১৫ মে ২০২৪, ০১ জৈষ্ঠ ১৪৩১, ০৬ জিলকদ ১৪৪৫
`


মিয়ানমারের সেনাবাহিনী কি ক্ষতি কাটিয়ে উঠছে?

মিয়ানমারের সেনাবাহিনী কি ক্ষতি কাটিয়ে উঠছে? - সংগৃহীত

থাইল্যান্ড সীমান্তে বিদ্রোহীদের সাথে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর যুদ্ধের ফলাফল দ্রুত গতিতে পাল্টে যাচ্ছে।

মায়াওয়াদ্দিতে নিজেদের ঘাঁটির নিয়ন্ত্রণ হারানোর দুই সপ্তাহ পর জান্তা সরকারের সৈন্যরা সেটি পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছে।

মিয়ানমারের অন্যান্য অনেক জায়গায় দেশটির সামরিক বাহিনীর সদস্যরা বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর কাছে একের পর এক পরাজয়ের সম্মুখীন হয়েছে।

সেখানে মিয়ানমার ও থাইল্যান্ডের মধ্যকার গুরুত্বপূর্ণ সীমান্ত মায়াওয়াদ্দিতে তারা বেশ শক্তভাবেই আধিপত্য টিকিয়ে রেখেছে বলে আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে।

যদিও প্রকৃত চিত্রটা সাধারণ এই বর্ণনার চেয়েও অনেক বেশি জটিল।

চলতি মাসের শুরুর দিকে মিয়ানমারের সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠী কারেন ন্যাশনাল ইউনিয়ন (কেএনইউ) মায়াওয়াদ্দির কাছাকাছি অবস্থিত দেশটির সামরিক বাহিনীর সমস্ত ঘাঁটি অনেকটা আকস্মিকভাবেই দখল করে নেয়।

তিন বছর আগে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে জান্তা সরকার ক্ষমতা দখলের পর দেশটিতে শুরু হওয়া গৃহযুদ্ধে এটি ছিল একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা।

কেন না, এই সীমান্ত দিয়েই থাইল্যান্ডের সাথে মিয়ানমারের বেশিরভাগ বাণিজ্য সংঘটিত হয়ে থাকে। তাছাড়া ওই এলাকায় বেশ কিছু বড় এবং লাভজনক ক্যাসিনোও রয়েছে।

কাজেই কয়েক দশকের মধ্যে প্রথমবারের মতো ওই শহরের নিয়ন্ত্রণ নেয়াটা মিয়ানমারের সবচেয়ে পুরনো বিদ্রোহী গোষ্ঠী কেএনইউ’র জন্য একটি বড় পাওয়া ছিল।

যদিও বিদ্রোহী গোষ্ঠীটি সেই অর্থে কখনোই মায়াওয়াদ্দির নিয়ন্ত্রণ পুরোপুরি নিতে পারেনি।

আরেক বিদ্রোহী গোষ্ঠী পিপলস ডিফেন্স ফোর্সেসের (পিডিএফ) যোদ্ধাদের সহযোগিতায় তারা কেবল জান্তা বাহিনীর ২৭৫ নম্বর সেনা ঘাঁটির নিয়ন্ত্রণ নিতে সক্ষম হয়েছিল, যেটি মূলতঃ মূল শহরের বাইরে অবস্থিত।

দখল নেয়ার পর তারা আগেরই পুলিশ, অভিবাসন এবং স্থানীয় সরকারি কর্মকর্তাদের মাধ্যমেই শহর পরিচালনা এবং সীমান্তের বাণিজ্যিক কার্যক্রম চালু রেখেছিল।

ওই এলাকার দখল নেয়ার সময় কারেন বিদ্রোহীরা বেশ সতর্ক ছিল।

এর একটি কারণ হলো- ওই অঞ্চলে তাদের জনগোষ্ঠী লোকদের নিয়ে গঠিত একটি আধা-সামরিক বাহিনীর উপস্থিতি রয়েছে, যারা কিছুদিন আগ পর্যন্তও জান্তা সরকারের মিত্র ছিল।

