অর্থনীতিতে করোনার আঘাত
- নাইম ইসলাম নিবির
- ২২ এপ্রিল ২০২১, ২০:৫৩
করোনা-পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের অর্থনীতির অবস্থান ঠিক রাখা এক দিকে যেমন চ্যালেঞ্জিং, অন্য দিকে কিছুটা টেকনিক্যালও বটে। তবে সার্বিকভাবে বলা যায়, উৎপাদনমুখী এবং শ্রমশক্তি রফতানির মাধ্যমে জাতীয় অর্থনীতির চাকা সচল রাখা অনেকটাই সম্ভব।
বিশ্ব-অর্থনীতিতে করোনার প্রভাব সবাই উপলব্ধি করছে। করোনা-পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের মতো ছোট রাষ্ট্রের জন্য এ প্রভাব কাটিয়ে ওঠা বিরাট চ্যালেঞ্জিং হতে পারে। শিল্প, পরিবহন ও ট্যুরিজম খাত সবচেয়ে বেশি হুমকিতে রয়েছে। সামনের দিনগুলোতেও হয়তো তা কিছুটা রয়ে যাবে। জিডিপিতে পোশাক ও প্রবাসী আয়ের অবদান অক্ষুণ্ন না-ও থাকতে পারে। ইউরোপ, আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশের আর্থসামাজিক ব্যবস্থাপনার ওপর কোভিড-১৯-এর ব্যাপক প্রভাব পড়েছে।
এটা প্রভাব ফেলবে পোশাক শিল্পেও। একই সাথে, দেশে পোশাক খাতগুলোতে সুস্থ পরিবেশ ও সঠিক ব্যবস্থাপনা না থাকলে উৎপাদন ব্যাহত হতে পারে। কর্মহীন হয়ে পড়ছেন অনেক কর্মী। অনেক প্রবাসীও তাদের চাকরি হারিয়েছেন। তাই করোনা-পরবর্তী সময়ে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে জনবহুল দেশগুলোতে খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করা। অনেক দেশ নিজস্ব চাহিদা মেটাতে পণ্য রফতানি কমিয়ে বা বন্ধ করে দিতে পারে। ফলে আমদানি-নির্ভর দেশ ও এলাকাগুলোতে খাদ্যঘাটতি দেখা যে দেবে না, তা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না।
এ অবস্থায় খাদ্যনিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে কৃষি খাত। একটা সময় ছিল যখন আমরা দেশের পাঁচ কোটি মানুষের খাদ্য উৎপাদনেও স্বয়ংসম্পূর্ণ ছিলাম না। আজ তিন গুণের বেশি জনসংখ্যার খাদ্য উৎপাদনে আমরা সফল। করোনা-পরবর্তী সময়গুলোতেও যেন এ ব্যবস্থা অব্যাহত থাকে সে দিকে আমাদের নজর বাড়ানোর পাশাপাশি আরো একটি দিকে লক্ষ রাখতে হবে। করোনার পরবর্তী সময়ে বিশ্ববাজারে শ্রমিকদের প্রচুর ঘাটতি সৃষ্টি হবে। করোনো-পূর্ববর্তী সময়ে কিন্তু আমরা সেটি বুঝতে পেরেছিলাম যার কারণেই মানুষ বিদেশমুখী হয়েছে। ফলে আমরা আজ মিলিয়ন মিলিয়ন রেমিট্যান্স অর্জন করতে পারছি। আর এই শ্রমিকদের রেমিট্যান্সের মাধ্যমেই আমরা এখন পর্যন্ত অর্থনৈতিক চাকা সচল রাখতে পেরেছি। করোনার মাঝেও গত বছর জুলাই মাসে বৈদেশিক খাত থেকে প্রায় ২৬০ কোটি ডলার রেমিট্যান্স আমরা অর্জন করেছি। এক মাসে আগে কখনো এত রেমিট্যান্স অর্জন করিনি। রেকর্ড পরিমাণ রেমিট্যান্সের কারণে ৩০ জুলাই পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বেড়ে তিন হাজার ৭২৯ কোটি ডলার হয়েছিল। বাংলাদেশী মুদ্রায় এর পরিমাণ তিন লাখ ১৬ হাজার ২০৪ কোটি টাকা যা অবশ্যই বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য একটি মাইলফলক। তাই শ্রমশক্তি রফতানিই হতে পারে সঠিক এবং যুগান্তকারী পদক্ষেপ।
বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া করোনা সংক্রমণের প্রথম পর্যায়ে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে যে ক্ষতি হয়েছে, দ্বিতীয় ঢেউয়ের আঘাতে তার চেয়ে বেশি ক্ষতি, তথা অর্থনীতি লণ্ডভণ্ড হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। গত বছর শীত চলে যাওয়ার পর দেশে শুরু হয়েছিল করোনার প্রথম পর্যায়ের আক্রমণ। এ কারণে অন্যান্য দেশের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হলেও বাংলাদেশের অর্থনীতিতে খুব বেশি একটা ক্ষতি হয়নি। তবে করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের আঘাত মোকাবেলা করাটা বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য কিছুটা কঠিন। অর্থনীতি এখন যে অবস্থায় আছে, তার চেয়ে কিছুটা খারাপ তো হবেই।
আর কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউয়ের মাত্রা প্রবল হলে প্রথমবার যেভাবে মৃত্যু হয়েছে, দ্বিতীয় ঢেউয়ে সেভাবে যেন মৃত্যু না হয় অথবা মৃত্যু কমিয়ে আনার জন্য প্রত্যেক দেশে যদি আবারো লকডাউনের মাত্রা দীর্ঘ হয়, তাহলে এর প্রভাবও পড়বে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে। এতে আমাদের অর্থনীতি এখনকার চেয়ে আরো দুর্বল হবে।
