৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ শাওয়াল ১৪৪৫
`


আওয়ামী লীগ চায় জয় বিএনপির লক্ষ্য পুনরুদ্ধার

রাজশাহী-৬ আসন
-

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে রাজশাহী-৬ (বাঘা-চারঘাট) আসনে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ ও মাঠের বিরোধী দল বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থী ও তাদের সমর্থকেরা এখন মাঠে সক্রিয় রয়েছেন। নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার পর সম্ভাব্য প্রার্থীদের তৎপরতা বেড়েছে। দলীয় মনোনয়ন কে পাবেন সে বিষয়টি এখনো চূড়ান্ত না হলেও সম্ভাব্য প্রার্থীদের সবাই দলীয় মনোনয়ন পাওয়ার ব্যাপারে আশাবাদী। এ জন্য দলীয় মনোনয়ন পেতে আগ্রহী নেতাদের অনেকেই এখন ঢাকায় অবস্থান করছেন। তারা কেন্দ্রীয় হাইকমান্ডের কাছে দেনদরবার ও লবিং চালিয়ে যাচ্ছেন। বিএনপি ও আওয়ামী লীগ থেকে দলীয় মনোনয়নপ্রত্যাশীরা দলীয় মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করে এরই মধ্যে জমাও দিয়েছেন।
রাজশাহী-৬ (বাঘা-চারঘাট) আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশীরা দলীয় মনোনয়ন ফরম উত্তোলন করে কেন্দ্র জমা দিয়েছেন। তারা হলেন- পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ও স্থানীয় এমপি শাহরিয়ার আলম, চারঘাট উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক এমপি রায়হানুল হক রায়হান, জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক লায়েব উদ্দিন লাভলু ও বাঘা পৌরসভার সাবেক মেয়র আওয়ামী লীগ নেতা আক্কাছ আলী।
এই আসনে বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশীরাও দলীয় মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেন এবং পরে তা কেন্দ্রে জমা দিয়েছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন- বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য, চারঘাট উপজেলা বিএনপির সভাপতি ও উপজেলা চেয়ারম্যান কারাবন্দী আবু সাঈদ চাঁদ, জেলা বিএনপির সহসভাপতি ও বিশিষ্ট শিল্পপতি বজলুর রহমান, জেলা বিএনপির সহসভাপতি ও বাঘা উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি নূরুজ্জামান খান মানিক, জেলা বিএনপির যুগ্ম সম্পাদক আনোয়ার হোসেন উজ্জ্বল। এ ছাড়া জেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক গোলাম মোস্তফা মামুন এ আসনে দলীয় মনোনয়নপ্রত্যাশী বলে জানা গেছে।
আগামী নির্বাচনে এ আসনটি থেকে জামায়াতের কোনো নেতা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন কিনা সে বিষয়টি এখনো চূড়ান্ত হয়নি। তবে নির্বাচনে প্রস্তুতির ক্ষেত্রে দলটির কোনো ঘাটতি নেই। এ ব্যাপারে জামায়াতের কেন্দ্রীয় হাইকমান্ডের পক্ষ থেকে যে নির্দেশনা দেয়া হবে সে অনুযায়ী নেতাকর্মীরা কাজ করবেন বলে স্থানীয় জামায়াতের একাধিক নেতা জানিয়েছেন।
আর জাতীয় পার্টির পক্ষ থেকে এ আসনে দুইজন মনোনয়নপ্রত্যাশী বলে জানা গেছে। তবে বাঘা-চারঘাটে জাতীয় পার্টির সাংগঠনিক অবস্থা একেবারে নড়বড়ে।
বাঘা ও চারঘাট উপজেলা মিলে রাজশাহী-৬ আসন গঠিত। এই দু’টি উপজেলায় মোট ১৩টি ইউনিয়ন রয়েছে। এর মধ্যে বাঘা উপজেলায় সাতটি ও চারঘাট উপজেলায় ছয়টি ইউনিয়ন। এ ছাড়া বাঘা উপজেলায় দু’টি পৌরসভা (বাঘা ও আড়ানী) এবং চারঘাট উপজেলায় একটি পৌরসভা (চারঘাট) রয়েছে।
স্থানীয়রা বলছেন, এই দু’টি উপজেলায় রাজনৈতিকভাবে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর নেতাকর্মী ও সমর্থকদের আধিক্যই বেশি। ফলে স্থানীয় সরকার পর্যায়ে ও বিগত সংসদ নির্বাচনগুলোতে বেশির ভাগই বিএনপি ও জামায়াত সমর্থিত প্রার্থীরা জয় পেয়েছেন। এমনকি আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকা অবস্থাও এই দু’টি উপজেলায় বিএনপি ও জামায়াত সমর্থিত প্রার্থীরা উপজেলা চেয়ারম্যান ও পৌরসভার মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন। এ ছাড়া বর্তমান ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানদের বেশির ভাগই বিএনপি-জামায়াত সমর্থিত। স্বৈরাচার এরশাদ সরকারের পতনের পর ১৯৯১ সালের সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী ডা: মো: আলাউদ্দিনকে (নৌকা প্রতীক) পরাজিত করে বিএনপি মনোনীত প্রার্থী আজিজুর রহমান (ধানের শীষ প্রতীক) এমপি নির্বাচিত হন। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে বিএনপি মনোনীত প্রার্থী আজিজুর রহমান (ধানের শীষ প্রতীক) এমপি নির্বাচিত হন। ১৯৯৬ সালের আরেকটি সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে আওয়ামী লীগের তৎকালীন প্রেসিডিয়াম সদস্য ডা: মো: আলাউদ্দীন আওয়ামী লীগ ত্যাগ করে বিএনপিতে যোগ দেন। এরপর তিনি বিএনপি মনোনীত প্রার্থী হিসেবে এই নির্বাচনে অংশ নিয়ে এমপি নির্বাচিত হন। তবে তিনি বিএনপি থেকে এমপি নির্বাচিত হয়ে পরে আবার আওয়ামী লীগে ফিরে যান এবং আওয়ামী লীগের ঐকমত্যের সরকারের পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী হয়েছিলেন। এখানে উল্লেখ্য, কিছু দিন পরে ডা: আলাউদ্দিনের মৃত্যু হলে তার শূন্য আসনে উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী রায়হানুল হক রায়হান এমপি নির্বাচিত হন। আর আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী নূরুল ইসলাম ঠাণ্ডু নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে পরাজিত হন। পরে ২০০১ সালের সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী রায়হানুল হককে পরাজিত করে বিএনপি মনোনীত প্রার্থী অ্যাডভোকেট কবির হোসেন (ধানের শীষ প্রতীক) এমপি নির্বাচিত হন।
ধারাবাহিকভাবে বিএনপির এই বিজয় অব্যাহতভাবে চলে এলেও এর ব্যত্যয় ঘটে ২০০৮ সালের নির্বাচনে। এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী শাহরিয়ার আলম এমপি নির্বাচিত হন। এরপর ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির প্রায় ভোটারবিহীন নির্বাচনে আবারো এমপি নির্বাচিত হন আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী শাহরিয়ার আলম।
অবশ্য এর আগে ১৯৭৯ সালের নির্বাচনেও আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী ডা: মো: আলাউদ্দিনকে (নৌকা প্রতীক) পরাজিত করে বিএনপি মনোনীত প্রার্থী মোকসেদ আলী এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন। আর ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী ডা: আলাউদ্দিনকে পরাজিত করে এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন জাতীয় পার্টির প্রার্থী নূরুন্নবী চাঁদ।
দলীয় ও স্থানীয় একাধিক সূত্র জানায়, এ আসনে মনোনয়ন দৌড়ে ও প্রচারণায় পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ও স্থানীয় এমপি শাহরিয়ার আলম এগিয়ে রয়েছেন। মনে করা হচ্ছে, এবারো তিনিই দলীয় প্রার্থী হতে পারেন। তবে এবার তিনি প্রার্থী হলে তাকে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হতে পারে। দলের ভেতরে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের কারণে এবার এই আসনটি আওয়ামী লীগের হাতছাড়া হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। কারণ পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ও বর্তমান এমপি শাহরিয়ার আলমের সাথে দলটির মনোনয়নপ্রত্যাশী অন্য তিনজন নেতার দ্বন্দ্ব এখন প্রকাশ্য রূপ নিয়েছে। সম্প্রতি ৩ নভেম্বর জেলহত্যা দিবস উপলক্ষে পৃথক কর্মসূচির মাধ্যমে এক ধরনের শোডাউন দেয়া হয় বাঘা উপজেলা চত্বরে। একদিকে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ও বর্তমান এমপি শাহরিয়ার আলম ও তার সমর্থিত নেতাকর্মীরা সভা করেন। অন্যপক্ষে মনোনয়নপ্রত্যাশী অন্য তিনজন স্থানীয় প্রভাবশালী নেতা পৃথকভাবে সভা করেন। তাই উভয়পক্ষের দ্বন্দ্ব নিরসন না হলে এবার এ আসনে জয় পেতে আওয়ামী লীগকে চরম বেগ পেতে হবে বলে মনে করছেন ভোটার ও সংশ্লিষ্টরা।
পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমের অনুসারীরা ও আওয়ামী লীগের তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীরা বলছেন, আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকাবস্থায় বাঘা-চারঘাটের অনেক উন্নয়ন হয়েছে। তাই উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে ভোটাররা আবারো আওয়ামী লীগের প্রার্থীকেই ভোট দিয়ে বিজয়ী করবেন। তারা বলেন, এ আসনে আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী যাকেই করা হোক নেতাকর্মীরা তার পক্ষেই কাজ করবেন।