কাজেই একই জনগোষ্ঠীর লোকেদের সাথে সংঘর্ষ এড়ানোর বিষয়টিকেই অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছিলেন সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠী কারেন ন্যাশনাল ইউনিয়নের (কেএনইউ) নেতারা।

মায়াওয়াদ্দিতে কারেন জনগোষ্ঠীর আধা-সামরিক বাহিনীর মধ্যে সবচেয়ে বড় দলটি নিজেদের কারেন ন্যাশনাল আর্মি (কেএনএ) বলে থাকে।

এই বাহিনীর নেতৃত্বে রয়েছেন স চিট থু নামের একজন যুদ্ধবাজ ব্যক্তি, যিনি গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকে বিদ্রোহী গোষ্ঠী কেএনইউ থেকে বের হয়ে আসেন।

থাইল্যান্ড সীমান্তের শ্বে কোক্কো ক্যাসিনো কমপ্লেক্সের পুরোটাই তার নিয়ন্ত্রণে। এই ক্যাসিনোর বিরুদ্ধে অর্থ কেলেঙ্কারির নানান অভিযোগ রয়েছে।

বলা হয়ে থাকে যে- এই ক্যাসিনো ব্যবসা থেকে থু মোটা অঙ্কের অর্থ সংগ্রহ করে থাকেন, যা দিয়ে তিনি কয়েক হাজার যোদ্ধাকে অনায়াসেই ভালো বেতন দিতে পারেন।

তার ব্যক্তিগত এই বাহিনীই ২০১০ সাল থেকে জান্তা সরকারের হয়ে কাজ করে আসছে। এক যুগেরও বেশি সময় ধরে থাইল্যান্ড সীমান্তে তারা মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী হিসাবে দায়িত্ব পালন করে আসছিল।

কিন্তু গত জানুয়ারিতে অনেকটা হঠাৎ করেই জান্তা সরকারের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করার ঘোষণা দেন স চিট থু।

যদিও কারেন বিদ্রোহীরা অভিযোগ করেছে যে- আত্মসমপর্ণের ভয়ে ২৭৫ নম্বর ব্যাটালিয়নের ঘাঁটি থেকে পালানো জান্তা সরকারের সৈন্যদেরকে থু সাহায্য করছেন।

মায়াওয়াদ্দি দখলের সময় কেএনইউ’য়ের সতর্কতা অবলম্বন করার আরেকটি কারণ ছিল জান্তা সরকারের শক্তিশালী বিমান বাহিনী।

মিয়ানমানের অনেক এলাকায় স্থল বাহিনী পরাজিত হওয়ার পর হারানো ভূমির দখল ফিরে পেতে অতীতে বিমান বাহিনীকে দিয়ে হামলা চালানোর নজির জান্তা সরকারের রয়েছে।

এমনকি, গত সপ্তাহের শেষের দিকে এমআই৩৫ হেলিকপ্টার এবং ওয়াই১২ যুদ্ধবিমান ব্যবহার করে মায়াওয়াদ্দিতে কারেন বিদ্রোহীদের উপর বোমাবর্ষণ করেছে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী।

ওই হামলায় বিদ্রোহী গোষ্ঠীটির বহু যোদ্ধা হতাহত হয়েছে। এছাড়া হামলার ভয়ে ওই এলাকার হাজার হাজার মানুষ সীমান্ত পাড়ি দিয়ে থাইল্যান্ডে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে।

কারেন বিদ্রোহীদের বেশকিছু সূত্র থেকে এটাও বলা হয়েছে যে- থাইল্যান্ডের সামরিক বাহিনী থেকেও তাদেরকে বলা হয়েছে যেন মায়াওয়াদ্দিতে বড় ধরনের যুদ্ধ না চালানো হয়।

কেন না, তাতে দু’দেশের বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং থাইল্যান্ডে মিয়ানমারের শরণার্থীদের সংখ্যা বেড়ে যাবে।

