২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

কর্ম সম্পাদনেই প্রকৃত সুখ

কর্ম সম্পাদনেই প্রকৃত সুখ - ফাইল ছবি

‘ভোগে সুখ নেই, কর্মেই প্রকৃত সুখ’ স্কুলজীবনে এ ভাবসম্প্রসারণের অর্থ বুঝিনি, মুখস্থ করতাম শুধু পরীক্ষা পাসের জন্য। ৭১-৮৫ শ্বাসরুদ্ধকর কর্মসম্পাদনের ১৫টি বছর। কোট-টাই পরে এখন ভোগের পালা। ভোগ করতে গিয়ে প্রথমেই মনে পড়ে রবীন্দ্রনাথের পুরস্কার কবিতার কথা। ওই কবিতায় কবিপত্নী সংসারের দুরবস্থা বর্ণনাসহ উপার্জনের পথ বের করতে কবিকে সাজিয়ে গুছিয়ে রাজদরবারে পাঠানোর সময় বলেন, ‘অন্ন জোটে না, কথা জোটে মেলা,/নিশিদিন ধরে এ কি ছেলেখেলা!/ভারতীরে ছাড়ি ধরো এই বেলা/লক্ষ্মীর উপাসনা।’/কবিপত্নীর মতো আমার পত্নীও মনে করিয়ে দিল,/ সংসার বাড়ছে, বাড়ছে খরচ,/যা করার তা করেন- নয় নামবে ধস/দেয়ালে ঠেকে গেছে পিঠ/সুখ আনতে বুলান বিদ্যার পরশ’। যে স্কুলে চাকরি করতাম ওই স্কুলের শিক্ষার্থীরা বিদায় বেলায় সম্মাননা হিসেবে আদালতের কালো ভূষণ উপহার দিয়েছিল। সে কালো ভূষণ পরেই স্বপ্ন পূরণের দায়িত্ব মাথায় নিয়ে ঢাকা কোর্টে প্রবেশ। বুকভরা স্বপ্ন আর আশা নিয়ে কালো কোট গায়ে জড়িয়ে আদালতপাড়ায় পা রেখেই ফের রবীন্দ্রনাথের সেই পুরস্কার কবিতার চরণ, ‘রাজসভাসদ সৈন্য পাহারা/গৃহিণীর মতো নহে তো তাহারা/সারি সারি দ্বারি করে দিশাহারা,/হেথা কি আসিতে আছে!’

ভয়ঙ্কর স্থান আদালতপাড়া। কঠিন শাস্ত্রী-সেপাইবেষ্টিত আদালত প্রাঙ্গণকে প্রাণবন্ত মনে হলো না। বাড়ি বসে কাল্পনিক আদালত আর বাস্তবতা আসমান-জমিন ফারাক। দিশেহারা মনে ঢাকা আইনজীবী সমিতির প্রধান কেরানির সাথে সাক্ষাৎ করে বিস্তারিত বর্ণনাসহ কোর্টের একজন ভালো সিভিল আইনজীবীর সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে অনুরোধ করি। প্রধান কেরানি দয়াবশত নামী এক আইনজীবীর সাথে পরিচয় করিয়ে দেন। তিনি শুধু সিভিল প্র্যাকটিস করতেন। সুড়িটোলা আলুবাজারে ছিল চেম্বার। হেড ক্লার্কের অনুরোধে চেম্বারের ঠিকানা দিতে রাজি হন। রাতে গেলাম সেই চেম্বারে। ৪০০ বর্গফুট পরিমিত চেম্বারের দুদিকে বইয়ের তাক। তাক ভর্তি বই আর বই। মোটা মোটা আইন বই থরে থরে সাজানো। নানা বয়সের চার-পাঁচজন জুনিয়র আইনজীবী, তাদের মধ্যে কেউ লিখছেন, কেউ টাইপ করছেন, কেউ মক্কেলের সাথে কথা বলছেন। সিনিয়র ব্যক্তি ডিকটেশন দিচ্ছেন, তা শুনে এক জুনিয়র খচখচ করে লিখে যাচ্ছেন। লেখালেখির মধ্যে বাংলার নামগন্ধও ছিল না।

