২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

সেতুর নামে রাষ্ট্রীয় অর্থের অপচয়

- ছবি : নয়া দিগন্ত

আমরা কঠিন সময় অতিবাহিত করছি। কোথাও যেন এতটুকু জায়গা নেই যেখানে দাঁড়িয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলা যায়। প্রতিনিয়ত লুটপাট, প্রতারণা, উন্নয়ন প্রকল্পের দুর্নীতি সব সীমা ছাড়িয়ে গেছে। লুটপাটের ভয়াবহ চিত্র নিজ চোখে না দেখলে কারো কাছে বিশ্বাস হবে না। জনগণের স্বার্থের পরিবর্তে একটি গোষ্ঠীর দুর্নীতির স্বার্থে অযথা কিছু সেতু ও কালভার্ট নির্মাণের ঘটনা কয়েকটি পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। কোনো ধরনের যাচাই-বাছাই ছাড়াই কখনো পাহাড়ে, কখনো ধানক্ষেতে, কখনো জলাশয়ে সেতু ও কালভার্ট নির্মাণ করা হলেও কাউকে জবাবদিহি করতে হয় না। ফলে উন্নয়নের নামে অসাধু একটি গোষ্ঠীর পকেট ভারী হচ্ছে।

উন্নয়ন এমনভাবে করা উচিত যেন মানুষের কাজে লাগে! নতুবা এ উন্নয়ন শুধু কাগজ-কলমে থাকবে। কিন্তু জনগণ এর সুফল পাবে না। দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারে জিরো টলারেন্স নীতি আছে। এর বাস্তব প্রয়োগ না থাকায় দুর্নীতি বন্ধ হচ্ছে না। আইনের শাসন থাকলে রাষ্ট্রীয় সম্পদের এমন অপচয় করার সাহস কেউ দেখাত না। রাষ্ট্রীয় সম্পদের এমন অপচয় পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে সম্ভব না হলেও ৫৬ হাজার বর্গমাইলের এই দেশে হচ্ছে, যা রীতিমতো বিস্ময়কর!

রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে সব কিছুই রাষ্ট্রীয় সম্পদ। সেটি একজন গরিব মানুষের জীর্ণ কুটির হোক বা বিত্তবানের অট্টালিকাই হোক। সবই রাষ্ট্রীয় সম্পদ। রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপচয় শুধু সরকারের হয় না। একজন ভিক্ষুক থেকে শুরু করে ধনাঢ্য ব্যক্তিরও হয়। সুতরাং জবাবদিহিতার বিষয়টি নিশ্চিত করা জরুরি। জবাবদিহিতা থাকলে অযথা সেতু কেউ নির্মাণ করত না। আমাদের দেশে প্রকল্প মানেই তো ভাগবাটোয়ারা। কিছু প্রতিষ্ঠান ও ঠিকাদার রডের পরির্বতে বাঁশ দেয়। অথচ ধরা পড়লেও শাস্তির নজির নেই। কারণ কিছু পার্সেন্টেজ এদিক সেদিকও যায়। রাষ্ট্রীয় অর্থের অপচয় দেখে কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদারের কবিতাটি মনে পড়ে গেল। যে জন দিবসে মনের হরষে জ্বালায় মোমের বাতি আশু গৃহে তার দেখিবে না আর নিশীথে প্রদীপ ভাতি। অর্থাৎ মনের ক্ষণস্থীয় আনন্দের জন্য বিলাসিতা করে অর্থ-সম্পদ অপচয় করা উচিত নয়। অপচয় না করলে সাধারণত অভাবও হয় না। অপরের সাহায্য ছাড়াই দুর্দিনে দারিদ্র্যের মোকাবিলা করা যায়। কাঁড়ি কাঁড়ি সম্পদের মালিক যখন নীতিনৈতিকতা ভুলে নিজের সম্পদ অযথা নষ্ট করে বেড়ায় তখন কিন্তু তার সম্পদের গরিমা শেষ হতে সময় লাগে না। স্বাধীনতার ৫০ বছর পেরিয়ে গেলেও দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ গড়ে ওঠেনি। উল্টো দুর্নীতির সেঞ্চুরি হয়েছে। রাষ্ট্রীয় সম্পদের যত অপচয় ও দুর্নীতি হয় তা দিয়ে বাংলাদেশের সমান আরো দু’টি দেশ গড়ে তোলা সম্ভব। এটা অর্থনীতিবিদেরা হিসাব কষে দেখতে পারেন।