বিএনপি নেতাকর্মীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, বিএনপি নেতা আবু সাঈদ চাঁদ আগামী সংসদ নির্বাচনে দলীয় মনোনয়নপ্রত্যাশী। তিনি পরপর মোট পাঁচবার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। এর মধ্যে ইউনিয়ন পরিষদে পরপর তিনবার, আর উপজেলা পরিষদে দুইবার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। বর্তমানে তিনি দ্বিতীয় মেয়াদে উপজেলা চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তবে জনপ্রিয়তা ও বিগত আন্দোলন কর্মসূচিতে সক্রিয় ভূমিকা পালনের কারণে এবার বিএনপি নেতা চাঁদ দলীয় মনোনয়ন পাবেন বলে নেতাকর্মীরা আশা করছেন। রাজনৈতিক মামলায় গ্রেফতার হয়ে কয়েক মাস থেকে তিনি রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দী রয়েছেন।
স্থানীয় বিএনপির একাধিক নেতা বলেন, এ আসনে যোগ্য ও জনপ্রিয় প্রার্থী মনোনয়নের ওপরই নির্ভর করছে বিএনপির জয়-পরাজয়। তাই তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীদের মতামত নিয়ে প্রার্থী মনোনয়ন দিতে হবে। অন্যথায় বিএনপির ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত এই এলাকা আওয়ামী লীগের দখলে চলে যাবে। তারা আরো বলেন, দলমত নির্বিশেষে সবার কাছে জনপ্রিয় নেতা হলেন বিএনপি নেতা আবু সাঈদ চাঁদ। তাই তাকে প্রার্থী করা হলে বিপুল ভোটে বিজয়ী হবেন ইনশা আল্লাহ। তারা বলেন, জনপ্রতিনিধি ও রাজনৈতিক নেতা হিসেবে বিএনপি নেতা চাঁদ এলাকার অনেক উন্নয়ন করেছেন, মানুষের সুখ-দুঃখে পাশে দাঁড়িয়েছেন। নানা সহযোগিতা করেছেন। তাই তিনি প্রার্থী হলে ভোটাররা তাকে বিপুল ব্যবধানে নির্বাচিত করবেন।
বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশী আরেক নেতা হলেন- জেলা বিএনপির সহসভাপতি ও বিশিষ্ট শিল্পপতি বজলুর রহমান। বজলুর রহমানের সমর্থকেরা বলছেন, দলীয় নেতাকর্মীসহ এলাকাবাসীর সাথে নিবিড় যোগাযোগ রাখেন তিনি। দলীয় নেতাকর্মীদের সাথে নিয়ে বজলুর রহমান দীর্ঘ দিন ধরে মাঠে সক্রিয় রয়েছেন। এলাকার মানুষের সুখদুখে পাশে থাকেন সব সময়। তাই দলীয় মনোনয়ন পেলে বজলুর রহমান বিপুল ভোটে এমপি নির্বাচিত হবেন বলে তার অনুসারীরা আশা করছেন।
এই আসনে দলীয় মনোনয়নপ্রত্যাশী জেলা বিএনপির সহসভাপতি ও বাঘা উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি নূরুজ্জামান খান মানিক। দলীয় মনোনয়ন পেলে বিপুল ভোটে এমপি নির্বাচিত হবেন বলে আশা বিএনপি নেতা মানিকের।
এ ছাড়া জেলা বিএনপির যুগ্ম সম্পাদক আনোয়ার হোসেন উজ্জ্বলও দলীয় মনোনয়নপ্রত্যাশী। বিএনপি নেতা উজ্জ্বলের সমর্থকেরা বলছেন, বিগত আন্দোলন কর্মসূচিতে তিনি সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন। আগামী নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন পেলে বিএনপি উজ্জ্বল বিপুল ভোটে এমপি নির্বাচিত হবেন বলে তারা আশা করছেন।
বিএনপির তৃণমূল নেতাকর্মীরা বলছেন, বিগত সময়ে দলের দুঃসময়ে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন, বিগত আন্দোলন কর্মসূচিতে মাঠে ছিলেন, তৃণমূল নেতাকর্মীদের মূল্যায়ন করেন এমন যোগ্য ও ত্যাগী নেতাকে প্রার্থী মনোনয়ন দিতে হবে। তারা আরো বলেন, দলীয় নেতাকর্মী ও সমর্থকসহ এলাকাবাসীর সাথে যোগাযোগ রাখেন, তাদের সুখদুখে পাশে দাঁড়ান, ক্লিন ইমেজ রয়েছে, বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত নন এবং জনপ্রিয়তা রয়েছে এমন নেতাকে প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন দিতে হবে। তবেই এই আসনটিতে জয় পাওয়া সম্ভব হবে।
তারা বলেন, ইতঃপূর্বে বিএনপি মনোনীত প্রার্থী বারবার এই আসনটি থেকে এমপি নির্বাচিত হয়েছেন। তাই প্রার্থী মনোনয়নে তৃণমূলের মতামত প্রাধান্য দিলে আবারো এ আসনটি পুনরুদ্ধার করা সম্ভব বলে তারা মনে করেন।

 


আরো সংবাদ



premium cement