২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

চলতি সপ্তাহে যুদ্ধের কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিল ইসরাইল ও হিজবুল্লাহ?

বেক্কা উপত্যকায় ইসরায়েলের হামলা - ছবি : বিবিসি

হামাস গত বছরের ৭ অক্টোবর ইসরাইলে হামলার পর থেকে শুরু হওয়া ইসরাইল-গাজা যুদ্ধকে ছাপিয়ে যে ভয় বড় হয়ে দেখা দিয়েছে, তা হলো এই সঙ্ঘাত আরো মারাত্মকভাবে ছড়িয়ে পড়বে কিনা।

হামাসের আক্রমণের পরদিন লেবাননের শক্তিশালী সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহ সংহতি জানাতে গিয়ে ইসরাইলকে লক্ষ্য করে রকেট ও গোলা ছুঁড়ে। পাল্টা জবাবে ড্রোন হামলা ও কামানের গোলা ব্যবহার করে ইসরাইল।

কিন্তু আতঙ্কিত হয়ে পড়া ইসরাইল, যার প্রধানমন্ত্রী তখন রাজনৈতিক অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে সংগ্রাম করছিলেন, সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে উত্তরাঞ্চলীয় সীমান্ত জুড়ে যে হুমকি তা নিরসন করা দরকার।

আশঙ্কা তৈরি হয়েছিলো যে বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সরকার হিজবুল্লাহর বিরুদ্ধে আরেকটি যুদ্ধক্ষেত্র খুলে ফেলে কিনা। হিজবুল্লাহও হামাসের মতোই ইহুদি রাষ্ট্রটিকে ধ্বংস করতে চায়। আর তা ঘটলে হিজবুল্লাহর প্রধান পৃষ্ঠপোষক ও যুক্তরাষ্ট্রের শত্রু ইরানও জড়িয়ে পড়তো।

এই সপ্তাহে লেবাননের ভেতরে বেক্কা উপত্যকায় আরো বিমান হামলা চালিয়েছে ইসরাইল। এতে করে সংঘাত শুরু হওয়ার পর লেবাননে এ পর্যন্ত মারা গেছে ২৪০ জন।

জবাবে হিজবুল্লাহ ইসরাইলের উত্তরাঞ্চলে অন্তত একশ কাতিয়ুসা রকেট নিক্ষেপ করে, যার টার্গেটগুলোর মধ্যে ছিল গোলান মালভূমি এলাকায় ইসরাইলের সামরিক ঘাঁটিও। অক্টোবরে সিরিয়া ও লেবানন থেকে হামলায় অন্তত ১৭ জন ইসরাইলি নিহত হয়েছে।

এই রকেট হামলায় ক্ষুব্ধ হয়ে ইসরাইলের ডানপন্থী নিরাপত্তা বিষয়ক মন্ত্রী ইতামার বেন-জিভির প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্টকে উদ্দেশ্য করে লিখেছেন, ‘সশস্ত্র বাহিনী আপনার দায়িত্বে। আপনি কিসের জন্য অপেক্ষা করছেন? আমাদের জবাব দেয়া শুরু করা দরকার, আক্রমণ-যুদ্ধ, এখনই!’

গত মাসে ইসরাইল ডিফেন্স ফোর্স বা আইডিএফ এর চিফ অফ স্টাফ হার্জি হালেভি বলেছেন, ‘আমরা এখন উত্তর যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নেয়ার ওপর নজর দিয়েছি।’

অনেক দিন ধরেই মনে করা হচ্ছে যে সীমান্তের সংঘর্ষগুলো সতর্কভাবেই অঘোষিত লাল রেখা বরাবর রাখা হয়েছে মূলত একটি বড় ধরনের যুদ্ধ এড়ানোর জন্যই।

হিজবুল্লাহ নেতা হাসান নসরুল্লাহও যুদ্ধের কোনো ডাক দেননি। ইসরাইলের সাথে ২০০৬ সালের যুদ্ধের ভয়াবহতা লেবাননের স্মৃতিতে এখনো অনেকটাই তাজা। ওই যুদ্ধে প্রায় এক হাজার লেবানিজ নিহত হয়েছে।

