৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ শাওয়াল ১৪৪৫
`


সিলেটে মাদক মাফিয়ারা অপ্রতিরোধ্য

ইয়াবা আসছে ভারত থেকে
-

‘ক্রেজি ড্রাগ’ ইয়াবা এখন অনেকটা অপ্রতিরোধ্য রূপ নিয়েছে সিলেটে। শহর থেকে শুরু করে প্রায় প্রতিটি গ্রামের আনাচে-কানাচে বিস্তার ঘটেছে নীরব ঘাতক ইয়াবা ট্যাবলেটের। স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরাও বহন করছে এই মাদক। আর রাজনীতিকদের একটি অংশ এই ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করছে। পুলিশ, ছাত্র, জনপ্রতিনিধির পাশাপাশি তরুণী-যুবতী ও গৃহবধূরাও ইয়াবা ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ছে। অপ্রতিরোধ্য মাদক বাজার পরিচালনা করে তারা একেকজন হয়ে উঠেছেন মাদক মাফিয়া।
পুলিশ, বিজিবি, র্যাব, মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর থেকে শুরু করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকায়ও তারা ডাকসাইটে মাদককারবারি হিসেবে চিহ্নিত, থানা-আদালতে আছে ডজন ডজন মামলা। এরপরও কিছুই হচ্ছে না তাদের। ইতোমধ্যে র্যাবের সাথে বন্দুকযুদ্ধে সিলেটের মাদকসম্রাট আব্দুস শহিদ ওরফে মাদক শহিদ নিহত হয়েছে।
মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, সামাজিক অবক্ষয়ের মূলে এই ইয়াবা সেবন। এর কারণে সন্তান মা-বাবাকে মারছে। খুন, চুরি, ডাকাতি ও ছিনতাইয়ের মতো ঘটনাও ঘটছে। ধর্ষণ ও খুনের মামলার আসামিদের অধিকাংশই ইয়াবায় আসক্ত। ইয়াবার ভয়াবহ আগ্রাসন আগামী প্রজন্মকে ধ্বংসের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে।
আইনশৃঙ্খলা ও সীমান্ত রক্ষীবাহিনীর তথ্য মতে, সিলেট বিভাগের চারটি সীমান্ত দিয়ে ইয়াবা আসছে দেশে। সিলেটের জকিগঞ্জ ছাড়াও সুনামগঞ্জের মধ্যনগর ও টেকেরঘাট এবং হবিগঞ্জের বাল্লা সীমান্ত দিয়ে ভারত থেকে বাংলাদেশে ইয়াবা আসছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর রুটিন তৎপরতা, বিভিন্ন বাহিনীর বিশেষ অভিযান, চিরুনি অভিযান, সাঁড়াশি অভিযান, ক্রসফায়ার, গোয়েন্দা তৎপরতার সব কিছুকে ব্যর্থ করে দিয়ে মাদক মাফিয়ারা গড়ে তুলেছে অপ্রতিরোধ্য আলাদা সাম্রাজ্য, নিজস্ব বলয়।
গোয়েন্দা সূত্র জানিয়েছে, সিলেটের জকিগঞ্জ ও বাল্লা সীমান্ত ইয়াবা পাচারের নতুন রুট। ওপারে ভারতের আসাম, মিজোরাম ও মেঘালয়ে ইয়াবা তৈরির কারখানা গড়ে উঠেছে। সেখান থেকে ইয়াবা আসছে। এ বিষয়টি দুই দেশের মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের ডিজি পর্যায়ের বৈঠকে বাংলাদেশ তুলে ধরবে বলে জানা গেছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, সীমান্ত বাহিনীর ধারাবাহিক অভিযানের কারণে ইয়াবা ব্যবসায়ীরা কৌশল পাল্টেছে। তারা এখন ভারতীয় সীমান্ত থেকে নিয়মিতভাবে ছোট ছোট চালানে ইয়াবা আনছে বাংলাদেশে।