যে বিদেশী ভাষাটি শিক্ষাজীবন থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত তাড়িয়ে বেড়ায়, আইনাঙ্গনে এর বহুল ব্যবহার দেখে খুব অসহায় বোধ করি। দুই-তিন রাত সিনিয়রের চেম্বারে আসা-যাওয়ার পর নিরাশ হয়ে নিজে থেকেই বন্ধ হয়ে যায় দেওয়ানি আইনজীবীর জুনিয়রগিরি।

ঢাকা কোর্টে আমাদের গাঁয়ের আরো দু’জন কাজ করত, একজন টাইপিস্ট, আরেকজন উমেদার। পেশা যাই হোক, ড্রাইভিং লাইসেন্স, পাসপোর্ট, কোর্টম্যারেজ থেকে শুরু করে মার্ডার কেস পর্যন্ত সব কাজই করত তারা। আমরা তিনজন মিলে এক খোপ ভাড়া নিলাম।

এক পাশে গর্ত করে চাকার উপর চাকা বসিয়ে সারা বাড়িতে একটি মাত্র পায়খানা। যত ভোরেই ঘুম থেকে উঠি না কেন, নারী-পুরুষের সারি দেখতে পাই। অনেক সময় ভেতরের লোকজনের পায়খানা খালাস হওয়ার আগেই বাইরে লাইনের লোকজন হাঁচি-কাশির শব্দে রেড অ্যালার্ট দিতে শুরু করে। যতক্ষণ বাসায় থাকি ততক্ষণ এসব নিয়ে নারী-পুরুষের ঝগড়া বিবাদ চিৎকার চেঁচামেচির শব্দ কানে আসতেই থাকে।

জানালা, পাখাবিহীন এক দরজাবিশিষ্ট রুদ্ধ ঘরের চৌকিতে পাশাপাশি তিনজন ঘুমোতে শুরু করলেই ছারপোকা ও মশা দলবেঁধে আসতে শুরু করে। টিউবওয়েলে গোসল করতে গেলেও লাইন। লাইন এড়াতে আমরা চলে যেতাম বিশ্বরোডের জলাশয়ে। বিশ্বরোডের উত্তর পাশে এখন যেখানে মজা ডোবা, ঝোপজঙ্গল, বাড়িঘর সেখানে ছিল জলাশয় যেন কাকচক্ষু টলটলে পানি। সেখানে গিয়ে মনের মতো সাঁতার কেটে গোসল করতাম। এক সাথে বহুলোক গোসল করতে নেমে মনে হতো, গ্রামের বাড়ির খাল-নদীতে ডুব সাঁতার কাটছি। আমরা তিনজন কোর্ট-কাচারির লোক হলেও পেশা আলাদা আলাদা। আমাদের মধ্যে মল্লিকের রোজগার ভালো ছিল। সে চাইত খাবারের মান আরো একটু ভালো করে সপ্তাহে দুই-তিন দিন গোশত যোগ করতে। আমরা চাইতাম খাবার তালিকা থেকে গোশত আরো কমিয়ে আনতে। মাস দুয়েক থাকার পর দনিয়ার বাসা ছেড়ে দেই। শুধু গোসল করার আনন্দটুকু ছাড়া আর কোনো সুবিধাই ছিল না।

বাংলা সাহিত্য নিয়ে পড়ার সময় ভাবতাম, আইন পেশা নয় অধ্যাপক হবো; বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপক। এ নিয়ে মতভেদ ছিল সালমার সাথে। অধ্যাপক না আইনজীবী? দু’জনের মধ্যে টসও হয়েছে। সালমা বরাবরই আইনজীবী হওয়ার পক্ষে। অধ্যাপনা পেশা প্রতিষ্ঠার জন্য খোঁজখবর নিতে গিয়ে জানতে পেরেছি, সনাতন পদ্ধতির এমএ উত্তীর্ণ সার্টিফিকেট দিয়ে ভিজিটিং কার্ডের শোভাবর্ধন করা যায়, অধ্যাপনা করা যায় না। অধ্যাপনা করতে হলে সম্মানসহ এমএ উত্তীর্ণ হতে হয়। ইচ্ছায় হোক, অনিচ্ছায় হোক, বহাল থাকে সালমার ইচ্ছাই। ঢাকা কোর্টে আমার নিজস্ব মামলা-মোকদ্দমা ছিল না বললেই চলে। সর্বদা মুহুরি ও তদবিরকারকদের দিকে তাকিয়ে থাকতাম। তাদের কয়েকটা গ্রুপ থানা থেকে কোর্টহাজত পর্যন্ত আসামি ধরার জাল বিছিয়ে রাখত। কোন মামলা কী ধরনের উকিল দিয়ে করাতে হবে, এ ব্যাপারে তারা ছিল সিদ্ধহস্ত। এ কারণে আমার মতো অনেক আইনজীবী তাদের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখত।

