০৭ মে ২০২৪, ২৪ বৈশাখ ১৪৩১, ২৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`


আড়াই দশকেও হয়নি তিস্তার বাম তীরে প্রতিরক্ষা দেয়াল

পাউবোর বিরুদ্ধে মিথ্যা আশ্বাসের অভিযোগ স্থানীয়দের
তিস্তার ভাঙনে মানচিত্র থেকে হারিয়ে গেল রংপুরের গঙ্গাচড়ার লক্ষ্মীটারীর শংকরদহ গ্রাম : নয়া দিগন্ত -

‘একটা কতাতে কতা আসে। শুনচি আমরা মুরব্বির কাচে। যে বাড়িত ভাত নাই। বাপ গেইচে হাট আর মার কাছোত ছাওয়া কাইনতেছে, ভাত বুলি। তো মা খালি পানি পাতিলোত দিয়া জাল দ্যায়। ত্যা একন মা বইলতেছে বাবা দ্যাকো ভাত হইতেচে, খান এ্যালা। অমতন কইরতে কইরতে হামরা ঘুমি গেইলাম। দেকা গেলো দিনোতো উপাস, রাইতোতো উপাস। ড্যাগোত তো চাউলো নাই। মা আমাদেরকে বুজ দেয়। তদরূপ আমরা দেকতেচি পানি উন্নয়ন বোর্ড এবং কর্মকর্তা যারা একানে আইসে তারা আমাদের এইভাবে বুজ দিয়া চলি যায়। পরে বর্ষার সময় আমরা লালিত হয়ে যাই। কোতায় যাবো, কোতায় না যাবো, আমাদের বাড়িঘর মালামাল যেটা থাকে, গাছগাছলা মিলিয়া সব নদীর মইদ্যে বিলীন হয়া যায়। ত্যাকন আমরা অসহায় হয়া যাই।’ এভাবে এ প্রতিবেদককে কথাগুলো বলছিলেন রংপুরের গঙ্গাচড়ার লক্ষ্মীটারী ইউনিয়নের ১ নম্বর শংকরদহ ওয়ার্ডের সাবেক মেম্বার দুলাল মিয়া। তিনি ওই এলাকার চারণ সাংবাদিক মোনাজাত উদ্দিন আনন্দলোক বিদ্যালয়ের সভাপতি। গত শুক্রবার ভাঙনকবলিত ওই এলাকায় যখন দুলাল মিয়া কথাগুলো বলছিলেন আশপাশে শ’ খানেক মানুষ। তারাও শুনছিলেন এসব কথা। সূর্য তখন একেবারেই হেলে পড়েছে পশ্চিমে। লাল আভার বিচ্ছুরণ তিস্তার পানিতে মিশে তৈরি করেছে অন্য রকম এক দৃশ্য। কিন্তু সেই দৃশ্য মন কাড়েনি কারো।
দুলাল মিয়া আরো জানান, ‘এই ৫-৭ বছরকার মইদ্যে শংকরদহ ওয়ার্ডটা ভাঙলো। আমরা শুনি আসতেছি, দেকতেছি। এই পানি উন্নয়ন বোর্ড খরালির সময় আসি নাপ দেয়। আমরা জিজ্ঞাসা করি এলাকার লোক, এটা কিসের নাপেন আপনারা। তারা বলে যে এখানে পিচিং হবে, বোল্ডারের কাজ হবে, এই ইউনিয়নে এই ওয়ার্ডে। আর নদী ভাঙবে না। আমরাও অন্য কোথাও ব্যবস্থা না করিয়া নদীপারোত থাকি। ইনশাল্লাহ কাজ হবে, বলি গেইচে পানি উন্নয়ন বোর্ড। পরে কিছুতে কিছু নাই।’
সাংবাদিক মোনাজাত উদ্দিনের স্মৃতিবিজড়িত গঙ্গাচড়ার শংকরদহ গ্রামের সাবেক ইউপি সদস্যের এই উচ্চারণই বলে দেয়, তিস্তাপাড়ের মানুষ পানি উন্নয়ন বোর্ডের ওপর কতটা বিরক্ত। প্রায় ২৫ বছর ধরে শুধু মাপামাপি করলেও তিস্তার বামতীরে বন্যা নিয়ন্ত্রণে একটি সিসি ব্লকও ফেলেনি তারা। সব হারানো নিঃস্ব মানুষের হাহাকারে বাতাস ভারী এখন তিস্তাপাড়ে। সর্বশেষ একটি রাস্তা রক্ষায় পর্যাপ্ত জিওব্যাগের দাবিও পূরণ করেনি পাউবো। তিন দিন ওই এলাকায় ঘুরে জানা গেল, আড়াই দশক ধরে তিস্তার বামতীরে সিসি ব্লকের বন্যা প্রতিরোধ দেয়াল নির্মাণের দাবি থাকলেও আমলে নেয়নি পাউবো। সে কারণে তিস্তা গিলেই খেলো শংকরদহ গ্রামটি। যদিও শেষ বেলায় এসে পাউবো বলছে ফিজিবিলিটি স্টাডির কথা।
