২১ মে ২০২৪, ০৭ জৈষ্ঠ ১৪৩১, ১২ জিলকদ ১৪৪৫
`


বুড়িগঙ্গার উৎকট গন্ধে দিশেহারা মানুষ

প্রতিদিনই এভাবে আবর্জনা ফেলা হয় বুড়িগঙ্গা নদীতে : নাসিম সিকদার -


রাজধানীবাসীর প্রাণের নদী বুড়িগঙ্গার দুর্গন্ধে দিশেহারা লাখ লাখ মানুষ। স্যুয়ারেজ লাইনের মুখে ‘ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট’ না থাকা, ইটিপিবিহীন কলকারখানা ও বাসাবাড়ির পচা আবর্জনায় নদীর এ দূষণ বাড়ছে। অভিযোগ রয়েছে, ইটিপিবিহীন ওইসব কারখানা থেকে নিয়মিত বখরা নিচ্ছে পরিবেশ অধিদফতরে অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী, পুলিশ ও স্থানীয় কিছু রাজনৈতিক নেতা।
জানা গেছে, বুড়িগঙ্গা নদীর অন্তত তিন শতাধিক পয়েন্ট দিয়ে প্রতিদিন ওয়াসা ও সিটি করপোরেশনের হাজার হাজার টন বর্জ্য পরিশোধন ছাড়াই নিক্ষিপ্ত হচ্ছে। এ ছাড়া পলিথিন ও প্লাস্টিক রিসাইক্লিং কারখানা বর্জ্য, শতাধিক ডায়িং কারখানার বর্জ্য এবং কেরানীগঞ্জের বাসাবাড়ির বর্জ্য গভীর রাতে ময়লার ভ্যান দিয়ে নদীতে ফেলায় এ দুর্গন্ধ আরো বাড়ছে। এমনকি ময়লা পানি ও দুর্গন্ধে নদীটিতে সাকার ফিশরাও নেই।
এ ছাড়া হাজারীবাগের কিছু চামড়া কারখানার দূষণের সাথে কামরাঙ্গীরচর, ইসলামবাগ, পোস্তা, লালবাগসহ নদীর পাড়ে অবস্থিত কয়েক শ’ পলিথিন ও প্লাস্টিক রিসাইক্লিং কারখানা, কেরানীগঞ্জের দুই শতাধিক ড্রাইং কারখানাসহ হাজারেরও অধিক বিভিন্ন কারখানা এবং শ্যামপুর, পাগলা-ফতুল্লা এলাকায় শত শত কারখানা থেকে ক্যামিকেল মিশ্রিত পানি নদীতে মিশে পানি দূষিত হচ্ছে।
বছরের পর বছর এসব কারখানা থেকে হাজার টন টন বর্জ্য নদীতে নিক্ষেপ করলেও নির্বিকার সংশ্লিষ্ট সংস্থা পরিবেশ অধিদফতর। এসব কারখানা থেকে টন টন বর্জ্য নদীতে নিক্ষেপ ও নদী। দু’পাড়ের গৃহস্থালির বর্জ্য, স্থাপনা ভাঙ্গা সুড়কি নদীতে নিক্ষেপ করা হচ্ছে। বুড়িগঙ্গায় সবচেয়ে বেশি বর্জ্য নিক্ষেপ করছে স্থানীয় সরকারের গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা ওয়াসা ও সিটি করপোরেশন ছাড়াও বিভিন্ন অবৈধ কলকারখানা।
সংস্থার ড্রেনের পানি পরিশোধনের পর নদীতে নিক্ষেপের বিধান থাকলেও এখন পর্যন্ত ঢাকায় বর্জ্য ট্রিটমেন্টের জন্য কোনো তরল বর্জ্য শোধনাগার স্থাপন করতে পারেনি ওয়াসা ও সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ।
স্থানীয়রা জানায়, বুড়িগঙ্গা নদী তীরের এলাকাজুড়ে উৎকট গন্ধ বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে। নদীপাড়ের মহল্লা থেকে ভ্যানগাড়িযোগে ময়লা এনে নদীতে ফেলা হচ্ছে। তা ছাড়া পানি বাড়ার সাথে সাথে ময়লা আবর্জনাও বেশি ফেলা হচ্ছে নদীতে। এমন হাজার হাজার কারখানা থেকে কেমিক্যাল মিশ্রিত তরল বর্জ্য ও বিভিন্ন সংস্থার ড্রেনেজ বর্জ্য দেদারছে নদীতে গিয়ে মিশছে।

