১০ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১, ০১ জিলকদ ১৪৪৫
`


সুদানের সঙ্ঘাত বন্ধে কী করছে সৌদি আরব

সুদানের সেনাপ্রধান জে আব্দুল ফাতাহ আল বুরহান এবং তার প্রতিপক্ষ মিলিশিয়া বাহিনী আরএসএফের প্রধান জেনারেল মোহামেদ হামদান দাগালো - ছবি - বিবিসি

আফ্রিকার উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় দেশ সুদানে লড়াইরত দুই পক্ষকে রিয়াদে নিয়ে এসে মীমাংসা বৈঠকে বসাতে সক্ষম হয়েছে সৌদি সরকার।

সুদানের সেনাপ্রধান জে আব্দুল ফাতাহ আল বুরহান এবং তার প্রতিপক্ষ মিলিশিয়া বাহিনী আরএসএফের প্রধান জেনারেল মোহামেদ হামদান দাগালো (হেমেটি নামে বেশি পরিচিত)- দু’জনেই তাদের প্রতিনিধিদের রিয়াদে পাঠিয়েছেন।

শনিবার থেকে তারা সেখানে সৌদি সরকারের মধ্যস্থতায় মুখোমুখি বসে কথা বলতে শুরু করেছেন।

এর মধ্যে গত তিন সপ্তাহে সুদানে প্রায় ছয় শ’ লোক মারা গেছে। কয়েক লাখ মানুষ আশপাশের দেশগুলোতে পালিয়েছে।

কয়েক হাজার বিদেশী নাগরিককে যুদ্ধজাহাজ এবং যুদ্ধ বিমান পাঠিয়ে উদ্ধার করে আনা হয়েছে।

আফ্রিকার সাহেল এবং হর্ন অব আফ্রিকা অঞ্চলটি এমনিতেই বহুদিন ধরেই যুদ্ধ-বিগ্রহে বিপর্যস্ত।

সুদানের সঙ্ঘাত দীর্ঘায়িত হলে পুরো অঞ্চলের নিরাপত্তা আরো ভঙ্গুর হয়ে পড়বে বলে গভীর উদ্বেগ তৈরি হয়েছে।

সুদানের এই লড়াইকে এরই মধ্যে অনেকেই পুরাদস্তুর গৃহযুদ্ধ বলে বর্ণনা করতে শুরু করেছেন।

আফ্রিকান ইউনিয়ন এবং সেই সাথে পূর্ব এবং হর্ন অব আফ্রিকার আঞ্চলিক জোট ইগাড শুরু থেকেই মীমাংসার চেষ্টা করছে। কিন্তু আফ্রিকার নতুন এই যুদ্ধ বন্ধে সবচেয়ে তৎপর হয়েছে সৌদি আরব।

কেনিয়ার রাজধানী নাইরোবিতে বিবিসির বেভারলি ওচিয়েং, যিনি পূর্ব আফ্রিকা এবং সাহেল অঞ্চলের রাজনীতি ও নিরাপত্তার একজন ঘনিষ্ঠ পর্যবেক্ষক, তিনি বলছেন যে অন্য সব পক্ষের তুলনায় সৌদিদের মধ্যস্থতার উদ্যোগ অনেক বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে।

‘একদম শুরুতে ইগাড জোট মীমাংসার উদ্যোগ নেয়। তারা দু’পক্ষকে সাউথ সুদানের রাজধানী যুবায় বসার জন্য চাপ দিতে থাকে। কিন্তু তাতে কাজ হয়নি। কিন্তু দেখে মনে হচ্ছে, সুদানের বিবদমান দুই পক্ষই সৌদি আরবের মধ্যস্থতা নিয়ে আগ্রহী,’ বিবিসিকে বলছিলেন ওচিয়েং।

সুদানের সঙ্ঘাত বন্ধে নিয়ে সৌদি আরব এত সক্রিয় কেন?

