২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

৭ নভেম্বরে যা ঘটেছিল

৭ নভেম্বরে যা ঘটেছিল - ছবি : সংগৃহীত

ঐতিহাসিক ৭ নভেম্বর ’৭৫ ‘জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস’ নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণে প্রকৃত ঘটনা আড়াল করে রাজনৈতিক বক্তব্য দেয়ার মাধ্যমে নিজ নিজ বিবরণ তুলে ধরা হচ্ছে। এর দরুন ৭ নভেম্বরের তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনাবলির প্রকৃত ইতিহাস কুয়াশাছন্ন থেকে যাচ্ছে। হেন প্রেক্ষাপটে নিরপেক্ষতা বজায় রেখে ওই দিনের ঘটনার যথার্থ বিবরণ সংক্ষেপে দেয়া হলো- ১. ১৯৭৫ সালে ১৫ আগস্টের সামরিক অভ্যুত্থানের মর্মান্তিক ঘটনার প্রেক্ষাপটে ওই দিনই আওয়ামী লীগের প্রথম সারির নেতা খন্দকার মোশতাক আহমদ প্রেসিডেন্ট হিসেবে ক্ষমতাসীন হয়ে বাকশাল ও রক্ষীবাহিনী বিলুপ্তিসহ অনেক কিছুর পরিবর্তন ঘটান। জাতীয় পর্যায়ে উল্লিখিত শাসন ব্যবস্থার পরিবর্তনের পক্ষে-বিপক্ষে অবস্থান ও মতামত থাকবে- এটাই স্বাভাবিক।

কিন্তু বাস্তবতা হলো, তদানীন্তন সরকার সংসদের বিলুপ্তি ঘটায়নি এবং আওয়ামী লীগের বেশির ভাগ মন্ত্রীকে নিয়েই মোশতাক কেবিনেট বজায় রাখতে সক্ষম হন। তবে উল্লেখযোগ্য জাতীয় চার নেতা যেমন- সৈয়দ নজরুল ইসলাম; যারা মোশতাক সরকারের সাথে একাত্ম হতে রাজি হননি তারা ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে অন্তরীণ ছিলেন। মোশতাক ৮৩ দিন ক্ষমতাসীন থাকাবস্থায় ১৯৭৭ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিন-তারিখ উল্লেখ করে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন এবং ইতঃপূর্বে সব রাজনৈতিক দলের কর্মকাণ্ড চলমান রাখারও ঘোষণা দেন। বাস্তবিক পক্ষে ১৫ আগস্টের সেনাঅভ্যুত্থানে যেসব সামরিক অফিসার জড়িত ছিলেন তারা সংখ্যার দিক দিয়ে খুব একটি বড় ছিলেন না। খন্দকার মোশতাক সরকারের ডিফেন্স অ্যাডভাইজার ছিলেন মুজিবনগর সরকারের প্রধান সেনাপতি জেনারেল আতাউল গণি ওসমানী। ১৫ আগস্ট জিয়াউর রহমান ছিলেন ডেপুটি চিফ অব স্টাফ। সাত দিন পর ২২ আগস্ট জিয়াউর রহমান চিফ অব স্টাফ অর্থাৎ সেনাপতি হিসেবে নিয়োগ পান।

২. ব্রিগেডিয়ার জেনারেল খালেদ মোশাররফ ঢাকা সেনানিবাসে গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকাবস্থায় ১৫ আগস্টের জড়িত সেনাকর্মকর্তাদের চেইন অব কমান্ড ভঙ্গের অভিযোগে ২ নভেম্বর ৭৫ রাত ৯টা-১০টার দিকে ঢাকা সেনানিবাসে সেনাঅভ্যুত্থান ঘটিয়ে সেনাপতি মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে গৃহবন্দী করে ক্যান্টনমেন্টের সর্বময় ক্ষমতা দখল করে নেন। কিন্তু বঙ্গভবনের মোশতাক সরকারের পতন ঘটাতে পারেননি। পারেননি বঙ্গভবনে প্রহরারত ফারুক-রশিদের ট্যাংক বাহিনী নিয়ন্ত্রণে আনতে, যার দরুন বঙ্গভবনে অবস্থান করা ১৫ আগস্টের সেনাকর্মকর্তাদের সাথে রক্তপাত এড়াতে ওই দিন রাতেই খালেদ একটি চুক্তিতে উপনীত হয়ে বিনারক্তপাতে তাদের দেশত্যাগ এবং মোশতাককে প্রেসিডেন্ট হিসেবে মেনে নিতে রাজি হন।

অবস্থার ওই পর্যায়ের মধ্যেই ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে জাতীয় চার নেতা রাতের অন্ধকারে কিছু সেনাকর্মকর্তা দ্বারা নিহত হন। পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি ঘটার পর্যায়ে অভ্যুত্থানের নায়ক খালেদ মোশাররফ মেজর জেনারেল এবং সেনাপতি হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার জন্য তার অনুসারীর মাধ্যমে লিখিতভাবে প্রেসিডেন্ট মোশতাকের কাছে পাঠালে তাতে তিনি ‘প্রেসিডেন্টের দায়িত্বে নেই’ মর্মে স্বাক্ষর দিতে অসম্মতি জানালে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল খালেদ মোশাররফ নিজেই চেইন অব কমান্ড ভঙ্গ করে ৫ নভেম্বর ’৭৫ সালে নিজেকে মেজর জেনারেল ও সেনাপতি হিসেবে ঘোষণা দেন। সেই লগ্নে বিমানবাহিনী প্রধান এম জি তোয়াব তাকে সেনাপতির ব্যাজ পরান। ওই ৫ নভেম্বর খন্দকার মোশতাক আহমদ পদত্যাগ করে প্রধান বিচারপতি এ এস এম সায়েমকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে নিয়োগ দেন।

তখনো খন্দকার মোশতাক এবং তার ডিফেন্স অ্যাডভাইজার এম এ জি ওসমানীসহ কিছু মন্ত্রী বঙ্গভবনেই অবস্থান করছিলেন। মূলত খালেদ মোশাররফের সামরিক অভ্যুত্থান ছিল ১৫ আগস্টের সেনাকর্মকর্তাদের এবং তদানীন্তন সরকারের বিরুদ্ধে। জাতীয় চার নেতার নির্মম হত্যাকাণ্ড খালেদ মোশাররফের অভ্যুত্থানকে সঙ্কট সঙ্কুল অবস্থার মধ্যে ফেলে দেয়। অপর দিকে ১৫ আগস্টের অভ্যুত্থানের সেনাকর্মকর্তাদের দেশত্যাগ প্রেসিডেন্ট মোশতাকের অবস্থানকেও সঙ্কটাপন্ন করে তোলে।

৩. রাজনৈতিক ওই সঙ্কট অবস্থায় ২ নভেম্বর থেকে ৬ নভেম্বর ’৭৫ পর্যন্ত দৃশ্যমান কোনো সরকারের অবস্থান দেশে ছিল না। দেশের পরিস্থিতির এমন প্রেক্ষাপটে সেক্টর কমান্ডার এবং রাজনীতিতে বিশ্বাসী অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল তাহেরের জাসদ সমর্থিত গণবাহিনী পরিকল্পিতভাবে ঢাকা সেনানিবাসে সিপাহিদের সমন্বয়ে আরেক সেনা অভ্যুত্থান ঘটায় ৬ আগস্ট ’৭৫ রাত ১২টা এক মিনিটে অর্থাৎ ৭ নভেম্বরের ঊষালগ্নে। কর্নেল তাহেরের সমর্থক সিপাহিদের সমন্বয়ে গণবাহিনীর অভ্যুত্থান ছিল খালেদ মোশাররফের ক্ষমতা দখলের বিরুদ্ধে পাল্টা ও বামপন্থী সামরিক অভ্যুত্থান। কর্নেল তাহেরের উত্থান জিয়াউর রহমান ৭ নভেম্বর ভোরে মুক্ত না হওয়া পর্যন্ত সফলতা পেয়ে যায়। গভীর রাতে তাহেরের গণবাহিনীর স্লোগান ছিল ‘সিপাহি সিপাহি ভাই ভাই, সুবেদারদের ওপর অফিসার নাই’ এবং ভারত-বিরোধী লিফলেট ছড়ানো হয়। ওই স্লোগানের ধারাবাহিকতায় সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের রক্তগঙ্গা বয়ে যাওয়াই স্বাভাবিক। ওই রাতেই ২৫-২৬ জন সেনাকর্মকর্তা ও তাদের অনেকের পরিবার নির্মম হত্যার শিকার হন। সারা রাত কর্নেল তাহেরের দখলে ছিল ঢাকা সেনানিবাস। খালেদ মোশাররফের পক্ষের শক্তিশালী অবস্থান পরিলক্ষিত হয়নি।

৭ নভেম্বর অতি প্রত্যুষে উৎসবরত কর্নেল তাহেরের অনুসারী গণবাহিনীর লোকজন জিয়ার বাসভবনে তাকে উদ্ধারের জন্য গিয়ে জিয়াকে পায়নি। ইতঃপূর্বে চতুর্থ বেঙ্গলের ব্রিগেডিয়ার আমীনের নির্দেশে তার বাহিনী জিয়াউর রহমানকে তার নিরাপত্তা এবং সেনাপতির দায়িত্ব পালনের জন্য উদ্ধার করে নিয়ে আসে। কর্নেল তাহের তাৎক্ষণিকভাবে তা জানতে পারেন। তার কিছু অনুসারী নিয়ে ব্রিগেডিয়ার আমীনের অফিসে গিয়ে কর্নেল তাহেরের নিয়ন্ত্রণে জিয়াকে পাওয়ার জন্য, রেডিও অফিসে গিয়ে জিয়াউর রহমান জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেয়ার জন্য এক ফাঁদ পাতা হলো। কেননা সৈনিকদের মধ্যে জিয়ার জনপ্রিয়তা তাহেরের ক্ষমতা গ্রহণের পথে একমাত্র বাধা। জিয়ার উপস্থিত বুদ্ধির কারণে ব্রিগেডিয়ার আমীনকে নির্দেশ দেয়ার মাধ্যমে তার হস্তক্ষেপে জিয়াউর রহমান এ যাত্রা রক্ষা পান এবং কর্নেল তাহের আমীনের অফিস ত্যাগ করতে বাধ্য হন। জিয়াউর রহমানকে কর্নেল তাহেরের নাগালের মধ্যে আনতে পারলেই তাহেরের অভ্যুত্থান নিশ্চিতভাবেই সফল হয়ে যেত। ইতোমধ্যে খালেদ মোশাররফ তার অভ্যুত্থানের সহযোদ্ধা কর্নেল হায়দার, কর্নেল হুদাকে নিয়ে পালিয়ে যান এবং কর্নেল তাহেরের অনুসারী সিপাহিদের হাতে সংসদ ভবনে অস্থায়ীভাবে অবস্থানরত দশম বেঙ্গলের মেসে নির্মমভাবে নিহত হন।

৪. জিয়াউর রহমান গৃহবন্দিত্ব থেকে মুক্ত হওয়ার পর এবং ব্রিগেডিয়ার আমীনের অফিসে অবস্থানের পর্যায়ে, জিয়ার অনুসারী সেনাকর্মকর্তা সিপাহিরা ঢাকা সেনানিবাসের নিয়ন্ত্রণ ফিরে পেয়ে রাজপথে সিপাহি-জনতা উল্লাস করে গগণবিদারী ‘নারায়ে তাকবির আল্লাহু আকবর’ স্লোগান দিতে থাকেন। ঢাকার রাজপথে নেমে আসে ট্যাংক। বঙ্গভবনে অবস্থানরত এবং সেনানিবাসের ট্যাংকে জিয়ার ছবিসহ লাখো জনতার মিছিল যেন দেশ এক অপশক্তির হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে। জিয়া মুক্ত হয়ে সেনাপতির দায়িত্ব গ্রহণের মাধ্যমেই গণবাহিনীর নির্মম হত্যাকাণ্ডও তাৎক্ষণিকভাবেই থেমে যায়। থেমে যায় গণবাহিনীর উল্লাস। কিন্তু কর্নেল তাহের তখনো পরাজয় মানার মতো কাপুরুষ ছিলেন না। ৭ নভেম্বরের ঘটনাপ্রবাহ খন্দকার মোশতাককে পুনরায় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ফিরে পাওয়ার সুযোগ এনে দেয়। প্রারম্ভিক পর্যায়ে কর্নেল তাহের বিরোধিতা করলেও পরে তার শক্তি নিঃশেষ হয়ে যায়।

৫. ৭ নভেম্বরে সিপাহি-জনতার বিপ্লব জিয়াউর রহমানকে মূল ক্ষমতায় বসাতে পারেনি। গভীর সঙ্কটময় পর্যায়ে মোশতাক পুনঃক্ষমতা চালিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দেন তার নিয়োগ দেয়া প্রধান বিচারপতিকে। খন্দকার মোশতাক ৭ নভেম্বর জাতির উদ্দেশে বিদায়ী ভাষণ দিয়ে ১৯৭৭ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারিতে সংসদ নির্বাচনের দিনক্ষণ পুনর্ব্যক্ত করেন। কর্নেল তাহের জাতীয় সরকারের নাম করে ওই সরকারের প্রধান জিয়াউর রহমানের নামে ঢাকার রাজপথে লিফলেট বিতরণ করেন। এভাবে জিয়াউর রহমানকে জাতীয় সরকারের শপথ অনুষ্ঠানের গভীর চক্রান্ত করার পর্যায়ে বঙ্গভবন থেকে মোশতাকের হস্তক্ষেপে জিয়াউর রহমান সেই চক্রান্ত থেকে বেঁচে যান। পরে ৭ নভেম্বরের সিপাহি-জনতার বিপ্লবের নায়ক সেনাপতি জিয়াউর রহমান ১৯৭৬ সালে বিচারপতি প্রেসিডেন্ট সায়েমকে ক্ষমতাচ্যুত করে ক্ষমতায় এসে ১৯৭৭ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারির মোশতাকের প্রতিশ্রুত নির্বাচনের দিনক্ষণ বাতিল এবং খন্দকার মোশতাককে গ্রেফতার করে জেলে নিক্ষেপ করেন।

৬. ৭ নভেম্বর খন্দকার মোশতাক জাতির উদ্দেশে বিদায়ী ভাষণ দিয়ে বঙ্গভবন ত্যাগ করে তার বাসভবন আগামসিহ লেনে চলে যান। পরের দিন ৮ নভেম্বর ’৭৫ বিচারপতি প্রেসিডেন্ট সায়েম কর্তৃক জাতির উদ্দেশে ভাষণের সারসংক্ষেপ- I have agreed to continue to carry the resposibility of the Presidentship at the specific request of Khandakar Moshtaque Ahmad despite the facts that there was spontaneous demand for his resumption of the office. ওই ভাষণ ৮ নভেম্বর বাংলাদেশ গেজেটে লিপিবদ্ধ আছে।

৭. জিয়াউর রহমানের শাসনামলে ‘৭ নভেম্বর জাতীয় বিপ্লব এবং সংহতি দিবস’ হিসেবে মহিমান্বিত হতে থাকে, যার ধারাবাহিকতায় এরশাদের শাসনামলে তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। বিএনপির কাছে ঐতিহাসিক এ দিবসটি জাতীয় বিপ্লব দিবস ও প্রাণের স্পন্দন, আওয়ামী লীগের জন্য দিবসটি তার বিপরীতে কালো দিবস; জাসদের কাছে ঐতিহাসিক এই দিবসটি তাদের উত্থান-পতনের এক বর্ম, যা বাম রাজনীতির যবনিকাপাত ঘটায়ে দিবসটির সূচনা পর্যায়ের নায়ক কর্নেল তাহেরের পতন ও ধ্বংস ডেকে আনে। কিন্তু ওই দিবসটি সেনা অভ্যুত্থান দিবস হিসেবে পালন দলের নেতাকর্মীদের এবং বাম রাজনীতির পরাজয়ের গ্লানি থেকে রক্ষা পাওয়ার এক সান্ত্বনার কৌশল মাত্র।

লেখক : ব্রাহ্মণবাড়িয়া বারের সিনিয়র অ্যাডভোকেট


আরো সংবাদ



premium cement