২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

জন্মনিবন্ধন সনদ পেতে যশোরে চরম ভোগান্তি

মাসের পর মাসেও না পাওয়ার অভিযোগ
-

যশোরে জন্মনিবন্ধন করতে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি চরমে। কেটে যায় দিনের পর দিন, মাসের পর মাস। এভাবে অনেকের কাটতে চলেছে বছর। তবুও মিলছে না সন্তানের জন্য কাক্সিক্ষত জন্মসনদ। ফলে পাচ্ছেন না সরকারের দেয়া উপবৃত্তির টাকা। বিভিন্ন প্রয়োজনে সন্তানের জন্মনিবন্ধন সনদ নিতে অভিভাবকদের পোহাতে হচ্ছে ঝুট-ঝামেলা। যশোরে কয়েকটি ইউনিয়নে অভিযোগের এমন ফিরিস্তি পাওয়া গেছে।
সম্প্রতি জন্মসনদ পেতে জুড়ে দেয়া হয়েছে বেশ কয়েকটি শর্ত। এগুলো পূরণ করতে গিয়ে অনেকেরই হাঁসফাঁস অবস্থা। যাদের জন্ম ২০০১ সালের পর তাদের জন্মনিবন্ধনের জন্য বাবা-মায়ের জন্মসনদ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে, যাতে বিপাকে পড়ছেন অনেকে। এ নিয়ম চালু হওয়ায় ভোগান্তিতে পড়ার কথা জানিয়েছেন বেশ কয়েকজন অভিভাবক।
গতকাল শনিবার সকালে কেশবপুরের মেহেরপুর এলাকায় গিয়ে কথা হয় নাসরিন সুলতানার সাথে। তিনি জানান তার মেয়ে অরিন আক্তার পড়ছে স্থানীয় মেহেরপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণীতে। স্কুলের শিক্ষকরা বারবার চাপ দিচ্ছেন মেয়ের জন্মসনদের জন্য। কিন্তু বাবা মোমরেজ হোসেনের জন্মসনদ না থাকায় মেয়ের সনদ হচ্ছে না। মোমরেজ হোসেনের জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বর-৭৩৩৭৫৪১৩৬৬। নাসরিন জানান, স্বামীকে সাথে নিয়ে সন্তানের জন্ম নিবন্ধন করাতে একাধিকবার গিয়েছেন সাগরদাড়ি ইউনিয়ন পরিষদে। তারা ইউএনও অফিসে যেতে বলেন। ওই খানে গিয়ে সংশ্লিষ্ট অফিসে আবেদন করেছেন তিনি। কয়েক মাস কেটে গেছে। আজো পাননি সন্তানের জন্ম সনদ। আনোয়ারা বেগম। বাবার বাড়ি সাতক্ষীরার পাটকেলঘাটা থানায়। ২০০২ সালে তার বিয়ে হয় যশোরের কেশবপুর থানায়। স্বামী আবুল কামালের সাথে তিনি ওই থানার সাগরদাড়ি ইউনিয়নের মেহেরপুর গ্রামে বসবাস করছেন। তাদের সন্তান মিতা খাতুন পড়ে চতুর্থ শ্রেণীতে। নতুন নিয়মে মেয়ের জন্ম নিবন্ধন সনদ নিতে তিনি পড়েছেন মহা বিপাকে। বছর পার হলেও আজো তিনি নিতে পারেননি সনদ। ফলে পাচ্ছেন না সরকারি উপবৃত্তির টাকা। আনোয়ার বেগম জানান তার স্বামী পেশায় ভ্যানচালক। লেখাপড়া বেশি জানেন না। তবু মেয়ের জন্মসনদের জন্য খুব ছোটাছুটি করেছে। তবে আমার জন্মসনদ না থাকায় আজও মেলেনি সনদ। ভ্যানচালক কামাল জানান, আমার স্ত্রীর ভোটার আইডি কার্ড আছে। অভিভাবক মনোয়ার হোসেন বলেন, তাদের দু’জনের জন্মনিবন্ধন আছে। তবে একজনের ইংরেজিতে, অন্যজনেরটা বাংলায় হওয়ার কারণে তারা আবেদনই করতে পারছেন না। সন্তানেরটাও হচ্ছে না।
বিষয়টির ব্যাখ্যায় একজন ইউপি সচিব বলেন, সন্তানের জন্মনিবন্ধনের জন্য বাবা-মা দুজনের নিবন্ধন বাধ্যতামূলক। বাবা ও মায়েরটা যদি বাংলায় হয় তাহলে সন্তান বাংলায় একটা জন্মনিবন্ধন পাবে। আর দুটোই ইংরেজিতে হলে জন্মনিবন্ধন পাবে ইংরেজিতে। কিন্তু যদি দু’জনেরটা আলাদা হয় তাহলে আবেদনই করতে পারবে না। দু’জনেরটা এক ভাষায় করে নিতে হবে। এ ধরনের সমস্যা অনেক হচ্ছে।