ইসরাইলও জানে যে হিজবুল্লাহর সামরিক সক্ষমতা হামাসের চেয়েও অনেক বেশি।

অবস্থান ধরে রাখা
ইসরাইলের মারিভ পত্রিকায় গত মাসে একটি জনমত জরিপ ছাপা হয়েছে, যেখানে একাত্তর শতাংশ উত্তরদাতা হিজবুল্লাহর বিরুদ্ধে বড় ধরনের সামরিক অভিযানে শুরুর পক্ষে মত দিয়েছে।

রিসার্চ সেন্টারের প্রধান সারিত জেহাভি আলমা বসবাস করেন লেবানন সীমান্তের কাছেই। তিনি বলছেন, হিজবুল্লাহর লক্ষ্য হলো ইসরাইলকে যুদ্ধে টেনে আনা। তবে তিনি মনে করেন ইসরাইল সর্বাত্মক সঙ্ঘাতে জড়াতে চায় না।

‘ইসরাইল একটি সর্বাত্মক যুদ্ধ এড়াতে চায়। তবে হিজবুল্লাহর যতটা সম্ভব ক্ষতি করে তারা নিরাপত্তা পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাতে চায়। ইসরাইলের জন্য এটা সবচেয়ে কম ক্ষতিকর বিকল্প খুঁজে নেয়া: আমরা হিজবুল্লাহর সক্ষমতা এবং যুদ্ধের মূল্য বুঝতে পারি।’

তার বিশ্বাস এর আগে হিজবুল্লাহর অ্যান্টি ট্যাংক ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করা, দূরপাল্লার রকেট ব্যবহারও গোষ্ঠীটির সামরিক কৌশল ও সক্ষমতার একটি প্রমাণ।

‘হিজবুল্লাহ যুদ্ধের মূল্যের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়েছে। তারা নিকট ভবিষ্যতের দিকে তাকাচ্ছে না। বরং তারা তাকাচ্ছে আরো সামনের দিকে।’

‘তারা ইতোমধ্যেই লাখ লাখ ইসরাইলিকে সরে যেতে বাধ্য করার মাধ্যমে একটা লক্ষ্য অর্জন করেছে,’ উল্লেখ করে তিনি বলেন প্রায় ৬০ হাজার ইসরাইলি সীমান্তের কাছাকাছি এলাকায় বসবাস করতো। যাদের অনেকেই গত অক্টোবরের হামলার পর সরে গেছে। এটাই ইসরাইলের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় বাস্তুচ্যুত হওয়ার ঘটনা। প্রায় এক লাখ লেবানিজও সীমান্তের অন্য দিকে সরে গেছে।

সরে যাওয়া ব্যক্তিদের ফিরিয়ে আনতে ইসরাইল হিজবুল্লাহ বাহিনীকে লিতানি নদীর পেছনে ঠেলে দিতে চায়, যাকে বৈরুত ও ইসরাইলের সীমান্তের মধ্যকার বাফার জোন মনে করা হয়।

২০০৬ সালের যুদ্ধ শেষে যে সমঝোতা চুক্তি হয়েছিলো তার অংশ হিসেবে লেবানিজ সেনা বা জাতিসংঘের বাহিনী ছাড়া লিতানির দক্ষিণ এলাকায় আর কোন সামরিক শক্তির থাকার কথা নয়। কিন্তু হিজবুল্লাহ তা লঙ্ঘন করেছে।

যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ দূত এমোস হোচস্টেইন বারংবার চেষ্টা করেছেন যাতে সংঘাত ওই অঞ্চলে ছড়িয়ে না পড়ে। তবে হিজবুল্লাহর প্রত্যাহার ও অস্ত্রমুক্ত করার বিষয়ে কোন চুক্তি এখনো করা যায়নি।

মনে হচ্ছে বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ও হিজবুল্লাহ- উভয়েই একটু বিরতি দিতে চাইছেন।

কোন নতুন যুদ্ধ ক্ষেত্র তৈরি না করেই ইসরাইলের সশস্ত্র বাহিনী এর মধ্যেই গাজায় ছড়িয়ে গেছে- যা আন্তর্জাতিক উত্তেজনার একটি নতুন ঢেউ হিসাবে দেখা দিয়েছে।

আর কম শক্তিক্ষয়ের জন্য হলেও হিজবুল্লাহও আছে শুধু জবাব দেয়ার ভঙ্গীতে। তবে প্রকৃত ঝুঁকির বিষয় হলো ভুল হিসেবের আশঙ্কা এবং প্রতিযোগিতার চাপ সামলানো।