সেকারণে ইতোমধ্যেই দখলকৃত ২৭৫ নম্বর সামরিক ঘাঁটি ছেড়ে আসার জন্য যোদ্ধাদের প্রতি নির্দেশনা দেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন কারেন বিদ্রোহীদের নেতারা।

মায়াওয়াদ্দিতে যুদ্ধ এড়ানোর নির্দেশনা দেয়া হলেও শহরটি থেকে ৩০ কিলোমিটার পশ্চিমে অবশ্য একটি বড় যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে কারেন বিদ্রোহীরা।

এদিকে, মায়াওয়াদ্দিতে পরাজিত হওয়ার পর সেটি পুনরুদ্ধারে সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগ করার জন্য নির্দেশ দিয়েছিল জান্তা সরকার।

বিদ্রোহীদের হটিয়ে থাইল্যান্ড সীমান্তের মূল পথটির নিয়ন্ত্রণ নিতে অসংখ্য সাঁজোয়া যান এবং ভারী অস্ত্রশস্ত্র সজ্জিত একটি গোলান্দাজ বাহিনীও পাঠানো হয়েছে।

গত বছরের অক্টোবরে মিয়ানমারের শান রাজ্য থেকে শুরু হওয়া জাতিগত বিদ্রোহীদের হাতে একের পর এক পরাজয়ের পর এটিই ছিল জান্তা সরকারের সবচেয়ে বড় পাল্টা হামলার প্রচেষ্টা।

অভিযান পরিচালনা এবং সীমান্তের যোগাযোগ পুনঃস্থাপন করতে মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর দ্বিতীয় প্রভাবশালী জেনারেল সো উইনকে পাঠানো হয়েছে।

এ থেকেই অনুমান করা যায় যে- ওই এলাকার দখল ফিরে পাওয়াটা জান্তা সরকারের কাছে কতটা গুরুত্বপূর্ণ।

অন্যদিকে, জেনারেল সো উইন নেতৃত্বাধীন দলের উপর আকস্মিক হামলা চালিয়ে কাওকারেক শহরের বাইরে জান্তা সরকারের বেশ কিছু যানবাহন ধ্বংস করেছে কারেন বিদ্রোহীরা।

এ ঘটনার পর থেকে জেনারেল উইনকে প্রকাশ্য কোনো কার্মকাণ্ডে অংশ নিতে দেখা যাচ্ছে না। এর ফলে গুঞ্জন উঠেছে যে- বিদ্রোহীদের হামলায় তিনি আহত হয়েছেন।

একই সাথে এটাও শোনা যাচ্ছে যে- হামলা ঠেকাতে ব্যর্থ হওয়ায় জান্তা সরকারের প্রধান মিন অঙ হ্লাইং তাকে ওই এলাকা থেকে প্রত্যাহার করে নিয়েছেন।

কারেন বিদ্রোহীদের মধ্যেও এখন বেশ কিছু বিষয়ে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব রয়েছে।

জান্তা সরকারের সাথে গত কয়েক বছরের সংঘাতের ফলে কারেন রাজ্যে বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা বেড়ে ইতোমধ্যেই সাত লাখে ছাড়িয়েছে, যা তাদের মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক।

এর মধ্যে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর সাথে আবারো বড় ধরনের যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লে তা অবস্থা আরো খারাপ হতে পারে বলে শঙ্কা রয়েছে।

তাছাড়া বাহিনীর সাতটি ব্রিগেডের মধ্যে ঐক্য বজায় রাখাটাও তাদের জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ।

কেন না, অভ্যুত্থানের আগে এশিয়ার অন্যতম দরিদ্র ওই অঞ্চলের শান্তি ও অর্থনৈতিক স্বার্থে কেন্দ্রীয় সরকারের সাথে কতটুকু আপস করা উচিৎ, সেটি তা নিয়ে কারেন বাহিনীর বিগ্রেডগুলোর মধ্যে বড় ধরনের বিরোধ লক্ষ্য করা গিয়েছিল।