ভারতীয় মাদককারবারি আটক : গত ২৫ জানুয়ারি সিলেটের বিয়ানীবাজারে অভিযান চালিয়ে এক হাজার পিস ইয়াবাসহ ফকির আলী নামে এক ভারতীয় নাগরিককে আটক করে পুলিশ। ফকির ভারতের আসাম রাজ্যের করিমগঞ্জ জেলার লাফাসাইল গ্রামের ইরমান আলীর ছেলে।
গত ২৯ ডিসেম্বর বিয়ানীবাজারের সীমান্তবর্তী দুর্গম মুড়িয়া হাওর দিয়ে ইয়াবা পাচারের সময় বিনন্দ নমঃশুদ্র (৫৯) নামে আরেক ভারতীয় নাগরিককে আটক করে র্যাব-৯। বিনন্দ করিমগঞ্জেরই গোবিন্দগঞ্জ গ্রামের মৃত হরেন্দ্র নমঃশুদ্রের ছেলে। অভিযানে ৬৭০০ পিস ইয়াবা উদ্ধার করে র্যাব। এ সময় ভারতীয় নাগরিকের সাথে বিয়ানীবাজারের সুপাতলা গ্রামের সুভাষ দাশকেও আটক করা হয়।
যেসব কৌশলে আসছে : গোয়েন্দাদের তথ্য মতে, কুরিয়ার সার্ভিসে, ওষুধের বোতলে, মাছের পেটে, অ্যাম্বুলেন্সে, পণ্যের কনটেইনারে, গ্যাস লাইটারে জিপার ও ইলেকট্র্রিক ডিভাইসের ভেতরে লুকিয়ে ইয়াবা বহন করা হয়। পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিতে ইয়াবা ব্যবসায়ীরা অ্যাম্বুলেন্সে করেও ইয়াবা নিয়ে আসে। গত সোমবার রাত ১০টার দিকে দক্ষিণ সুরমায় অভিযান চালিয়ে হাসান আহমদ নামে এক মাদককারবারিকে গ্রেফতার করে ডিবি পুলিশ। এ সময় তার হেফাজতে থাকা দুইটি এয়ার টাইট জিপারে রক্ষিত ২০০ পিস ইয়াবা ট্যাবলেট জব্দ করা হয়। এর আগে র্যাব নগরীর বন্দরবাজার থেকে মাছের পেট থেকে বিপুল পরিমাণ ইয়াবা ট্যাবলেটসহ মাদককারবারিকে আটক করে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সিলেট ও ভারত দুই সীমান্ত এলাকায়ই রয়েছে বেশ কিছু ইয়াবা কারবারি। এর সাথে জকিগঞ্জ এলাকার অনেক জনপ্রতিনিধি ও প্রভাবশালী ব্যক্তি মাদক কারবারে জড়িত বলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একটি সূত্র জানায়।
সূত্রটি আরো জানিয়েছে, সিলেট অঞ্চলের খুচরা মাদক বিক্রেতাদের চাহিদা একত্র করে ফোনে সীমান্তের ওপারে বড় একটি চালানের অর্ডার দেন প্রভাবশালী বিক্রেতারা। ভারতে থাকা কারবারিদের কাছে টাকা পাঠানো হয় হুন্ডির মাধ্যমে। টাকা হাতে পেয়েই রাতের আঁধারে কাঁটাতারের ওপর দিয়ে ইয়াবা পার করে দেন ভারতীয় মাদক কারবারিরা। আগেই সেখানে অবস্থান নেয়া পাচারকাজে ব্যবহৃত লোকজন তা বাংলাদেশে নিয়ে আসে।
মাদকের যত সিন্ডিকেট : অনুসন্ধানে জানা গেছে, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর, জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থা-এনএসআই, সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা-ডিজিএফআই, পুলিশ, র্যাব, বিজিবি, আনসার-ভিডিপির তালিকা থেকে একটি সমন্বিত প্রতিবেদন তৈরির পর প্রধানমন্ত্রীর দফতরে দাখিল করা হয়। মাদক পাচার ও সরবরাহ বাণিজ্যে সিলেটের ১২ জন মাদক মাফির নাম।