সকালে এসে কাজকর্ম আছে কি-না, তাদের কাছে জানতে চাইতাম। এদের মধ্যে হাবিব, ওয়াদুদ, মোসলেম, স্বপন, মুরাদ ও কাদিরের সাথে পরিচয় ছিল। শুদ্ধ বাংলায় সুন্দর করে কথা বলতে পারতাম। তাই, তাদের মধ্যে ছোটখাটো মামলা থাকলে বেলা ১টার দিকে আমার হাতে কাগজপত্র ধরিয়ে দিত। সংশ্লিষ্ট আদালতে গিয়ে মুভ করতাম। জামিন মঞ্জুর হলে তদবিরকারকদের খুঁজে বের করতাম। ওরা নানা কথা বলে পার্টির কাছ থেকে টাকা আদায় করত। টাকা আদায়ে আমিও সাহায্য করতাম। জামিননামায় স্বাক্ষর নেয়ার সময় শ’ পঞ্চাশ টাকা আমার পকেটে পুরে দিত। কত টাকা থেকে ৫০ টাকা দিত, সেটা জানার চেষ্টাও করতাম না।

সামনেই ঈদুল ফিতর। এ রকম পঞ্চাশ পঞ্চাশ করে হাজার টাকা জমিয়েছি। টাকার দোকান থেকে অদলবদল করে নিয়েছি নতুন নোট। ৫০০ টাকার নতুন দু’টি নোট কোটের ব্যাক পকেটে রেখে রওনা হয়েছি বাড়িতে। স্থানীয় হাট থেকে সবার ঈদের জামা-কাপড় এই টাকায়ই হয়ে যাবে।

গুলিস্তান বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে দেখি, মানুষ আর মানুষ। মানুষ বেশি দেখে ভাড়া দ্বিগুণ দাবি করছে বাস কন্ডাক্টর। এ নিয়ে দুই পক্ষই উত্তেজিত। টিকিট না কেটে যাতে কেউ বাসে উঠতে না পারে এ উদ্দেশে কন্ডাক্টর বাসের গেট শক্তভাবে হাত দিয়ে আটকে রেখেছে। যারা দ্বিগুণ ভাড়া গুনতে পারে শুধু তাদের বাসে তোলা হচ্ছে। দ্বিগুণ ভাড়া গুনেই বাসে উঠে ড্রাইভারের পেছনের সিটে বসি। পকেটে টাকা থাকলে কিছুক্ষণ পরপর আপনা-আপনি টাকার কাছে হাত চলে যাওয়া আমার অভ্যাস। বাস যাত্রাবাড়ীর কাছে পৌঁছতেই আমার হাত চলে যায় টাকার কাছে। কোটের ব্যাক পকেটে হাত যেতেই টাকার অস্তিত্ব টের না পেয়ে চমকে উঠি। ব্যাকপকেট ছাড়াও কোটের যে কয়টা পকেট রয়েছে বারবার তল্লাশি করি। তল্লাশি করেও টাকা পাওয়া গেল না। মনে পড়ছে, বাসে উঠার সময় গেট আটকে রাখা কন্ডাক্টরের হাতের চাপ লেগে বুকের দিকে কোটের ব্যাকপকেটটা আগলা হয়েছিল। টাকাটা কোটের কোনো পকেটেই নেই, তা নিশ্চিত হওয়ার পর এই শীতের মাঝেও শরীর থেকে ঘাম বের হতে শুরু করে।


আরো সংবাদ



premium cement