বেভারলি ওচিয়েং বলেন, সুদান ও সৌদি আরবের সম্পর্কের ঐতিহাসিক একটি প্রেক্ষিত রয়েছে।

‘আপনি বলতে পারেন এক অর্থে সুদান অনেকটাই ব্যতিক্রমী একটি দেশ। এটি আফ্রিকার দেশ। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যের আরব দেশগুলো এদেশের রাজনীতি এবং অর্থনীতির প্রধান চালিকা শক্তি, বিশেষ করে সৌদি আরব,’ বলেন ওচিয়েং।

সুদান একইসাথে সাহেল, হর্ন অব আফ্রিকা এবং লোহিত সাগর অঞ্চলের অংশ। কিন্তু তারপরও সুদানের সমাজ ও রাষ্ট্রের একটি বড় অংশের, বিশেষ করে আরবি ভাষাভাষী সুদানি শাসক এবং অভিজাত শ্রেণীর সাথে উপসাগরীয় আরব দেশগুলোর সাথে ঐতিহাসিকভাবে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে।

ইয়েমেন যুদ্ধে সৌদি নেতৃত্বে কোয়ালিশনের প্রধান শরিক ছিল সুদান। বহু সুদানি সৈন্য এবং আরএনএফ মিলিশিয়া ইয়েমেনে যুদ্ধ করেছে।

যে চারটি দেশের মধ্যস্থতায় গত বছর সুদানে সামরিক শাসন থেকে বেসামরিক সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে চুক্তি হয়েছে, তাতে আফ্রিকার কোনো দেশ না থাকলেও রয়েছে সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত।

‘সৌদি আরব এবং সেইসাথে ইউএই মনে করে সুদানের নিরাপত্তা এবং রাজনৈতিক সংস্কারের প্রকল্পটি তাদের। সুতরাং এই প্রকল্প ভেস্তে যাক সেটা তারা কোনো ভাবে চায় না,’ বিবিসি বাংলাকে বলেন লন্ডনে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক ঝুঁকি বিষয়ক বিশ্লেষক সাদি হামদি।

ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ
সাদি হামদি মনে করেন, ঐতিহাসিক এবং সাংস্কৃতিক সম্পর্ক ছাড়াও সুদানের সঙ্ঘাত নিয়ে সৌদি আরবের বিশেষ তৎপরতার পেছনে প্রধানত রয়েছে তাদের ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ। তিনি বলেন, একই কথা ইউএইর বেলাতেও প্রযোজ্য।

‘কেন সৌদিরা সুদান নিয়ে এত উদ্বিগ্ন? সোজাসাপ্টা উত্তর হলো, এর পেছনে রয়েছে তাদের রাজনৈতিক, নিরাপত্তাজনিত স্বার্থ। সৌদি আরব বা ইউএই কোনোভাবেই চায় না সুদানে যাতে ইসলামপন্থী কোনো সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়, বলেন হামদি।

আরব বসন্ত অর্থাৎ গণবিক্ষোভের জেরে সরকার পতনের পর যেসব আরব দেশে নির্বাচন হয়েছে যেমন মিসর, তিউনিসিয়া- সব জায়গায় ইসলামপন্থীরা ক্ষমতা নিয়েছিল।

‘এ কারণে গণবিক্ষোভের ভেতর দিয়ে ওমর আল বশিরের পতনের পর সুদানে কোনো নির্বাচন হয়নি। আমেরিকার সহযোগিতা নিয়ে সৌদি আরব এবং ইউএই নির্বাচনের বদলে একটি অন্তর্বর্তীকালীন অনির্বাচিত সরকার বসাতে সক্ষম হয়,’ বলেন সামি হামদি।

হেমেটির সাথে সম্পর্কে টানাপড়েনের মাঝে জে বুরহান কিছুদিন আগে হুমকি দিয়েছিলেন তিনি নির্বাচন দিয়ে দেবেন যেটা সৌদি এবং ইউএইকে হয়তো উদ্বিগ্ন করে তুলছে।