তবে এখন পর্যন্ত আমাদের অর্থনৈতিক অবস্থান যতটা দুর্বল হওয়ার আশঙ্কা ছিল, তার চেয়ে অনেক ভালো অবস্থানে আছে। উদ্যোক্তাদের প্রচেষ্টা, শ্রমজীবী মানুষের পরিশ্রম ও সরকারের সহযোগিতা- এই তিন কারণে অর্থনীতির চাকা স্বাভাবিক সময়ের চেয়েও জোরে ঘুরছে। এ ক্ষেত্রে সাহস জোগাচ্ছে গার্মেন্ট শ্রমিকদের কষ্টের বিনিময়ে অর্জিত রফতানি আয় এবং প্রবাসী শ্রমিকদের পাঠানো রেমিট্যান্স। এই রেমিট্যান্স ও রফতানি আয় বাড়ার সুফল অর্থনীতির অন্যান্য খাতের সুবিধাভোগীরাও পাচ্ছেন। রেমিট্যান্স বাড়ার কারণে গ্রামীণ অর্থনীতি চাঙ্গা রয়েছে। সঞ্চয়পত্র বিক্রি বেড়েছে। ব্যাংকের আমানতও বাড়ছে। দীর্ঘ দিনের মন্দায় থাকা পুঁজিবাজারেও প্রাণ ফিরে এসেছে। গলির দোকান থেকে শুরু করে বড় শিল্পকারখানা, সবই চলছে আগের মতো। আমদানি-রফতানি, উৎপাদন, সরবরাহ, বিপণন, উন্নয়ন ও পরিবহন চলাচল স্বাভাবিক সময়ের মতোই সচল রয়েছ। তাই কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউ ফুলে ওঠার আগেই আমাদেরকে এই সেক্টরগুলোর প্রতি নজর বাড়াতে হবে এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
করোনাভাইরাস শুধু স্বাস্থ্যঝুঁকি আর মৃত্যুর মিছিলই নয়, বিশ্বের অর্থনীতিকেও নাড়িয়ে দিয়েছে। ফলে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমে গিয়েছে। দেশে-বিদেশে অসংখ্য মানুষ চাকরি হারিয়েছে। করোনাভাইরাস আতঙ্কে একের পর এক নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে ফেলছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ যার প্রভাব সব খাতকেই কম-বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করে দিয়েছে। তবে আমাদের প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার অত্যন্ত দূরদর্শিতা এবং সময়োপযোগী সিদ্ধান্তের কারণে এই ক্ষতি আমরা কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হচ্ছি।
বাংলাদেশে রফতানি আয় এমনিতেই পড়তির দিকে। গত জুলাই থেকে এই এপ্রিল পর্যন্ত প্রবৃদ্ধি কমেছে ৪.৭৯ ভাগ। অব্যাহতভাবে কমছে পোশাক রফতানি। ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্র আমাদের পোশাক রফতানির প্রধান বাজার। কিন্তু করোনাভাইরাসের কারণে সেখানকার বাজারগুলোতে প্রভাব পড়েছে। ইতালিতে মানুষ ঘর থেকেই বের হতে পারছিল না। অথচ ২০১৯ সালেও ইতালি থেকে বাংলাদেশ ১৪৩ কোটি ডলারের পোশাক রফতানি করেছিল; কিন্তু করোনার কারণে ধীরে ধীরে একই পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে গোটা ইউরোপে, এমনকি যুক্তরাষ্ট্রেও। বাংলাদেশের পোশাক রফতানির ৬২ শতাংশ আয় আসে ইউরোপ থেকে আর ১৮ শতাংশ আসে যুক্তরাষ্ট্র থেকে।
কিন্তু যদি করোনা ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়ে, তাহলে পোশাকের চাহিদা অনেক কমে যাবে। মানুষ ঘর থেকে বের হতে না পারার কারণে পোশাক ক্রয় করা এবং শপিংমলে যাওয়া তেমন সম্ভব হবে না। যেসব দেশ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত সেখানে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড কমে গেছে। সেখানে বসবাসরত বাংলাদেশী শ্রমিক বা ব্যবসায়ীরা প্রয়োজনমতো আয় করতে না পারলে দেশে পরিবারের কাছে আগের মতো টাকা পাঠাতে পারবে না। তাই স্বভাবতই রেমিট্যান্স কমতে থাকবে। এর প্রভাব পড়বে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে।
বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রধান দুই চালিকাশক্তি হলো- রফতানি ও রেমিট্যান্স। রফতানি আয় কমে গেলে দেশের শিল্প কারখানাগুলোতে শ্রমিকদের আয় কমে যাবে বা কর্মসংস্থানের অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হবে। অন্য দিকে প্রবাসীদের টাকা পাঠানো কমে গেলে তাদের পরিবার দেশে আগের মতো খরচ করতে পারবে না। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে ব্যবসাবাণিজ্যে। চাহিদা কমে গেলে ভোক্তা পণ্য প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো পড়বে ক্ষতির মুখে।
বাংলাদেশেও করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব প্রবল আকারে দেখা দিলে অর্থনীতির গতি ধীর হয়ে যাবে। সব মিলিয়ে আগামী দিনে জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য পূরণ বড় চ্যালেঞ্জ হবে আমাদের জন্য। তাই এই মুহূর্তে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি এবং কৃষি ব্যবস্থার দিকে গুরুত্বারোপ করাতে হবে।
লেখক : কেন্দ্রীয় নির্বাহী সদস্য, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ
ইয়ুথ লিডার, ইন্টারন্যাশনাল গ্লোবাল নেটওয়ার্ক
nayemulislamnayem148@gmail.com
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা