০৫ মে ২০২৪, ২২ বৈশাখ ১৪৩১, ২৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`


প্রজাশূন্য রাজা বনাম করের জাল বিস্তার

বা জে ট
-

কোনো এক দেশের রাজা তার উজির-নাজিরদের পরামর্শে প্রজাদের ওপর বছরের পর বছর বাড়তি করের বোঝা চাপিয়ে দিচ্ছিলেন। একপর্যায়ে প্রজাদের ওপর করের বোঝা এমন পর্যায়ে এলো যে, প্রজাদের দেশে থাকতে হলে আয়ের বেশির ভাগ অংশ ট্যাক্স দিতে হবে। না হয় দেশ ছেড়ে পালাতে হবে। অগত্যা কর পরিশোধ করতে না পেরে একে একে প্রজারা পালাতে লাগলেন প্রতিবেশী দেশে। এ সুযোগটি কাজে লাগাল প্রতিবেশী রাজা। তিনি যখন দেখলেন, প্রতিবেশী দেশ থেকে প্রজাশূন্য হচ্ছে, তখন দেশ দখলের জন্য হামলা করলেন। প্রতিবেশী দেশ থেকে যখন হামলা করা হলো, তখন শত্রুপক্ষের হামলা প্রতিরোধ করার জন্য পর্যাপ্ত প্রজা ছিল না। ফলে জুলুমবাজ রাজা পরাজিত হলেন। দেশ যখন দখল হয়ে গেল, তখন শুধু প্রজাদের ওপর বাড়তি করের বোঝা চাপানোর মতো অন্যয় সিদ্ধান্তের জন্য অনুশোচনা করা ছাড়া ওই রাজার আর কিছুই করার ছিল না।
আগামী অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের ওপর লিখতে গিয়ে উপরি উক্ত গল্পটি অবতারণা নিয়ে হয়তো অনেকেই ভাবতে পারেন, বাজেটের সাথে শেখসাদীর এ গল্প টানার কোনো যৌক্তিকতা আছে কি না। যৌক্তিকতা আছে কি না, তা বস্ত্র খাতের বড় একটি সংগঠনের সাংবাদ সম্মেলনের কিছু লাইন টানলে সহজেই বোঝা যাবে। গত মঙ্গলবার হোটেল সোনারগাঁওয়ে আগামী অর্থবছরের বাজেটের ওপর আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশন। সংগঠনটির প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ আলী খোকন বলেন, বস্ত্রখাতের প্রধান কাঁচামাল সুতা উৎপাদনে পাঁচ শতাংশ ভ্যাট আরোপের প্রস্তাব করা হয়েছে আগামী অর্থবছরের বাজেটে। ওই প্রস্তাব শেষ পর্যন্ত বাস্তবায়ন হলে প্রতি কেজি সুতায় অন্তত ২৪ টাকা ভ্যাট দিতে হবে। এত বেশি দাম দিয়ে কোনো কাপড়ের কল বা তাঁতি স্থানীয় সুতা কিনতে রাজি হবেন না। এতে মিলগুলোতে অবিক্রিত সুতার স্তূপ বাড়বে। দীর্ঘ দিন ধরে বৈধ-অবৈধ পথে আসা বিদেশী সুতা-কাপড়ের কাছে মার খাওয়া দেশী বস্ত্র খাত এবার বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কার মুখে পড়বে। ফলে আবারো সুতা-কাপড়ে আমদানিনির্ভর হয়ে পড়বে দেশ।
একাধিক মিল মালিকের সাথে আলাপকালে জানা গেছে, প্রতি কেজি সুতায় বর্তমান তিন থেকে চার টাকা ভ্যাট দিতে হয়। আর সরকারের ট্যাক্স পরিশোধ করার পর প্রতি কেজি সুতায় বড়জোর লাভ হয় দুই থেকে তিন টাকা। এখন এক সাথে ২৪ টাকা ভ্যাট পরিশোধ করতে হলে হয় শিল্পমালিকদের কলকারখানা ফেলে রেখে দেশ ছেড়ে পালাতে হবে, না হয় টেক্সটাইল মিল চালাতে হলে বাড়িঘর বিক্রি করে সরকারের ভ্যাট পরিশোধ করতে হবে।
জাতীয় সংসদে গত ১৩ জুন আগামী অর্থবছরের (২০১৯-২০) পাঁচ লাখ ২৩ হাজার ১৯০ কোটি টাকার বিশাল বাজেট পেশ করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এর মধ্যে প্রায় তিন লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকা জনগণের কাছ থেকে কর আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এ বিশাল কর আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটে ভ্যাটের জাল ব্যাপকভাবে বিস্তৃত করা হয়েছে। প্রায় সব ক্ষেত্রেই করারোপ করা হয়েছে। মোবাইলে প্রয়োজনীয় কথা বলতে ১০০ টাকা রিচার্জ করলে নানা করের নামে ২৭ টাকা কেটে রাখা হবে। নানা খাতে করের জাল বিস্তৃত হওয়ায় এতেই আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন ব্যবসায়ীরা। ব্যবসায়ীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ভ্যাট আইন সংশোধন করা হলেও ভ্যাটের আওতা কমানো হয়নি, বরং প্রকারান্তরে বাড়ানো হয়েছে। নতুন আইনে আগে অব্যাহতিপ্রাপ্ত বিভিন্ন সেবা ও পণ্যকে যেমন এর আওতায় আনা হয়েছে, তেমনি অনেক খাতে ভ্যাটের হার বাড়ানো হয়েছে। নতুন করে শতাধিক পণ্যে ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে। নিচের তিন স্তরের ভ্যাট হারের ক্ষেত্রে ভিত্তিমূল্য প্রত্যাহার বা আগে পরিশোধিত ভ্যাট সমন্বয়ের সুযোগ রহিত করার কারণে কার্যকর ভ্যাটের পরিমাণ অনেক বাড়বে। কোনো কোনো পণ্যের ভ্যাটের পরিমাণ কয়েক গুণ বেড়ে যাবে। এর ফলে দেশীয় শিল্প মুখ থুবড়ে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন ব্যবসায়ীরা।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ব্যবসায়ীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ভ্যাট আইন সংশোধন করা হলেও ভ্যাটের আওতা কমানো হয়নি, বরং প্রকারান্তরে বাড়ানো হয়েছে। আগে অভিন্ন একটি স্তর অর্থাৎ, ১৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে স্তর করা হয়েছ চারটি। যথাÑ ৫, সাড়ে ৭, ১০ ও ১৫। ওই কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ভ্যাট আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা বাড়ানো হয়েছে। আর এ বর্ধিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য নতুন আইনে বিভিন্ন সেবা ও পণ্যকে যেমন এর আওতায় আনা হয়েছে, তেমনি অনেক খাতে ভ্যাটের হার বাড়ানো হয়েছে। আবার ১৫ শতাংশ হারে যারা ভ্যাট দিত, তাদের বিভিন্ন খাতে কর রেয়াত সুবিধা ছিল। কিন্তু এখন ১৫ শতাংশের নিচে অর্থাৎ অন্য তিনটি স্তরে যারা ভ্যাট দেবেন, তারা অনেক ক্ষেত্রেই কর রেয়াত সুবিধা পাবেন না। এ পদ্ধতি প্র্রকারান্তরে আবগারি প্রথা চালু করার শামিল, যা ভ্যাট আইনের পরিপন্থী। কেননা এতে একই মূল্যের ওপর বারবার কর দিতে হবে। প্রস্তাবিত ব্যবস্থায় এক পক্ষ রেয়াত পাবেন, অন্য পক্ষ রেয়াত পাবেন না। একই আইনে দুই পদ্ধতি চালু করায় ট্যাক্স অন ট্যাক্স বা করের ওপর কর (দ্বৈত কর) আরোপ করা হবে। বর্তমানে এসব পণ্যে ট্যারিফ ভ্যালু (নির্ধারিত) ভিত্তিতে এবং যতটুকু মূল্য সংযোজন হয়, তার ওপর (সঙ্কুচিত) ভিত্তি করে বিশেষ ছাড় দিয়ে ভ্যাট আহরণ করা হয়। নতুন আইনে প্রচলিত প্রথা উঠিয়ে দিয়ে তার পরিবর্তে বাজার মূল্যের ওপর উল্লিখিত হারে ভ্যাট আহরণের প্রস্তাব করা হয়। নতুন আইনে ভ্যাটমুক্ত সীমা বার্ষিক ৫০ লাখ টাকা নির্ধারণ করা হয়। ৫০ লাখ এক টাকা থেকে তিন কোটি টাকা পর্যন্ত ব্যবসায়ীদের ৪ শতাংশ হারে টার্নওভার কর দিতে হবে।
এ দিকে আগামী অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটে শতাধিক পণ্য ও সেবার ওপর নতুন করে ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে। একই সাথে আরো শতাধিক পণ্যের ওপর বিদ্যমান ভ্যাট বাড়ানো হয়েছে। নতুন ভ্যাট আইনের আওতায় আসায় এসব পণ্য ও সেবার দাম বেড়ে যাবে। আগামী ১ জুলাই থেকে এ আইন বাস্তবায়ন করা হবে।
পুরনো ভ্যাট আইনে এলপি গ্যাস, গুঁড়ো দুধ, গুঁড়ো মসলা, টমেটো কেচাপ, চাটনি, ফলের জুস, টয়লেট টিস্যু, টিউবলাইট, চশমার ফ্রেমসহ নিত্যব্যবহার্য ৮৬টি পণ্যের ওপর ট্যারিফ মূল্য বহাল ছিল। আগামী অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত নতুন আইনে উৎপাদন পর্যায়ে এসব পণ্যে ট্যারিফ মূল্যের পরিবর্তে ৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে। এ কারণে এসব পণ্যের দাম বেড়ে যাবে।
ব্যবসায়ী নেতারা নতুন ভ্যাট আইন নিয়ে মহাদুশ্চিন্তায় পড়ে গেছেন। তাদের মতে, নতুন এ ভ্যাট আইন শুধু ব্যবসা-বাণিজ্যে ধস নামাবে না, বরং স্থানীয় অনেক শিল্প বন্ধ হয়ে যাবে।
ব্যবসায়ী নেতারা বলেন, বর্তমানে নানা কারণে ব্যবসা ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির খড়গ ঝুলছে। এ নিয়ে তারা আছেন মহাদুশ্চিন্তায়। এর ওপর নতুন করে ভ্যাট আরোপ করায় পণ্যের উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাবে। আর পণ্যের উৎপাদন ব্যয় বাড়লে মূল্য বেড়ে যাবে। স্থানীয় পর্যায়ে মূল্য বেড়ে গেলে এক দিকে বিদেশী পণ্য বাজার দখল করবে, অন্য দিকে মূল্য প্রতিযোগিতায় টিকতে না পারলে রফতানি আয়ও কমবে। এতে অনেক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করা ছাড়া তাদের কোনো বিকল্প থাকবে না।
নতুন এ ভ্যাট আইন নিয়ে সর্বত্রই আতঙ্ক রয়েছে। কারণ এত দিন আমরা একটি পদ্ধতিতে ভ্যাট দিয়ে এসেছিলাম। কিন্তু নতুন আইন হওয়ায় এখন অনেক অনিচ্ছাকৃতভাবে ভুলভ্রান্তি হতে পারে। এখন এর ওপর ভিত্তি করে ব্যবসায়ীদের যদি হয়রানি ও জরিমানা করা হয়, তাহলে ব্যবসায়ীদের বলার কিছু থাকবে না। এ কারণে এ আইন বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কমপক্ষে ছয় মাস থেকে সর্বোচ্চ এক বছর পর্যন্ত সময় দেয়া প্রয়োজন। একই সাথে ব্যবসায়ীদের যৌক্তিক দাবি মেনে ক্ষেত্রবিশেষে কোনো কোনো খাত থেকে আরোপিত কর প্রত্যাহার করা উচিত; অন্যথায় প্রজারা না থাকলে দেশ অরক্ষিত হয়ে পড়বে।
বেশ কয়েক বছর ধরে শোনা যায়, দেশ থেকে টাকা পাচার হচ্ছে। হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার করে একশ্রেণীর স্বার্থান্বেষী মহল বিদেশে বাড়ি-গাড়ি ব্যবসা-বাণিজ্য গড়ে তুলছেন। বিষয়টি সরকারের মনোযোগ সহকারে খতিয়ে দেখা উচিত। দেশের কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রা কেন বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে তার কারণ অনুসন্ধান করে তা সমাধানে বাস্তব পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন। মনে রাখতে হবে, আমাদের শ্রমবাজারে প্রতি বছর ২৫ থেকে ৩০ লাখ লোক প্রবেশ করছে। তাদের জন্য প্রয়োজনীয় কাজের ব্যবস্থা করতে হবে। এ জন্য নতুন নতুন শিল্পকারখানা স্থাপনের পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে; অন্যথায় দেশে আর্থিক, সামাজিক বিপর্যয় এড়ানো কোনোভাবেই সম্ভব হবে না।


আরো সংবাদ



premium cement