এ ছাড়া নৌযানগুলো থেকে উপর্যুপরি পোড়া তেলসহ নানা বর্জ্য ফেলা হচ্ছে নদীতে। শুষ্ক মৌসুম শুরু হতেই এসব এলাকার মানুষ মশা-মাছির উপদ্রব ও বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। চর কালিগঞ্জ, জিনজিরা ও আগানগর এলাকার ব্যবসায়ী আরমান, কাদের, আলি, একরামসহ একাধিক ব্যক্তি বলেন, নদীর পানির অসহ্য দুর্গন্ধে এখানকার মানুষ দিশেহারা। বহুদূর পর্যন্ত গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে। তা ছাড়া সর্দি-কাশি, শ্বাসকষ্ট, ডেঙ্গুজ্বর সবসময় লেগেই থাকে। এসব সমস্যার কারণে কর্মচারীদের পেছনে অতিরিক্ত ব্যয় হয়। বাসা-বাড়িতে শিশু ও বৃদ্ধ মানুষের আরো বেশি সমস্যা হচ্ছে বলেও জানান তারা।
পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) সাধারণ সম্পাদক মেজবাহ উদ্দিন সুমন এ প্রতিবেদককে বলেন, পরিবেশ বাঁচাতে বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয় এবং সংশ্লিষ্ট দফতরকে সর্বোচ্চ উদ্যোগ নিতে হবে। এসব উদ্যোগের মধ্যে পরিবেশ ও নদীতে দূষিত বর্জ্য নিক্ষেপকারী কারখানাগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। এ ছাড়া সরকারি যেসব প্রতিষ্ঠান দূষণ করছে তাদেরও দূষণ রোধে যথাযথ কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। আর বুড়িগঙ্গাসহ ঢাকার চারপাশের নদীগুলোর মধ্যে যেসব সীমানা পিলার বসানো হয়েছে তার অধিকাংশই নদীর মাঝখানে বসানো হয়েছে। এসব পিলার স্যাটেলাইটের মাধ্যমে স্থাপন হলে সঠিক জায়গায় বসানো সম্ভব হবে এবং উচ্ছেদ উচ্ছেদ খেলা বন্ধ করে ভরাটকৃত জায়গা ড্রেজিং করে নদীর আগের অবস্থা ফিরিয়ে দিতে হবে। পাশাপাশি জনসচেতনতা বাড়াতে হবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
এদিকে, নদীতে সংযুক্ত স্যুয়ারেজ লাইনের মুখে ‘ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট’ না থাকায় কোটি কোট মানুষের মলমূত্র বুড়িগঙ্গার জলে মিশে। গত ১৮ মার্চ ওয়াইজঘাট এলাকায় একটি স্যুয়ারেজ লাইনের মুখে ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট তৈরি করে এ প্রকল্পের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী। গত এক বছরে প্রকল্পটির পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন ঘটেনি। ফলে ইতোমধ্যেই নদীর মিঠা পানির সুস্বাদু মাছ ও বিভিন্ন জলজপ্রাণীর মৃত্যু হয়েছে। প্রতি বছর বুড়িগঙ্গায় সাকার ফিশ নামে রাক্ষুসে মাছে টইটম্বুর থাকে। মাঝিদের বৈঠায়ও লাগে মাছের আঘাত। অথচ এ বছর এখনো কোনো সাকার মিলছে না। শতাধিক মাঝি এ প্রতিবেদককে বলেন, শুকনো মৌসুমে বুড়িগঙ্গায় সাকার মাছ থাকে না। এ সময়ে নদীর পানি কম থাকে এবং পানিতে দুর্গন্ধ থাকায় সাকার চলে যায় বড় নদীতে। তবে এ সময়ে সাকারের উৎপাত দেখা গেলেও ময়লা পানি এবং বেশি দুর্গন্ধ থাকায় এখনো মিলছে না সাকার। মাঝিরা জানান, রাতের আঁধারে কেরানীগঞ্জ মডেল টাউন ও ইস্পাহানি আবাসিক এলাকার হাজারখানেক বাড়ির ময়লা ও আবর্জনা ফেলছে নদীতে। ময়লা ফেলার জায়গা না থাকায় এমনটা করছে তারা।