আলাপকালে লক্ষ্মীটারী ইউপির চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ আল হাদি জানান, রাস্তাটিতে ভাঙন শুরুর সাথে সাথেই আমি পানি উন্নয়ন বোর্ডকে একাধিকবার যোগাযোগ করে ২০ হাজার জিওব্যাগ ফেলার অনুরোধ করি। কিন্তু তারা শোনেননি। শেষ পর্যন্ত ডিসির কাছে দাবি করে একটি চিঠি দেই। তারাও শোনেননি। ফলে ১৯ তারিখে পানি বৃদ্ধির পর আর রাস্তাটি টেকানো গেল না। ডিসি সাহেব এসে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। স্থানীয়রা ডিসিসহ পানি উন্নয়ন বোর্ডকে বারবার অনুরোধ করেছেন। তারা শুনলেন না, সে কারণে রাস্তাটি চলে গেল।
ইউপি সদস্য আব্দুল মোন্নাফ জানান, শংকরদহ গ্রামে ৫৭০টি বাড়ি ছিল। তিন বছর ধরে ভাঙছে গ্রামটি। এক মাসের ব্যবধানে ১৫০টি বাড়ি ভেঙে গেছে। ৫০-৬০টি বাড়ি ছিল। তাও ১০ দিনের মধ্যে এলাকাবাসী সরিয়ে নিয়ে গেছেন। পুরো ওয়ার্ডটিই এখন ভেঙে গেল।
সরেজমিন দেখা গেছে, শংকরদহ গ্রামের পাশ দিয়ে একটি রাস্তা ছিল। গত ১০ দিনের ব্যবধানে শংকরদহ হাফেজিয়া মাদরাসা থেকে আশ্রয়ণ গুচ্ছগ্রাম পর্যন্ত প্রায় ৭০০ মিটার রাস্তাটি ভেঙে গেছে। এর মাধ্যমে ইতোমধ্যেই বিলীন হয়ে গেছে শংকরদহ গ্রামটির ৯০ ভাগ। ঘরবাড়ি জমিজিরেত হারিয়ে নিঃস্ব উদ্বাস্তু মানুষের বাড়ছে দীর্ঘশ্বাস। রাস্তাটি ভেঙে যাওয়ায় আরেকবার তিস্তার পানি বাড়লেই পানি চলে যাবে পূর্বে। এতে তলিয়ে যাবে পাশের পূর্ব ইচলি, পশ্চিম ইচলি, জয়রামওঝা, ইসবপুর, সিরাজুল মার্কেট এলাকা। বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে রংপুর-লালমনিরহাটের যাতায়াতের ব্যবস্থা। হুমকির মুখে পড়বে হাজার হাজার বসতবাড়ি, জমি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। অকেজো হয়ে যাবে শেখ হাসিনা সেতু।
অপর কৃষক মাইদুল ইসলাম জানালেন, ‘নদী অনেক দূরে ছিল। আইজ বান্দে কাইল বান্দে। এভাবে পানি উন্নয়ন বোর্ড আসে। কিন্তু তারা কোন কাজ করে না। প্রতি বছরই আইসে। কিন্তু কোন কাজ করে না।’ অপর শ্রমিক বাবু মিয়া জানান, ‘যা ভাঙার সেটাতো ভাইঙছে। এখন যা আছে, সেটা যেন থাকে। সেটাতে যেন হামরা ভালোভাবে থাইকতে পারি। এইটা আমরা চাই।’ বয়োবৃদ্ধ কৃষক আব্দুর রশিদ জানান, ‘ওই পাকে যেমন ব্লক দিয়ে বানদোন দিচে। এপাকেও বান্দ দিয়া ব্লক দিয়ে বানদোন দিতে হবে। তারপরে নদী শাসন কইরতে হবে।’
পানি উন্নয়ন বোর্ড রংপুরের নির্বাহী প্রকৌশলী মেহেদী হাসান জানান, শংকরদহ গ্রামটি ২০ বছরের পুরনো গ্রাম। এর আগে এখানে নদী ছিল। রাস্তাটি মেরামতের জন্য আমরা ৬ হাজার জিওব্যাগ ফেলেছি। কিন্তু আটকানো যায়নি। স্থানীয়দের চাহিদা অনুযায়ী সেখানে ২০ হাজার বস্তা ফেললে হয়তো আটকানো যেত। কিন্তু আমাদের সম্পদ সীমিত। সে কারণে অত পরিমাণ জিওব্যাগ দেয়া সম্ভব হয়নি।
তিনি বলেন, স্থানীয়দের দাবি অনুযায়ী আমরা একটা প্রপোজাল পাঠিয়েছিলাম মন্ত্রণালয়ে। ডিজাইন দফতর থেকে আমাদের বলা হয়েছে সেখানে ফিজিবিলিটি স্টাডি দরকার। কিছু দিন আগে জেলা পানিসম্পদ কমিটির বৈঠকেও ফিজিবিলিটি স্টাডির কথা বলা হয়েছে। বর্ষা মওসুম যাওয়ার পরপরই ফিজিবিলিটি স্টাডি করে সেখানে স্থায়ী সমাধানের জন্য কী করা যায় সেটি নিয়ে আমরা কাজ করছি।
রংপুরের ডিসি আসিব আহসান জানিয়েছেন, জেলা পানিসম্পদ কমিটির বৈঠকে শংকরদহসহ তিস্তার বামতীরে স্থায়ীভাবে প্রতিরক্ষার জন্য কী করা যায়, সে জন্য ফিজিবিলিটি স্টাডির তাগিদ দেয়া হয়েছে। আশা করি এই সমস্যার একটি স্থায়ী সমাধান হবে।

 


আরো সংবাদ



premium cement