০২ মে ২০২৪, ১৯ বৈশাখ ১৪৩১, ২২ শাওয়াল ১৪৪৫
`


নৌকাবাইচে প্রাণের উৎসব

মাঝ নদীতে হেইয়োরে হেইয়ো আওয়াজ তুলে ছুটে চলেছে নৌকা। কে কার আগে যেতে পারে সেই প্রতিযোগিতা মাঝিদের। মানিকগঞ্জে নৌকাবাইচের দৃশ্য: নয়া দিগন্ত -

এগিয়ে চলছে বাহারি আকৃতির নৌকা, নজরকাড়া পোশাকে মাঝি-মাল্লাদের সমবেত কণ্ঠের ‘হেইয়োরে হেইয়ো’ সারিগান। দু’পাড়ে হাজার হাজার দর্শকের অপলক দৃষ্টি আর মুহুর্মুহু চিৎকার-করতালি। প্রমত্তা নদীবক্ষে সঙ্গীতের-তাল-লয়ে মাঝি-মাল্লাদের বৈঠার ছন্দময় প্রতিযোগিতায় নদী-জল আন্দোলিত করার মনোমুগ্ধকর দৃশ্য। আবেগ-উত্তেজনার নৌকাবাইচ হয়ে ওঠে আপামর মানুষের নির্মল আনন্দের খোরাক। আর নদীর এই জলতরঙ্গের সাথে মানিকগঞ্জের মানুষের মিতালি আশৈশব। এ অঞ্চলের মানুষের নির্মল বিনোদনের অনুষঙ্গ নৌকাবাইচের রীতি-আচার বহু প্রাচীন।
পদ্মা, যমুনা, কালীগঙ্গা, ধলেশ্বরী, ইছামতি, কান্তাবতি বিধৌত মানিকগঞ্জের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতিতে নদী ও নৌকার সরব আনাগোনা। শত শত বছর ধরে এটি চলে আসছে। কিন্তু বর্তমান যান্ত্রিক যুগে এসে বাঙালির প্রাচীন এই ঐতিহ্য কিছুটা ম্লান হতে বসেছে। গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য সংরক্ষণে আমাদের সবাইকে সচেতন ও এগিয়ে আসার বিকল্প নেই বলে অভিমত ব্যক্ত করেন সংশ্লিষ্ট পৃষ্ঠপোষকরা।
একাধিক বাইচের নৌকার মালিক জানান, বাইচের নৌকা হয় সরু ও লম্বাটে। কারণ, সরু ও লম্বাটে নৌকা নদীর পানি কেটে দ্রুতগতিতে চলতে সক্ষম। বিভিন্ন আকৃতির নৌকা সমবেত হয় বাইচ প্রতিযোগিতায়। ছিপ, বজরা, ময়ূরপঙ্খি, গয়না, পানসি, কোষা, ডিঙ্গি, পাতাম, বাচারি, রফতানি, ঘাসি, সাম্পান ইত্যাদি নৌকাবাইচে অংশ নেয়। একেকটি লম্বায় প্রায় ১০০ থেকে ২০০ ফুট হয়। নৌকার সামনে সুন্দর করে সাজানো হয়। থাকে ময়ূরের মুখ, রাজহাঁসের মুখ বা অন্য পাখির মুখের অবয়ব। দৃষ্টিগোচর করতে নৌকাকে উজ্জ্বল রঙের কারুকাজ করা হয়।
নামকরণেও থাকে ভিন্নতা। হারানো মানিক, গায়না তরী, সোনার চান, মায়ের দোয়া, দুই ভাই, দাদা-নাতি,সোনার বাংলা, রিয়াদ এন্টারপ্রাইজ, হাজারি তরী, আল্লাহর দান, শোকচাঁন তরী, অগ্রদূত, ঝড়ের পাখি, পঙ্খিরাজ, ময়ূরপঙ্খি, সাইমুন, তুফানমেইল, জয়নগর, চিলেকাটা, সোনার তরী, দীপরাজ ইত্যাদি নাম। দর্শকরা দূর থেকে নৌকার অবয়ব থেকেই বলে দিতে পারে এটি কোন নৌকা।