এদিকে, আগানগর, চুনকুটিয়া, শুভাঢ্যা, চরকালীগঞ্জ, খেজুরবাগ, কালীগঞ্জ, হাসনাবাদ, দোলেশ্বর, খোলামুড়া, বরিশুর, মান্দাইল, জিনজিরা, আগানগর, ইস্পাহানি, কালীগঞ্জ, খেজুরবাগ, পটকা জোর, মাদারীপুর ও মীরেরবাগ। কদমতলী খালপাড় এলাকা ঘিরে গড়ে ওঠেছে শতাধিক ইটিপিবিহীন ডায়িং কারখানা। তার মধ্যে বারবার যাদের জেল জরিমানা করা হয়েছে, এসব কারখানার মধ্যে গ্লোবাল ওয়াশিং, আধুনিক ওয়াশিং, কালারটাচ ওয়াশিং, মায়ের দোয়া ওয়াশিং ডাইং, সততা ওয়াশিং ডাইং, রিমা ওয়াশিং প্লান্ট, সায়মা ওয়াশিং প্লান্ট, সানমুন ওয়াশিং প্লান্ট, গ্লোবাল ওয়াশিং ডাইং, শ্রাবণী ওয়াশিং ডাইং, এফ এম ওয়াশিং ডাইং, সারা প্রিন্টিং, ফোর স্টার ওয়াশিং প্লান্ট, আল বারাকা ওয়াশিং ডাইং ও বিসমিল্লাহ ডাইং প্লান্টসহ শতাধিক কারখানার বর্জ্য নিয়মিত বুড়িগঙ্গার পানিতে মিলছে। তাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে পরিবেশ অধিদফতর এবং উপজেলা প্রশাসন অভিযান চালালেও দুই তিন দিনের মধ্যে ফের অবৈধ কল কারখানাগুলো ঠিকই চলছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক কারখানা মালিক এ প্রতিবেদককে বলেন, পরিবেশ অধিদফতর কিংবা উপজেলা প্রশাসন বিভিন্ন সময়ে ম্যাজিস্ট্রেট দিয়ে অভিযান চালায় এবং জেল জরিমানা ও কারখানা সিলগালা করে দেয় তা ঠিক। তবে তারাই আবার খোলার অনুমতি দেয় এবং সুবিধা নেয়। তাহলে আমরা বিদ্যুৎ বিল ও গ্যাসবিল দেয়ার পরও মাসিক দৈনিক কিংবা সাপ্তাহিক চাঁদা দেই। আর এসব চাঁদা /ঘুষ নেয় পরিবেশ অধিদফতর এবং উপজেলার একটি সিন্ডিকেট। তারপরে আবার রংবাজদের চাঁদা। তারা বলেন, সরকারিভাবে ব্যবসা করার সুযোগ করে দিলে কেউ আর অবৈধভাবে কারখানা চালাবেন না।

কেরানীগঞ্জ উপজেলা ইউএনও মো: আবু রিয়াদ নয়া দিগন্তকে বলেন, ডিসি মহোদয়ের নির্দেশনা রয়েছে যাতে করে কোনো কলকারখানা ইটিপিবিহীন অবস্থায় চলতে না পারে। বুড়িগঙ্গা দূষণে জড়িতদের কোনোভাবে ছাড় দেয়া হবে না। ওইসব অপরাধীদের শাস্তি দিতে শিগগিরই অভিযানে নামবে উপজেলা প্রশাসন।
পরিবেশ অধিদফতর মহাপরিচালক ডক্টর আবদুল হামিদ নয়া দিগন্তকে বলেন, পরিবেশ দুষ্কৃতকারীদের ছাড় দেয়া হবে না। বিভিন্ন সময়ে অবৈধ কল কারখানার বিরুদ্ধে অভিযান চালায় পরিবেশ অধিদফতর। এ সময় জেল জরিমানাও করা হয়ে থাকে। তারপরও যদি কোনো কারখানা নদী দূষণে জড়িতের অভিযোগ মিলে তাহলে ওইসব কারখানার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে।
এসব বিষয়ে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান সারোয়ার মাহমুদ নয়া দিগন্তকে বলেন, কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে নদী রক্ষা কমিশন কাজ করছে। অচিরেই বুড়িগঙ্গার আদি চ্যানেলসহ অন্যান্য নদী দখল ও দূষণের কবল থেকে উদ্ধার হবে। তাই মনিটরিং করা হচ্ছে। এজন্য নদীরক্ষা কমিশনের নিজস্ব লোকবল, মেশনারিজ ও তদারকির ক্ষমতা বাড়ানো দরকার। তিনি বলেন, নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেট দিয়ে জেল জরিমানা করলেও ফের আবার ওইসব নদী দূষণ অপরাধীরা যাতে পার পেয়ে না যায় সে বিষয়ে কঠোর সিদ্ধান্ত নিচ্ছি। উল্লেখ্য, ২০১৭ সালে বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, শীতালক্ষ্যা ও বালু নদী দূষণমুক্ত এবং দখলদারের হাত থেকে বাঁচাতে জাতীয় নদী কমিশন, বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন সংস্থা বিআইডব্লিউটিএ, পরিবেশ অধিদফতর ও ঢাকা জেলা প্রশাসককে নিয়ে টাস্কফোর্স গঠন করা হয়। তবে তারা এ পর্যন্ত বুড়িগঙ্গাসহ চারটি নদীর দুই পাড় অবৈধ দখলমুক্ত করতে সক্ষম হলেও নদীগুলোর পানি দূষণমুক্ত করতে ব্যর্থ হয়েছে।


আরো সংবাদ



premium cement