‘স্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে লড়াইতে জে বুরহানের অনুগত বাহিনী হেমেটির বাহিনীকে বেশ চাপে ফেলেছে। ফলে সৌদি এবং ইউএই হয়তো ভয় পাচ্ছে এই লড়াইয়ে যদি হেমেটি হারে তাহলে জে বুরহান হয়ত নির্বাচন দিয়ে দেবেন এবং সেই নির্বচনে ইসলামপন্থীরা জিতবে।’

সামি হামদি মনে করেন, প্রধানত সে কারণে সৌদিরা মধ্যস্থতার ব্যাপারে সক্রিয় যাতে হেমেটির আরএসএফ যেন টিকে থাকতে পারে।

হামদির এই সন্দেহ হয়তো অমূলক নয়।

কারণ সুদান থেকে পাওয়া বিভিন্ন খবরে বলা হচ্ছে আরএসএফ মিলিশিয়ারা লড়াইতে বেশ চাপে পড়েছে।

রিয়াদে এই মীমাংসা বৈঠক আয়োজনের জন্য হেমেটি সৌদি আরব এবং আমেরিকাকে বিশেষ অভিনন্দন জানিয়েছেন।

সোনার খনি, ফসলের ক্ষেত ও বন্দর
তবে অনেক পর্যবেক্ষক মনে করেন, শুধু রাজনৈতিক বা কৌশলগত স্বার্থই নয়, সুদানের এই সঙ্ঘাতকে সৌদি আরব তাদের নিজেদের উচ্চাভিলাষী অর্থনৈতিক পরিকল্পনার জন্য হুমকি হিসাবে মনে করছে।

কারণ তেল সম্পদ ছাড়াই অর্থনৈতিক উন্নয়নের যেসব প্রকল্প যুবরাজ মোহামেদ বিন সালমান নিয়েছেন তার অনেকগুলোই লোহিত সাগর উপকূল ঘেঁষে।

পাঁচ শ’ বিলিয়ন ডলারের অত্যাধুনিক প্রযুক্তি-ভিত্তিক শহর নিওম সিটিও সেখানে। এই এলাকা সুদানের লোহিত সাগর উপকূল বেশি দূরে নয়।

‘এই মুহূর্তে সৌদিরা যেটা একেবারেই চায় না তা হলো লোহিত সাগরের উপকুলে আরেকটি সিরিয়া,’ সৌদি একজন বিদেশ নীতির গবেষক আজিজ আলঘাসিয়ানকে উদ্ধৃত করে লিখেছে মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক গবেষণাধর্মী সাময়িকী মিডল ইস্ট আই।

সৌদিরা ভয় পাচ্ছে, সুদানের সঙ্ঘাত আশপাশের দেশগুলোতে ছড়িয়ে পড়লে লোহিত সাগর উপকূলে তাদের প্রকল্পগুলোতে বিনিয়োগ আকর্ষণ কঠিন হয়ে উঠতে পারে।

তাছাড়া ২০১৯ সালে বশিরের উৎখাতের পর প্রাকৃতিক সম্পদ এবং কৃষিতে সমৃদ্ধ সুদানে পা রাখার সুযোগ হয় সৌদি আরবের।

গত বছর তারা সুদানের কৃষি এবং খনিজ সম্পদ উন্নয়নে ৩০০ কোটি ডলার বিনিয়োগের ঘোষণা দিয়েছে তারা।

সংযুক্ত আরব আমিরাতও তাদের অর্থনৈতিক স্বার্থ নিয়ে উদ্বিগ্ন।

ইয়েমেনের সোকোটরা বন্দর থেকে হর্ন অব আফ্রিকার সোমালি-ল্যান্ড পর্যন্ত সাগরপথে বাণিজ্যিক নৌ পরিবহনের ওপর প্রাধান্য বিস্তার করতে চাচ্ছে তারা।

ডিসেম্বরে আবুধাবি বন্দর কর্তৃপক্ষ পোর্ট অব সুদানের দুই শ’ মাইল উত্তরে একটি নতুন বন্দর নির্মাণে ছয় শ’ কোটি ডলার বিনিয়োগের একটি চুক্তি করেছে।

সৌদি মধ্যস্থতা কী কাজ করবে?
রিয়াদে বৈঠক শেষে জেনারেল বুরহান এবং হেমেটি কি হাত মেলাবেন?