এই মৌসুমে বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনায় মানিকগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় কমপক্ষে অর্ধশত বাইচ প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। ঘিওর উপজেলার কলতা কান্তাবতি নদীতে ২০০ বছরের ঐতিহ্য নৌকাবাইচ, হরিরামপুর উপজেলার ঝিটকা ইছামতি নদীতে, দৌলতপুর উপজেলার চকমিরপুর ইউনিয়নের সমেতপুর বিলে, শিবালয় উপজেলার আরুয়া ইউনিয়নের দড়িকান্দি-নয়াকান্দি ইছামতি নদীতে, হরিরামপুর উপজেলার সাপাই দিয়াবাড়ি বিল, সিঙ্গাইর উপজেলায় চান্দহরে ধলেশ্বরী, বলধারা রামকান্তপুর এবং ঘিওর উপজেলায় পেঁচারকান্দা-কুশুন্ডা-জাবরা এলাকায় ইছামতি নদীতে, মানিকগঞ্জ শহরের বেউথায় কালিগঙ্গা নদীতে, সদর উপজেলার বালিরটেক কালিগঙ্গা নদীতে অনুষ্ঠিত হয় নৌকা বাইচ প্রতিযোগিতা। রঙ বেরঙের বাহারি ধরনের নৌকা আর হাজারো উৎসুক দর্শকের ভিড়ে নদী হয়ে উঠে উৎসব মুখর। বাইচ দেখতে গ্রামকে গ্রাম, পাড়া-মহল্লা নাচিয়ে দূর-দূরান্ত এলাকার হাজার হাজার মানুষের আগমন ঘটে নদীর দু’পাড়ে।
ঘিওরের কুস্তা এলাকায় নৌকাবাইচ দেখতে আসা সাইফুল ইসলাম, রাকিব হোসেনও নাজমা আক্তার বলেন, করোনকালীন এই ঘরবন্দী অবস্থা থেকে হাঁপিয়ে উঠেছিলাম। নৌকাবাইচ দেখে আনন্দে মন ভরে গেছে।
জেলার ঘিওর সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান অহিদুল ইসলাম টুটুল বংশ পরম্পরার ঐতিহ্য ধরে রাখতে সুদৃশ্য বাইচেন নৌকা পৃষ্ঠপোষকতা করে আসছেন। তিনি বলেন, অনেক খরচাবলির পরও শখ আর ঐতিহ্য ধরে রাখতে তাদের এই আয়োজন।
শৌখিনতার বশে বাইচের নৌকা পরিচালনা করতে খরচ জোগাতে নিজের ১০ বিঘা জমি বিক্রি করার জনশ্রুতি রয়েছে উপজেলার বালিয়াখোড়া ইউনিয়নের জোকা এলাকার মরহুম হাজী সবেদ ফকিরের। তার বংশধর মো: আবুল কালাম আজাদ বলেন, তাদের নৌকার নাম ছিল হাজী সবেদ এন্টারপ্রাইজ। শুধু শৌখিনতা আর পারিবারিক ঐতিহ্য ধরে রাখতেই তার দাদা জমি-জিরাত বিক্রি করেছিলেন।
লোকজ ঐতিহ্য উন্নয়ন ও গবেষক মো: নজরুল ইসলাম বলেন, নৌকাবাইচ সমন্ধে মানিকগঞ্জের মানুষের মধ্যে জনশ্রুতি আছে, জগন্নাথ দেবের স্নানযাত্রার সময় স্নানার্থীদের নিয়ে বহু নৌকার ছড়াছড়ি ও দৌড়াদৌড়ি পড়ে যায়। এতেই মাঝি-মাল্লা-যাত্রীরা প্রতিযোগিতার আনন্দ পায়। এ থেকে কালক্রমে নৌকাবাইচের শুরু। অন্য একটি জনশ্রুতি হলো, আঠার শতকের শুরুর দিকে গাজী পীর মেঘনা নদীর একপাড়ে দাঁড়িয়ে অন্য পাড়ে থাকা তার ভক্তদের কাছে আসার আহ্বান করেন। ভক্তরা নৌকা নিয়ে মাঝনদীতে, শুরু হয় তোলপাড়। তখন চারপাশের যত সব নৌকা খবর পেয়ে ছুটে আসে। সারি সারি অজস্র নৌকা একে অন্যের সাথে পাল্লা দিয়ে ছুটে চলে। এ থেকেই নৌকাবাইচের গোড়াপত্তন হয়। আবার অনেকের মতেই, মুসলিম যুগের নবাব-বাদশাহদের আমলে নৌকাবাইচ বেশ জনপ্রিয় ছিল। নবাব বাদশাহদের নৌবাহিনী থেকেই নৌকাবাইচের গোড়াপত্তন হয়।
