২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`


নগর পরিকল্পনাবিদদের অভিমত

নীতি ও পরিকল্পনা প্রণয়নে গোষ্ঠীস্বার্থকে প্রাধান্য না দিলে অগ্নিঝুঁকি কমে যাবে

-


ভবন নির্মাণে নীতি ও পরিকল্পনা প্রণয়নে গোষ্ঠীস্বার্থকে প্রাধান্য না দিলেই অগ্নিঝুঁকি কমে যাবে। সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন স্থানে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ও ক্ষয়ক্ষতির পেছনে নগর সংস্থাগুলোর তদারকি, নজরদারি ও সার্বিক সুশাসনের ব্যর্থতাই দায়ী। পাশাপাশি নগর ব্যবস্থাপনায় সার্বিক সমন্বয়হীনতায়ও অগ্নি দুর্ঘটনার মতো ঘটনা ঘটে। গতকাল শুক্রবার ইনস্টিটিউট অব প্লানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টে আয়োজিত জুম প্ল্যাটফর্মের আলোচনায় নগর পরিকল্পনাবিদরা তাদের মতামত রাখছিলেন। তারা বলেন, নানা ধরনের দুর্ঘটনায় নগর ও প্রশাসন সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংস্থার গাফিলতি রয়েছে, ঠিক তেমনি সঠিক নগর পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনার অভাব এবং স্বার্থান্বেষী মহলের অনুকূলে নীতি কৌশল প্রণয়নও এ জন্য দায়ী।
আলোচনায় পরিকল্পনাবিদরা বলেন, সুষ্ঠু নগর পরিকল্পনা, ভবনের টেকসই ডিজাইন, নির্মাণ ও ব্যবস্থাপনা, ভবনের সঠিক ও অনুমোদিত ব্যবহার, অগ্নি প্রতিরক্ষা, ভবন মালিকের সচেতনতা ও দায়িত্বশীল আচরণ এবং নগর সংস্থাগুলোর নিয়মিত তদারকি থাকলে অগ্নিদুর্ঘটনা ও ক্ষয়ক্ষতি কমানো সম্ভব। আইপিডি ‘গাজীপুরের কালিয়াকৈর, ঢাকার বেইলি রোডসহ নগরে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা : নগর পরিকল্পনা ও নীতি কৌশলের দায়’ শীর্ষক আলোচনার আয়োজন করে।
আইপিডি বলছে, জনগণের জীবনের নিরাপত্তা ও ঝুঁকির বিষয়টি বিবেচনায় না নিয়েই আবাসিক পর্যায়ে পাইপভিত্তিক গ্যাস সংযোগ বন্ধ করে দিয়ে সিলিন্ডারভিত্তিক গ্যাসকে উৎসাহিত করা হয়েছে। যদিও আবাসিক গ্যাস ব্যবহার মোট ব্যবহারের ১০ শতাংশ মাত্র। তারা বলেন, সিলিন্ডার ব্যবসায়ীদের গোষ্ঠীস্বার্থের কাছে জাতীয় স্বার্থ জলাঞ্জলি দেয়া হয়েছে, ফলে সিলিন্ডার থেকে বিস্ফোরণ হচ্ছে। পাশাপাশি অবৈধ গাসলাইনের কারণেও বাড়ছে অগ্নিঝুঁকি। এ ছাড়া ভবনে নিম্নমানে ইলেকট্রিক সামগ্রীর যথেচ্ছ ব্যবহার ও আবাসিক এলাকায় রাসায়নিক গুদাম জীবনের ঝুঁকি অনেক গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। এই বাস্তবতায় অগ্নিঝুঁকি কমাতে কার্যকর নগর ও ভবন নির্মাণ পরিকল্পনা এবং ব্যবস্থাপনা প্রয়োজন বলে সুপারিশ করেছে আইপিডি।
অনুষ্ঠানের মূল প্রবন্ধে আইপিডির পরিচালক অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, রাষ্ট্রের মনোযোগ বেশি প্রকল্প ও অবকাঠামো নির্মাণে। কিন্তু একটা রাষ্ট্র দাঁড়িয়ে থাকে সুশাসনের ওপর। সুশাসনেই মানুষের জীবন বেশি নিরাপদ হয়ে থাকে। ভবনের নিরাপত্তাও সুশাসনের সাথে সম্পর্কিত। কিন্তু বর্তমানে সর্বক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে সুশাসনে আগ্রহ বাড়েনি। তিনি বলেন, গোষ্ঠীস্বার্থে পরিকল্পনা ও নীতি কৌশল পরিবর্তন আনার কারণে অগ্নিঝুঁকি বাড়ছে ক্রমাগত। সিলিন্ডার ব্যবসার পরিধি বাড়লো, বহুতল ভবনের উচ্চতা ছয় তলার পরিবর্তে ১০ তলার বেশি করা হলো। এসব সিদ্ধান্ত যারা পরিবর্তন করে তারাই রাষ্ট্রের শক্তিশালী জায়গায় অবস্থান করছে। মানুষের নিরাপত্তাই রাষ্ট্রে প্রাধান্য পাওয়া উচিত।