তেমন সম্ভাবনা নিয়ে সন্দিহান বেভারলি ওচিয়েং।

‘দুই জেনারেলই একের পর এক যুদ্ধবিরতি চুক্তি লঙ্ঘন করছেন। এসব চুক্তির পেছনে সৌদি আরব, যুক্তরাষ্ট্র এবং আফ্রিকার বিভিন্ন আঞ্চলিক জোট রয়েছে। কিন্তু কারো কথাই তারা তেমন শুনছেন না। আমার মনে হয় আপোষের বদলে তারা তাদের মীমাংসা বৈঠকে গিয়ে নিজ নিজ স্বার্থ রক্ষার চেষ্টা করবে,’ বলেন ওচিয়েং।

‘ক্ষমতা-প্রভাব সামান্য ক্ষুণ্ণ হয় সেটা সুদানের সামরিক এলিটরা কখনই মানবেন না। অন্যদিকে সোনার খনি এবং ব্যবসায় আরএসএফের স্বার্থ জড়িত,’ বলেন বেভারলি ওচিয়েং।

সেইসাথে রয়েছে হেমেটির ব্যক্তিগত রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ।

আরব উপসাগরীয় দেশগুলো সুদানে কতটা নিরপেক্ষ ভূমিকা নিচ্ছে তা নিয়ে সেদেশে বিতর্ক দানা বাঁধছে।

অভিযোগ রয়েছে ইউএই গোপনে সমর্থন করছে আরএসএফকে।

এই সঙ্ঘাত শুরুর কদিন আগেই হেমেটি আবুধাবি গিয়ে এবং ইউএইর প্রেসিডেন্টের সাথে কথা বলেন।

এই সন্দেহ থেকেই সম্ভবত জে বুরহান মার্চে গিয়েছিলেন কাতারে যে দেশটির সাথে প্রতিবেশী সৌদি আরব এবং ইউএইর চাপা শত্রুতা রয়েছে।

এসব কারণে অনেক পর্যবেক্ষক মনে করছেন, সুদানের দুই জেনারেলকে মীমাংসায় রাজী করানো কঠিন হয়ে উঠতে পারে।

তার অর্থ, এই সঙ্ঘাত হবে এবং তা হলে যুদ্ধ আশপাশের দেশগুলোতে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা প্রবল।

যুদ্ধ যে বিস্তৃত হতে পারে তার অনেক লক্ষণ স্পষ্ট।

দক্ষিণ সুদান তাদের সীমান্ত বন্ধ করার চেষ্টা শুরু করেছে। লড়াইতে শাদের যুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল।

লিবিয়ার মিলিশিয়া নেতা খলিফা হাফতার জড়িয়ে গেছেন। তিনি হেমেটিকে অস্ত্র-সরঞ্জাম পাঠাচ্ছেন বলে বিস্তর অভিযোগ উঠছে।

হামদির কথায়, সুদান হয়ত আন্তর্জাতিক ছায়া যুদ্ধের একটি ভেন্যু হতে চলেছে এবং এটি ঠেকানো না গেলে পরিণতিতে সাড় চার কোটি জনসংখ্যার খনিজসম্পদে সমৃদ্ধ দেশটি একটি ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হবে।

আর ঘটনাপ্রবাহ সেভাবে গড়ালে সৌদি আরবের জন্য তা হবে চরম এক দুঃস্বপ্ন।

সূত্র : বিবিসি


আরো সংবাদ



premium cement