ প্রদেশের অকালমৃত্যুর সাথে সাথে ব্রিটিশ শাসন ও হিন্দু শোষণে নির্যাতিত, নিষ্পেষিত ও নিপীড়িত মুসলমান সম্প্রদায়ের ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়ে যায়। ১৯০৫ সালে যারা বঙ্গভঙ্গকে ‘পাপ কাজ’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন, তারা ১৯৪৭ সালে এসে বাংলাকে বিভক্ত করে একটি হিন্দু অধ্যুষিত প্রদেশ গঠনে সর্বশক্তি নিয়োগ করলেন শুধু সাম্প্রদায়িক মনোবৃত্তির কারণে। মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ বরাবর বাংলার স্বাধীনতার ব্যাপারে আন্তরিক ছিলেন। তার সমর্থন পেয়ে বঙ্গীয় আইনসভার ভোটাভুটিতে মুসলমান ও তফসিলি সদস্যরা অখণ্ড বাংলার শেষ প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও যোগেন মণ্ডলের নেতৃত্বে আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়েছিলেন বাংলাকে অখণ্ড রাখতে এবং স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রে পরিণত করতে। কিন্তু আইনসভার হিন্দু সদস্যরা কংগ্রেস নেতৃত্ব দ্বারা প্রভাবিত হয়ে বাংলাকে খণ্ডিত করে ভারতে যোগদানের পক্ষে রয়ে গেলেন।

তখন একপ্রকার বাধ্য হয়ে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ১৯৪০ সালে তৎকালীন অর্থাৎ অখণ্ড বাংলার প্রথম প্রধানমন্ত্রী শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক কর্তৃক উত্থাপিত ‘লাহোর প্রস্তাব’ সংশোধন করে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলার দাবি পরিত্যাগ করে খণ্ডিত পূর্ব বাংলাকে পাকিস্তানের সাথে জুড়ে দিলেন। ফলে বাঙালিরা হারাল তাদের একক সত্তা, অখণ্ড ভূখণ্ড। কারা বাংলাকে করে ফেললেন খণ্ড খণ্ড?

১৯৪৭ সালে দেশ বিভক্তির সময় অবিভক্ত বাংলার আয়তন ছিল ৭৭ হাজার ৪৪২ বর্গমাইল। ছিল পাঁচটি বিভাগ, ২৮টি জেলা ও ৮৯ হাজার ৫২২টি গ্রাম। বাংলার লোকসংখ্যা ছিল সাত কোটি। তন্মধ্যে মুসলমান শতকরা ৫৪ জন ও বাকি ৪৬ শতাংশ ছিল হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান ও অন্যরা উপজাতীয় সম্প্রদায়ভুক্ত। মোট ২৮টি জেলার মধ্যে ১৬টি জেলা ছিল মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং বাকি ১২টি ছিল হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ।

অখণ্ড বাংলার ৭৭ হাজার ৪৪২ বর্গমাইল এলাকা থেকে নতুন সৃষ্ট পূর্ববঙ্গের ভাগে পড়ে ৫০ হাজার ৩৪১ বর্গমাইল এবং আসামের সিলেট জেলার চার হাজার ৭৮৫ বর্গমাইল। এভাবে প্রায় ৫৬ হাজার বর্গমাইল এলাকা নিয়ে গঠিত হয় পূর্ব বাংলা তথা ১৯৭১ সালে সুদীর্ঘ ২১৪ বছরের সংগ্রাম শেষে পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব অর্জনকারী আমাদের প্রাণের দেশ- বাংলাদেশ। ‘রেডক্লিফ লাইন’ বিভক্ত করেছে একটি প্রদেশ, একটি বিভাগ, একটি জেলা, একটি থানা, একটি গ্রাম, একটি বাড়ি এমনকি একটি ঘরকে; কারণ সীমান্তরেখা কোনো সরেজমিন জরিপ চালিয়ে করা হয়নি। মুসলিম সংখ্যাগুরু হওয়া সত্ত্বেও আমরা হারিয়ে ছিলাম নদীয়া, মালদহ এমনকি বাংলা-বিহার ও উড়িষ্যার রাজধানী মুর্শিদাবাদ, বিনিময়ে পেয়েছি খুলনা ও পার্বত্য চট্টগ্রাম।

’৪৭-এর বঙ্গভঙ্গের কারিগরদের বোধোদয়ের জন্য আমরা অপেক্ষায় রইলাম। আরবিতে একটি প্রসিদ্ধ প্রবাদ রয়েছে, ‘কুল্লু শায়ইন ইয়ারজিউ ইলা আছলিহি’ অর্থাৎ সব কিছুই একসময় তার মূলে ফিরে আসে।

লেখক : সাধারণ সম্পাদক- নবাব স্যার সলিমুল্লাহ একাডেমি
E-mail: syfulislam01799@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement
গাজায় ত্রাণ প্রবেশে ইসরাইলের নিষেধাজ্ঞা যুদ্ধাপরাধের শামিল : জাতিসঙ্ঘ সঙ্গীতশিল্পী খালিদকে বাবা-মায়ের পাশে গোপালগঞ্জে দাফন রাণীনগরে টমটম গাড়ির ধাক্কায় নিহত ১ স্লিপিং ট্যাবলেট খে‌লেও সরকা‌রের ঘুম আসে না : গয়েশ্বর জনসাধারণের পারাপারে গোলাম পরওয়ারের খেয়া নৌকা উপহার ভোলায় হঠাৎ অসুস্থ ২৯ শিক্ষার্থী হাসপাতালে ভর্তি করোনায় ১ জনের মৃত্যু, আক্রান্ত ৩১ ‘অসহায় ও দরিদ্র মানুষের পাশে দাঁড়ানো প্রত্যেকের ঈমানী দায়িত্ব’ নারায়ণগঞ্জের বাজারগুলোতে হঠাৎ পেঁয়াজের দাম অর্ধেকে নামল ‘নবীর শিক্ষা জালিম সরকারের বিরুদ্ধে সত্য কথা বলাই সর্বোত্তম জিহাদ’ আফগানিস্তানের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি সিরিজ স্থগিত অস্ট্রেলিয়ার

সকল