অধ্যাপক আদিল বলেন, ভবনের বিপজ্জনক মিশ্র ব্যবহার সম্পূর্ণ বন্ধ করতে হবে। প্রযোজ্য ক্ষেত্রে উলম্ব বা ভার্টিক্যাল মিশ্র ব্যবহার না করে আনুভূমিক (হরাইজন্টাল) মিশ্র ব্যবহার নীতি গ্রহণ করতে হবে। অনুমোদনহীন এবং ভূমি ব্যবহার নির্দেশনার ব্যত্যয় ঘটিয়ে শিল্প কারখানা স্থাপনের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ এবং শিল্প জোনে কারখানা স্থাপন নিশ্চিত করার যথাযথ উদ্যোগ নেয়ার পরামর্শ দেন তিনি। ফায়ার সার্ভিসের প্রতিবেদন অনুযায়ী ঝুঁকিপূর্ণ ও অতিঝুঁকিপূর্ণ ভবন শনাক্ত করা হলেও তা সিলগালা বা খালি করার কার্যকর উদ্যোগ নিতে দেখা যায় না। বহুতল ভবনের ক্ষেত্রে দুটি সিঁড়ি ও বহির্গমন পথ থাকার কথা, কিন্তু দেখা যায় কোনো কোনো ক্ষেত্রে থাকলেও তা স্টোর রুম হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
আইপিডির উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. আকতার মাহমুদ বলেন, আমাদের দেশের আবহাওয়া ও জলবায়ুকে মাথায় রেখেই নগর পরিকল্পনা ও ভবনের নকশা করতে হবে। নগরকে নিরাপদ করতে অসংগতিপূর্ণ মিশ্র ব্যবহার পরিহার করতে হবে। বিএনবিসি বাস্তবায়নে বাংলাদেশ বিল্ডিং রেগুলেটরি অথরিটি (বিবিআরএ) গঠন করার সুপারিশ করেন তিনি।
রাজউকের প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ মো: আশরাফুল ইসলাম বলেন, আমরা সিঙ্গাপুর ও হংকং-এর মতো বহুতল ভবন বানাতে আগ্রহী, অথচ ভবনের আশপাশে পর্যাপ্ত জায়গা ছাড়তে রাজি নই। সেসব শহরে ব্লকভিত্তিক উন্নয়নের মাধ্যমে অগ্নিনিরাপত্তা নিশ্চিত করেই বহুতল ভবন বানায়, আর আমরা সরু গলির ভেতরে এ উঁচু ভবন বানিয়ে শহরকে অনিরাপদ বানিয়ে ফেলেছি। নগরকে নিরাপদ করতে রাজউকের যেমন দায় আছে, পেশাজীবীদেরও অনুরূপ দায় আছে।

 


আরো সংবাদ



premium cement