কাজেই সবদিক বিবেচনা করেই কারেন বিদ্রোহীদের এখন সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে- তাদের রাজ্যের অর্থনীতির মূলভিত্তি মায়াওয়াদ্দি ক্ষেত্রে তাদের নীতি কী হবে।

বাড়িয়েছে জান্তা সরকার
অতীতের বিভিন্ন ঘটনার প্রেক্ষিতে জন্ম নেয়া অবিশ্বাস এবং স চিট থু’র সাথে কারেন বিদ্রোহীদের শীর্ষ নেতাদের প্রবল মতবিরোধের রয়েছে।

ফলে তারা থু’র ক্যাসিনো কমপ্লেক্সটি বন্ধ করে দিতে চায়।

কারেন বিদ্রোহীদের নেতারা এটাও বলছেন যে- ক্যাসিনো কমপ্লেক্সটি মানব পাচারের মতো আন্তর্জাতিক অপরাধও সংঘটিত হচ্ছে। কাজেই এটি বন্ধ করে দেয়াই সমীচিত বলে মনে করছেন তারা।

অন্যদিকে, ক্যাসিনো কমপ্লেক্স নিয়ে স চিট থু’র একটি উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা রয়েছে।

একটি চীনা কোম্পানির সাথে যৌথ অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে তিনি এটিকে আরো বড় করতে আগ্রহী।

কাজেই তিনি চেষ্টা করবেন যেন ক্যাসিনোটি কোনোভাবেই বন্ধ করা না হয়।

অবশ্য থাইল্যান্ডের সমর্থিত না পেলে তার পক্ষে ক্যাসিনো টিকিয়ে রাখা কঠিন হবে। কারণে দেশটি ক্যাসিনোর বিদ্যুৎ সরবরাহ এবং টেলিযোগাযোগ সেবা দিয়ে থাকে।

যদিও থাইল্যান্ড সহযোগিতা করবে না, এমন শঙ্কা আপাতত নেই।

কারণ ক্যাসিনো কমপ্লেক্সের ব্যবসার সাথে প্রভাবশালী কিছু থাই নাগরিকও জড়িত রয়েছে।

এছাড়া কারেন বিদ্রোহীদের কয়েকজন জ্যেষ্ঠ নেতা ক্যাসিনো ব্যবসার সাথে জড়িত রয়েছে বলেও শোনা যায়।

এদিকে, কেএনইউ’র সূত্রগুলোর সাথে কথা বলে মনে হয়েছে যে- গত ১১ এপ্রিল থাই সীমান্তে জান্তা বাহিনীর ঘাঁটির নিয়ন্ত্রণে নেয়া দলটি মায়াওয়াদ্দি শহরের নিয়ন্ত্রণ নেয়ার জন্য প্রস্তুত ছিল না।

কারেন রাজ্যে নিজস্ব শাসন ব্যবস্থা চালু করার লক্ষ্যে সেখানকার বিদ্রোহীরা প্রায় ৭৫ বছর ধরে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর সাথে লড়াই চালিয়ে আসছে।

সম্প্রতি তারা জান্তা সরকারের বিরোধী পক্ষগুলোর সাথেও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলেছে।

শহর থেকে পালিয়ে আসা ভিন্নমতাবলম্বীদের দ্বারা গঠিত পিডিএফের সদস্যদের আশ্রয় দেয়া থেকে শুরু করে সামরিক প্রশিক্ষণও দিচ্ছে কারেন বিদ্রোহীরা।

এখন বিদ্রোহী সশস্ত্র গোষ্ঠী, যুদ্ধবাজ বাহিনী এবং পিডিএফের মধ্যে সমন্বয় করে একটি সর্বাত্মক আক্রমণ চালানো গেলেই হয়তো মিয়ানমারের জান্তা সরকারকে ক্ষমতাচ্যূত করা যাবে এবং তাদের জন্য সেটি একটি বিশাল অর্জন হবে।

যদিও সেই সাফল্য পেতে হলে তাদেরকে আরো অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে।
সূত্র : বিবিসি


আরো সংবাদ



premium cement