২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

যতদূর চোখ যায় অথই সাগর

রাজপথের নির্দেশনা মেনে যান্ত্রিক বাহনের পরিবর্তে চলছে যাত্রীবাহী নৌকা। কালিয়াকৈর-বলিয়াদী সড়ক থেকে তোলা: নয়া দিগন্ত -

থই থই অথই পানি। ডুবে গেছে পথঘাট, বাড়িঘর টিনের চালা। রাজপথ, বাড়িঘরের উঠান ছাপিয়ে পানি ডুকেছে গ্রামের পর গ্রাম। যেটুকু চোখের পলক, ততটুকু যেন অথই সাগর। বানের পানিতে নষ্ট হয়েছে ফসলী জমি। সেখানে এখন বড়শি পেতে মাছ ধরে সময় কাটায় অবসর কৃষক। ঘরের ভেতরে-বাইরে মাচা পেতে গৃহস্থালি ও সংসারের জিনিসপত্র রক্ষায় ব্যস্ত সময় পার করছেন গৃহিণীরা। উপজেলা কিংবা জেলা শহরের সাথে যোগোযোগের একমাত্র পিচঢালা রাস্তাটিও বানের পানিতে ডুবে গেছে। যান্ত্রিক বাহনের পরিবর্তে অবিরত নৌকা চলছে সেখানে। যাত্রীবাহী বাস, সিএনজি, অটোরিকশা, বেবি টেম্পো আর মালবাহী ট্রাকের রোড সিগনালের নির্দেশনা মেনে চলা আঁকাবাঁকা সেই রাস্তায় এখন চলছে যাত্রী বোঝাই নৌকা। চালকের হাতের স্টিয়ারিংয়ের পরিবর্তে মাঝির হাতের লগি-বৈঠা যাত্রীকে পৌঁছে দিচ্ছে তার গন্তব্যে।
ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের কালিয়াকৈর বাইপাস থেকে সোজা দক্ষিণে বলিয়াদী হয়ে ধামরাই উপজেলা সদরের দিকে যে রাস্তাটি চলে গেছে সেটি বন্যায় ডুবে গেছে। জনবহুল এই এলাকার তিনটি উপজেলার শতাধিক গ্রামসহ রাস্তাঘাটও তলিয়ে গেছে বানের পানিতে। ঢাকা জেলার সাভার ও ধামরাই উপজেলা এবং গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার বেশির ভাগ গ্রাম ডুবে আছে কয়েক মাস ধরেই।
শহরের সাথে যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম ‘কালিয়াকৈর-বলিয়াদী-ধামরাই’ সড়কটি ডুবে যাওয়া বেশি বিপাকে পড়েছে এ এলাকার অর্ধশতাধিক গ্রামের কয়েক লাখ বাসিন্দা। ফলে নিত্যপ্রয়োজনীয় অতি সামান্য জিনিসপত্রের জন্যও গ্রামবাসীকে অন্তহীন দুর্ভোগের শিকার হতে হচ্ছে কয়েক মাস ধরেই। সময়মতো নৌকা না পেলে অতি জরুরি ওষুধপত্রের জন্য সাঁতরিয়ে যেতে হয় অনেক দূরে। আবার দোকানপাট কিংবা বাজারঘাটও তলিয়ে যাওয়ায় নৌকা ভাড়া করে দূরের উপজেলা সদরের বাজার থেকে সপ্তাহ কিংবা পনেরো দিনের বাজার একদিনেই ঘরে তুলে রাখছেন অনেকে।
গত দু’দিন বন্যাকবলিত এসব এলাকায় সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের অবর্ণনীয় দুঃখ-দুর্দশার চিত্র। বলিয়াদীর ঐতিহ্যবাহী পরিবার বকশী বাড়ির অর্ধশতাধিক পরিবার পানিবন্দী দীর্ঘ দিন ধরে। এই পরিবারগুলোর মধ্যে যারা ঢাকায় থাকেন সম্প্রতি কোরবানির ঈদের ছুটিতে বাড়িতে এসে তারাও প্রায় সবাই পানিবন্দী অবস্থায় রয়েছেন। দীর্ঘ দিন পর বাড়িতে এসে তারা গ্রামের অন্য আত্মীয়স্বজন কিংবা পাড়া-প্রতিবেশীদের সাথেও যোগাযোগ করতে পারছেন না। এরপরেও প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যেই কেউ কেউ নৌকা নিয়ে ছুটে বেড়িয়েছেন বন্ধুবান্ধব কিংবা আত্মীয়স্বজনদের খোঁজখবর নিতে। বকশী বাড়ির মাহবুব বকশী জানান, ১৯৮৮ সালের পর আমাদের এলকায় এমন বন্যা আর হয়নি। অর্থাৎ আমাদের নতুন প্রজন্ম এবারই প্রথম বন্যার এই ক্ষতির মধ্যে পড়েছে।
স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা যায়, এই এলাকায় বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সাহেববাজার, শ্রীফলতলী, বাজহিজলতলী, বলিয়াদী বাজার, জালশুকা, গোসাত্রা, শেওড়াতলী, ঢালজোড়া, নাওলা, সাজনধরা, ডুবাইল, কান্দিপাড়া এলাকা। এইসব এলাকার মধ্যে বলিয়াদী বাজার, ডুবাইল বাজার এবং ঢালজোড়া বাজারের ব্যবসায়ীরা বেশি বিপাকে পড়েছেন। অনেকের দোকানে কোমরপানি জমে নষ্ট হয়ে গেছে ব্যবসার মালপত্র। এ ছাড়া দোকানে পানি জমায় স্থানীয় অনেক দোকানি বেকার হয়ে গেছেন। পরিবার নিয়ে দিন কাটে তাদের নিদারুণ কষ্টের মধ্যে।
শিপলু বকশী এই প্রতিবেদককে জানান, রাজধানী শহর তথা ঢাকার অতি কাছে হওয়ার কারণে আমাদের জীবনযাত্রা সব সময়ই শহরমুখী। তা ছাড়া বন্যার সাথে জীবনযাপনে আমরা অভ্যস্তও নই। দেশের অনেক জেলা আছে সেখানকার মানুষ বন্যার সাথে মোকাবেলা করেই জীবনযাপন করেন। কিন্তু আমরা এমন পরিস্থিতির শিকার নিকট অতীতে আর হইনি। ফলে সব শ্রেণী-পেশার মানুষেরই দুঃখ-দুর্দশাও একটু বেশি। তবে আশার কথা হচ্ছে বন্যার পানি গত চার পাঁচ দিন ধরেই কমতে শুরু করেছে। পানি কমে গেলে হয়তো ঘরবাড়ি সংস্কার এবং রাস্তাঘাটের মেরামতের পর জীবন স্বাভাবিক হবে এ এলাকার লাখো জনগোষ্ঠীর।


আরো সংবাদ



premium cement