মি. নেতানিয়াহু এমন একটি ধারণার সঙ্গে লড়াই করছেন যে তিনি দেশকে ঝুঁকিপূর্ণ করেছেন যা ইতিহাসের সবচেয়ে বড় হামলার মুখে নিয়ে গেছে।

জিম্মিদের পরিবারগুলো চায় অভিযান চালিয়ে জিম্মিদের ফেরত আনা হোক। কিন্তু গাজায় বেসামরিক নাগরিকদের হতাহতের ঘটনা পশ্চিমাদের ক্ষুব্ধ করে তুলছে।

এখন আশঙ্কার বিষয় হলো নিজের রাজনৈতিক অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে তিনি যুদ্ধকে লেবাননে ছড়িয়ে দেন কি না।

বৈরুতের আমেরিকান ইউনিভার্সিটির প্রফেসর হিলাল খাশান মনে করেন ইসরাইলের আপাত ধৈর্য ধরা থেকে সত্যি চিত্র পাওয়া যাচ্ছে না।

‘নেতানিয়াহু পরিষ্কারভাবেই যুদ্ধ চান,’ বলছিলেন তিনি। উদাহরণ হিসেবে তিনি অক্টোবরের পর থেকে লেবানন জুড়ে প্রায় চার হাজার হামলার কথা উল্লেখ করেন।

‘রাজনৈতিকভাবে তিনি শেষ এবং যুদ্ধ শেষ হলে তিনি এটি উপলব্ধি করবেন। আমার মনে হয় না তিনি যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপ কি চিন্তা করছে তার কোন গুরুত্ব দেন-তিনি হিজবুল্লাহ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েই রেখেছেন,’ বলছিলেন তিনি।

আরেকটি সম্ভাব্য হুমকি অজানা রয়ে গেছে। তা হলো ইরান থেকে জবাব। লেবাননে যারা হিজবুল্লাহরও ওপর নির্ভর করে প্রক্সি যুদ্ধ করছে।

হামাসের হামলার ঘটনার পর থেকে মধ্যপ্রাচ্যে তাদের শক্তি কিছুটা নমনীয় করেছে। ইরান সমর্থিত গোষ্ঠীগুলো ইরাক ও সিরিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ঘাঁটিতে হামলা করেছে। ইয়েমেনে ইরান সমর্থিত- হুতি বিদ্রোহীরা লোহিত সাগরে অসংখ্য হামলা চালিয়েছে। নিয়ন্ত্রনহীন যুদ্ধে তারা যাচ্ছে না কিন্তু ইসরাইল বড় ধরনের হামলা করলে হিজবুল্লাহ ইরানের চিন্তায় পরিবর্তন আনতে পারে।

লেবাননে ইসরাইলের বড় সংঘাতে জড়ানোর ক্ষুধা বা আগ্রহ কমই আছে। বিশেষ করে শিয়া গোষ্ঠীর হিজবুল্লাহর বাইরে যেসব ধর্মীয় গোষ্ঠী আছে তাদের বিরুদ্ধে। ‘শিয়া ছাড়া বাকী সবাই হিজবুল্লাহকে নিরস্ত্র দেখতে চায়,’ বলছিলেন প্রফেসর খাশান।

আবার শিয়ারা এই লড়াইয়ে খুশী নয়। ‘তারাও যুদ্ধ চায় না’।

হাসান নসরুল্লাহ বলেছেন গাজায় যুদ্ধবিরতি ছাড়া ইসরাইলের সঙ্গে কোন যুদ্ধবিরতিতে যেতে তিনি রাজী হবেন না।

খবর বেরিয়েছে যে তিনি ইরানের সামরিক নেতাদের বলেছেন যে ইরান ইসরাইল বা যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জড়াক তা তিনি চান না। প্রয়োজন হলে হিজবুল্লাহ একাই লড়বে।

তারপরেও সীমান্তের দু'পাশে যারা বসবাস করেন তারা ভীত সন্ত্রস্ত।

‘প্রতি রাতেই সাতই অক্টোবরের গণহত্যার ছবি মাথায় নিয়েই আমি বিছানায় যাই,’ বলছিলেন সারিত জেহাভি। ‘আর প্রতি সকালেই উঠে আমি বলি, ওকে সন্ত্রাসীরা গত রাতে আক্রমণ করেনি। এটি আসলে ভেতর থেকে আসা একটি হুমকি’। সূত্র : বিবিসি


আরো সংবাদ



premium cement