উন্নয়নের নামে অপরিকল্পিত সেতু গণতান্ত্রিক দেশের জন্য কল্যাণকর নয়! কিন্তু হরহামেশাই জনবসতিহীন এলাকাকে সংযুক্ত করে কিংবা অপ্রয়োজনে প্রভাবশালীদের বাড়ির কাছে সেতু নির্মাণ করা হয়েছে। নিচে কয়েকটি ঘটনা উল্লেখ করলাম। ঢাকার খিলগাঁওয়ের মান্ডার শেষ মাথা এলাকায় সাড়ে পাঁচ কোটি টাকা ব্যয়ের সেতু, সুনামগঞ্জের ছাতক উপজেলার ভাতগাঁও ইউনিয়নের চেলা খালের উপর তিন কোটি ২৪ লাখ টাকার সেতু ইত্যাদি। অযথা সেতু নির্মাণের ঘটনা নতুন না। এর আগেও অযথা সেতু নির্মাণ করা হয়েছে। ২০১৬ সালের ৩ নভেম্বর প্রথম আলোর পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে যে, তিন হাজার সেতু কোনো কাজে লাগছে না। অনেক সেতুর নির্মাণকাজ এক যুগ পেরিয়ে গেলেও শেষ হচ্ছে না। অসমাপ্ত হয়ে পড়ে আছে। এরকম অসমাপ্ত সেতুর সংখ্যা লিখলে সমাপ্তি টানা যাবে না। স¤প্রতি ৩ সেপ্টেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়ার বনগজ ও কৃষ্ণনগর গ্রামের মধ্যবর্তী খালে ১২০ ফুট দৈর্ঘ্য ও ৮ ফুট প্রস্থের অসমাপ্ত একটি সেতু ইটবোঝাই ট্রলারের ধাক্কায় ভেঙে পড়েছে। ১৯৯৯ সালে উপজেলা পরিষদের রাজস্ব তহবিলের অর্থায়নে সেতুটির নির্মাণকাজ শুরু হয়; কিন্তু সমাপ্ত করা হয়নি। ২২ বছর পেরিয়ে গেলেও সেতুটির কোনো সংযোগ সড়ক স্থাপন করা হয়নি। ফলে সেতুটি কোনো মানুষের কাজে আসছে না। ভেঙে না পড়লে হয়তো আমরাও জানতাম না এখানে সেতু ছিল।

৮ সেপ্টেম্বর নয়া দিগন্তে সম্পাদকীয়তে মুদ্রিত হয়েছে, কোটি টাকার সেতু কাজে আসছে না। এ খবরটি কারো কারো কাছে অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে! কিন্তু অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে, শরীয়তপুর জেলার ভেদরগঞ্জ উপজেলার সখিপুর থানার উত্তর তারাবুনিয়া ইউনিয়নের নমকান্দি গ্রামে ২০১৬-২০১৭ অর্থবর্ষে এক কোটি ৬০ লাখ টাকার বেশি ব্যয়ে সেতুটি নির্মাণ করা হয়। কিন্তু সেতুটির দুই প্রান্তে কোনো সংযোগ সড়ক না থাকায় জনসাধারণ ও স্কুলের কোমলমতি শিশুরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাঁশের সাঁকোর উপর দিয়ে গভীর খাদ পার হচ্ছে।