হরিরামপুরের কালোই এলাকার মাল্লার সর্দার ছিলেন আব্দুল করিম। তিনি বলেন, নৌকার মধ্যে ঢোল, তবলা, টিকারা নিয়ে গায়েনরা থাকেন। তাদের কণ্ঠে গানগুলো মাল্লাদের উৎসাহ আর শক্তি জোগায়। বাজনার তালে নৌকাবাইচে মাঝি-মাল্লারা একসুরে গান গেয়ে ছুটে চলেন। কোনো বৈঠা ঠোকাঠুকি না লেগে একসাথে পানিতে অভিঘাত সৃষ্টি করতে থাকে। গায়েন বা পরিচালক কাঁসার শব্দে এই বৈঠার এবং গানের গতি বজায় রাখতে সাহায্য করে।
বাইচের নৌকার মাল্লা ঘিওর উপজেলার রাধাকান্তপুর গ্রামের মুন্নাফ মোল্লা বলেন, নৌকায় ওঠার ক্ষেত্রে রয়েছে নানান আনুষ্ঠানিকতা। সকলে পাকপবিত্র হয়ে গেঞ্জিগায়ে মাথায় একই রঙের রুমাল বেঁধে নেয়। সবার মধ্যখানে থাকেন নৌকার নির্দেশক। প্রতিটি নৌকায় ৫০ থেকে ১০০ জন মাঝি থাকে। যে কেউই নৌকার মাঝি হতে পারবে না। মাঝি হতে হলে তাকে একটু হৃষ্টপুষ্ট হতে হয়। ছয় মাস আগ থেকেই বাছাই করা হতো মাঝিদের। নৌকা তৈরিতে শাল, শীল কড়ই, চাম্বুল, গর্জন ইত্যাদি কাঠ ব্যবহার করা হয়।
ঘিওর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও বিশিষ্ট ক্রীড়া পৃষ্ঠপোষক অধ্যক্ষ হাবিবুর রহমান হাবিব নৌকাবাইচের স্মৃতিচারণ করে জানান, আবহমান বাংলার লোকজ সংস্কৃতির অন্যতম ঐতিহ্য নৌকাবাইচ নানা প্রতিকূলতার পথ পাড়ি দিয়ে আজ ক্লান্ত। পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে হারিয়ে যেতে বসেছে মেহনতি মানুষের উৎসাহ-উদ্দীপনা আর আনন্দের নৌকাবাইচ। গ্রামবাংলার ঐতিহ্য সংরক্ষণে আমাদের সবাইকে সচেতন হতে হবে।


আরো সংবাদ



premium cement
যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দিলো ইরান বাসায় ফেরার পর যা জানালেন খালেদা জিয়ার চিকিৎসক ঋণ পুনঃনির্ধারণের নিয়ম মূল্যস্ফীতিকে বাড়িয়ে তুলছে : ড. ফরাস উদ্দিন ৪ মাসে ৮৩১ কোটি ডলার রেমিট্যান্স পেয়েছে বাংলাদেশ বকেয়া বিল পরিশোধ নিয়ে সরকারের অবস্থান জানতে আগ্রহী আইএমএফ সরিষাবাড়ীতে যুবতীর ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের ব্যাখ্যা দিল ব্র্যাক ব্যাংক সৌদি আরবের ৮০ কোম্পানি বাংলাদেশে বিনিয়োগে আগ্রহী : সালমান এফ রহমান ওমরার ভিসায় হজ করা যাবে না : সৌদি কর্তৃপক্ষ অবশেষে নারায়ণগঞ্জে স্বস্থির বৃষ্টি অবশেষে ঢাকায় একপশলা স্বস্তির বৃষ্টি

সকল