মাদকসংক্রান্ত আন্তঃসংস্থার সমন্বিত প্রতিবেদনে সিলেট অঞ্চলকে এখন হেরোইন চালানের নিরাপদ রুট হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। সিলেটকেন্দ্রিক এ হেরোইন বাণিজ্যের মাফিয়া লন্ডনে অবস্থান করলেও তার ভাই-ভাতিজারা ঢাকাসহ আট জেলায় নিজস্ব নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা গড়ে তুলেছেন। লন্ডনি মাফিয়ার হেরোইনের চালান বাংলাদেশ পেরিয়ে পাকিস্তানেও যায় বলে জানা গেছে। মাফিয়া নিয়ন্ত্রিত হেরোইন চক্র ছাড়াও সিলেট অঞ্চলে ইয়াবা ও ফেনসিডিলের একচ্ছত্র বাজার নিয়ন্ত্রণ করছেন ১২ জন গডফাদার।
এ ছাড়া সিলেটের গোয়াইনঘাট-জাফলং, হবিগঞ্জের সাতছড়ি, আখাউড়া সীমান্ত পয়েন্টে পৃথক গডফাদারের নেতৃত্বে সঙ্ঘবদ্ধ মাদকচক্র সদা তৎপর। এসব চক্র বরাবরই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর স্থানীয় পর্যায়ের এক শ্রেণীর অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজশে মাদকবাণিজ্য নির্বিঘœ রাখে। ২০১৮ সাল থেকে এসব সীমান্ত দিয়ে দেশে ইয়াবা আসা শুরু হয়। ২০১৯ সালের মাঝামাঝি থেকে তা ব্যাপক আকার ধারণ করে।
জানা যায়, সিলেটের জকিগঞ্জ উপজেলার সাথে ভারতের প্রায় ৫৪ কিলোমিটারের সীমান্ত এলাকা রয়েছে। ভারতীয় অংশে পুরো সীমান্তেই কাঁটাতারের বেড়া রয়েছে। অন্য দিকে বাংলাদেশ অংশে তেমন কোনো সুরক্ষা বেড়া-ই নেই। এই দীর্ঘ সীমান্ত এলাকায় দুই দেশকে বিভক্ত করেছে কুশিয়ারা ও সুরমা নদী। এপারে সীমান্ত পাহারা দেয় বিজিবির প্রায় ১৫টি বিওপি। নদীর তীর ধরে একটি বেড়িবাঁধ রয়েছে বাংলাদেশ অংশে। মূলত সেই বাঁধ ধরেই টহল দেন বিজিবি সদস্যরা। কিন্তু কয়েক বছর ধরে সেই বাঁধের বিভিন্ন অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় যানবাহন ব্যবহার সম্ভব হয় না। হেঁটেই বিজিবি সদস্যদের টহল দিতে হয়। আর এই সুযোগকে কাজে লাগায় চোরাকারবারিরা।
র্যাব-৯ সিলেটের অধিনায়ক লে. কর্নেল আবু মুসা মো: শরীফুল ইসলাম নয়া দিগন্তকে বলেন, ইয়াবা পাচারকারীদের রুট পরিবর্তন হয়েছে এমন তথ্য আমাদের কাছে আছে। জকিগঞ্জ সীমান্ত দিয়ে ইয়াবাসহ মাদক বাংলাদেশে প্রবেশ করছে। র্যাবের পক্ষ থেকে টহলের ব্যবস্থা রয়েছে।
লে. কর্নেল আবু মুসা আরো বলেন, মাদককারবারিরা যে ধরনের কৌশলের আশ্রয় নেবে, নিয়ন্ত্রণে আমরাও সেই ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করব।


আরো সংবাদ



premium cement