২৪ আগস্ট প্রথম আলোয় মুদ্রিত হয়েছে যে, কোটি টাকায় অহেতুক সেতু। সাড়ে ছয় কোটি টাকা ব্যয়ে সেতু দু’টি নির্মাণ করেছে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতর (এলজিইডি) ও পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড। বান্দরবানের রুমায় চার কোটি ১৪ লাখ টাকা এবং বান্দরবানের শহরতলির বিক্রিছড়ায় দুই কোটি ৪৩ লাখ টাকার সেতুর নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে; কিন্তু সেতু দু’টি কোনো কাজে আসছে না। কারণ বনজঙ্গলঘেরা ৫০০ ফুট উচ্চতার পাথুরে পাহাড় রয়েছে। চলাচলের জন্য নেই কোনো রাস্তা। নেই কোনো জনবসতি। রাস্তা না থাকা সত্ত্বেও সেতুটি নির্মাণ করা হয়েছে। ফলে সেতুটি মানুষের কাজে আসছে না।

কেউ কেউ সেতুটির উপর ধান ও কাপড় শুকাচ্ছে। এলাকাবাসীর ভাষ্যমতে সরকারি অর্থ আত্মসাতের জন্য কিছু কুচক্রী নির্জন পাহাড়ে অযথা সেতুটি নির্মাণ করেছে। পত্রিকার পাতায় এ খবর প্রকাশিত হওয়ার পর তড়িঘড়ি করে এখন রাস্তা বানানোর নামে অবাধে পাহাড় কাটা হচ্ছে। এমন জগাখিচুড়ি উন্নয়ন প্রকল্প কার স্বার্থে? উন্নয়নের নামে অপরিকল্পিত উন্নয়ন বন্ধ করা প্রয়োজন। অযথা সেতু নির্মাণ করা হয়; কিন্তু প্রয়োজনীয় সেতু কিংবা সড়ক নির্মাণ করা হচ্ছে না। বগুড়ার শেরপুর উপজেলার ৯ কিলোমিটার দীর্ঘ একটি প্রয়োজনীয় সড়ক সংস্কার না হওয়ায় ১৫ গ্রামের হাজারো মানুষ চরম ভোগান্তির শিকার। সুনামগঞ্জের জামালগঞ্জ উপজেলার জামালগঞ্জ-সাচনাবাজার পয়েন্টে সুরমা নদীর উপর একটি সেতু না হওয়ায় দুই শতাধিক গ্রামের মানুষের দুর্ভোগ। এরকম ঘটনা আরো আছে, যা আমরা জানি না। অযথা সেতু নির্মাণ বন্ধ করতে পারলে প্রয়োজনীয় সেতুটি জনগণের কল্যাণের জন্য নির্মাণ করা সহজ হবে। আশা করি সংশ্লিষ্ট মহল এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নেবে।

একটি রাষ্ট্রে যখন আইনের শাসন ভূলণ্ঠিত হয় তখন সেখানে হাজারো অপরাধ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। ফলে শত অপরাধ করেও কেউ পার পেয়ে যায়। আবার অপরাধ না করেও কেউ কেউ বিনাদোষে জেল খাটছে। ক্ষমতার কাছে থাকলে জবাবদিহি কিংবা শাস্তির মুখামুখি হতে হয় না। ফলে দুর্নীতির মাত্রা বাড়ে। কেউ কেউ হয়তো ভাবে পটপরিবর্তন হলেই দুর্নীতি বন্ধ হবে; কিন্তু না। পটপরিবর্তন হলেও দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ গড়ে উঠবে না। যত দিন না সৎ যোগ্য ও খোদাভীরু নেতৃত্ব রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। বিগত এক দশক ধরে উন্নয়নের সাথে দুর্নীতির বিস্তার হলেও প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়নি। ফলে যেখানে সেতু দরকার, সেখানে সেতু নেই। যেখানে দরকার নেই, সেখানে সেতু নির্মাণ করা হয়েছে। অযথা সেতুগুলো কারা তৈরি করেছে। কারা এর পরিকল্পনাকারী। সরকারের উচিত তাদের খুঁজে বের করে শাস্তির বিষয়টি নিশ্চিত করা। সরকার উদ্যোগী ভূমিকা পালন করলে এ প্রবণতা বন্ধ হবে, এমনটিই দেশবাসীর প্রত্যাশা।


আরো সংবাদ



premium cement