মালয়েশিয়ায় আটকে পড়া স্বামী শামীম হোসেনকে দেশে আনতে জন্মসনদের প্রয়োজনে মনিরামপুরের খেদাপাড়া ইউনিয়ন পরিষদে যান কাশিপুর গ্রামের রুমি খাতুন। তিন বছর আগে ৩৬৫ টাকা জমা দিয়ে স্বামীর জন্য আবেদন করেন তিনি। শামীম কৌশলে দেশে পৌঁছলেও আজো জন্মসনদ হয়নি তার। অবশেষে রুমি খাতুন জানতে পারেন তার আবেদনের কোনো তথ্যই নেই পরিষদে।
দুই মেয়ে তাকিয়া ও তাবাসসুমের জন্মসনদের জন্য আট মাস আগে আবেদন করেছেন একই গ্রামের মাহফুজা খাতুন। আজো মেয়েদের সনদ পাননি তিনি। এক মাস আগে স্ত্রী ও সন্তানেরসহ নিজের জন্মসনদের আবেদন করেন মাহমুদকাটি গ্রামের নাজিম উদ্দিন। গেল ২৩ সেপ্টেম্বর আবেদন করে ওই দিনই মোবাইলে বার্তা পেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু সনদ হাতে পাননি আজো।
১০ দিন আগে একই পরিষদে জন্মসনদের আবেদন করেন ইমন হোসেন। পরিষদে গিয়ে জানতে পারেন তার ফাইল উধাও। জন্মসনদ নেয়ার জন্য খেদাপাড়া ইউনিয়ন পরিষদে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বসেছিল কাশিপুর গ্রামের আল আমিন। পরে খালি হাতে তাকে ফিরিয়ে দিয়েছেন সচিব।
জন্মসনদ নিয়ে ভোগান্তির এমন বহু অভিযোগ রয়েছে খেদাপাড়া ইউনিয়নের আবেদনকারীদের। সবার অভিযোগ, পরিষদের চাহিদামতো টাকা ও সব কাগজপত্র দিয়ে আবেদন করেও মাসের পর মাস ঘুরতে হয় পরিষদে। কিন্তু সনদ মেলে না। আবার বারবার টাকা নিয়ে একই নামে একাধিকবার ভুল সনদ দেয়ার অভিযোগও রয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জন্মসনদের জন্য ৫০ টাকা আবেদন খরচ হলেও খেদাপাড়া ইউনিয়ন পরিষদে আবেদনকারীর কাছ থেকে প্রতি আবেদনে ২০০ টাকা করে নেয়া হয়। এ টাকা দিয়ে আবেদন করেও মাসের পর মাস হাঁটতে হচ্ছে ভুক্তভোগীদের। অভিযোগ মিলছে যারা এর চেয়েও বেশি টাকা দেন তাদের কাজ হয়ে যায় দ্রুত। রাতে অফিস করে সচিব মৃণালকান্তি ও উদ্যোক্তা আনোয়ার হোসেন তাদের কাজ করে দেন। আর যারা টাকা দিতে পারেন না তাদের হাঁটতে হয় মাসের পর মাস।
এ দিকে গত রোববার খেদাপাড়া ইউনিয়ন পরিষদে সরাসরি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে জন্মসনদের ভোগান্তির কথা তুলে ধরেন রঘুনাথপুর গ্রামের নফর আলী। তিনি বলেন, আমার ছেলে ও মেয়ের জন্য একসাথে জন্মনিবন্ধন করতে দিই। অনেক দিন ঘুরানোর পর সনদ দেছে। তাতে ছেলের নামের জায়গায় মেয়ের নাম আর মেয়ের নামের জায়গায় ছেলের নাম দিয়ে ফেলেছে। আবার টাকা দিয়ে সংশোধনীর জন্য আবেদন করি। সেবারও আমার স্ত্রীর নামে ভুল করে। সচিবের কাছে গেলে বাড়তি টাকা চান। পরে টাকা দিয়ে আবার কাজ করাতে হয়েছে।
এসব বিষয়ে উদ্যোক্তা আনোয়ার হোসেন বলেন, অনেকে ঠিকমতো তথ্য দেন না। আবার কাজসম্পন্ন হলে নিতে আসেন না। তাই দেরি হয়। সচিব মৃণালকান্তি নয়া দিগন্তকে জানান, ২০০ টাকার অতিরিক্ত নেয়া হয় না। অনেক সময় তথ্যের ত্রুটি থাকে। আবার চেয়ারম্যানের স্বাক্ষর বাকি থাকে। এ জন্য জন্মসনদ দিতে দেরি হয়। এ বিষয়ে মনিরামপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সৈয়দ জাকির হাসান বলেন, কেউ লিখিত অভিযোগ দেননি। অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেয়া হবে।


আরো সংবাদ



premium cement