০৯ মে ২০২৪, ২৬ বৈশাখ ১৪৩১, ২৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`


জাহাজ ও নাবিক উদ্ধারে আন্তর্জাতিক নৌবাহিনীর অভিযানের খবরে উদ্বেগ

জাহাজ উদ্ধারের জন্য সরকার কৌশলে এগোচ্ছে : পররাষ্ট্রমন্ত্রী
-


সোমালীয় উপকূলে জিম্মি বাংলাদেশী জাহাজ এমভি আবদুল্লাহ ও এর নাবিকদের উদ্ধারে সোমালি পুলিশ এবং আন্তর্জাতিক নৌবাহিনীর প্রস্তুতির খবরে শিপিং সেক্টরে উদ্বেগ ছড়িয়েছে। যেহেতু এ ধরনের জাহাজে অভিযানে পতাকা রাষ্ট্রের অনুমতি নেবার আন্তর্জাতিক বিধান রয়েছে এবং বাংলাদেশ অভিযানের ব্যাপারে এখন পর্যন্ত একমত নয় তা কিছুটা হলেও উদ্বেগকে প্রশমিত করেছে। জাহাজটির মালিক পক্ষও অভিযানের বিরোধিতা করে বলছে তারা শান্তিপূর্ণ উপায়ে আলোচনার মাধ্যমে জিম্মি নাবিকদের উদ্ধার করতে চায়। জাহাজ ও নাবিকরা জিম্মি হওয়ার সাত দিনেও গতকাল বিকেল পর্যন্ত জিম্মিকারীদের পক্ষ হতে কোনো চাহিদা না পাওয়াও উদ্বেগ বাড়াচ্ছে জাহাজটির মালিক পক্ষ এবং জিম্মিদের স্বজনদের মধ্যে।
ইউনাইটেড ন্যাশনস কনভেনশন অন ল অব দ্য সি (আনকজ নামে পরিচিত) অনুসারে যেকোনো উপকূলীয় রাষ্ট্রের উপকূল রেখা হতে ১২ নটিক্যাল মাইল(১ নটিক্যাল মাইল=১.৮৫২ কিলোমিটার) বা ২২.২২৪ কিলোমিটার পর্যন্ত সি বেড, একই দূরত্বের আকাশ ও সাবসয়েলের ওপর ওই রাষ্ট্রের একচ্ছত্র সার্বভৌমত্ব থাকবে। কাজেই কোনো সার্বভৌম এলাকায় কোনো অভিযান চালাতে হলে সেই রাষ্ট্রের অনুমতি নিতে হবে। শুধু সেই রাষ্ট্র্রের অনুমতি নিলেই হবে না, আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী জাহাজটির পতাকা রাষ্ট্রের (ফ্ল্যাগ স্টেট) ও অনুমতি নিতে হবে।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ মার্চেন্ট মেরিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিওএমএমএ) সভাপতি ক্যাপ্টেন আনাম চৌধুরী গতকাল বিকেলে নয়া দিগন্তকে বলেন, অনেকে অনেক পরিকল্পনা করবে, কিন্তু সেই পরিকল্পনা পরিকল্পনাতেই থেকে যাবে। তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক সমুদ্র আইন অনুসারে জাহাজটি যেহেতু সোমালীয় উপকূলের ৪ নটিক্যাল মাইলের ভেতরে রয়েছে সেক্ষেত্রে অভিযান চালাতে হলে প্রথমত উপকূলীয় রাষ্ট্রের অনুমতি নিতে হবে। একই সাথে আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে জাহাজটির ফ্ল্যাগ স্টেট তথা বাংলাদেশেরও অনুমতি নিতে হবে। বাংলাদেশ ইতোমধ্যে এ ধরনের অভিযানে না করেছে এবং শান্তিপূর্ণ উপায়ে নাবিক ও জাহাজ উদ্ধারের কথা বলেছে। তিনি বলেন, সাগরের মাঝখানে হয়তো দস্যুরা দুর্বল, কিন্তু উপকূলে তারা অনেক শক্তিশালী। তাই সেখানে অভিযান চালালে জাহাজ এবং নাবিকদের ব্যাপক ডেমেজ হতে পারে। জাহাজে থাকা ঝুঁকিপূর্ণ কার্গোর কথাও মাথায় রাখতে হবে। জাহাজে দাহ্য কার্গো থাকায় ঝুঁকি বুঝতে পেরে দস্যুরাও জাহাজের যথাযথ মান যাতে বজায় থাকে সেজন্য নাবিকদের দিয়ে তা মেইনটেন করছে বলেও তিনি জানান।
গত সোমবার সোমালি পুলিশের বরাত দিয়ে বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, সোমালিয়ার পুন্টল্যান্ডের জলদস্যু অধ্যুষিত আধা-স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের পুলিশ বাহিনী জানায়, এমভি আবদুল্লাহকে জিম্মি করা জলদস্যুদের বিরুদ্ধে অভিযান চালাতে তারা প্রস্তুত রয়েছে। রয়টার্সের প্রতিবেদন অনুযায়ী, আন্তর্জাতিক নৌবাহিনী অভিযানের পরিকল্পনা করছে এমন তথ্য পেয়ে পুন্টল্যান্ডের পুলিশ বাহিনী প্রস্তুতি নিচ্ছে। এর আগে গত রোববার পুন্টল্যান্ডের পুলিশ জানায়, এমভি আবদুল্লাহকে জিম্মি করা জলদস্যুদের কাছে মাদক সরবরাহের সময় একটি গাড়ি জব্দ করা হয়েছে।

ইতঃপূর্বে গত ১৪ মার্চ ইউরোপীয় ইউনিয়নের নৌবাহিনী অপারেশন আটলান্টা এমভি আবদুলল্লাহর নাবিকদের উদ্ধারে অভিযান চালানোর প্রস্তাব দিয়েছিল। তবে বাংলাদেশ সরকার তাতে সম্মতি দেয়নি বলে মেরিটাইম অ্যাফেয়ার্স ইউনিটের সচিব খুরশেদ আলম একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে আলোচনায় জানান। সেখানে তিনি বলেন, নাবিকদের জীবনের নিরাপত্তার কথা ভেবে ওই প্রস্তাবে সরকার ও জাহাজ মালিকপক্ষ রাজি হয়নি।
এ দিকে এমভি আবদুল্লাহর নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান এসআর শিপিংয়ের মাদার অর্গানাইজেশন কবির গ্রুপের মিডিয়া উপদেষ্টা মিজানুল ইসলামও জাহাজটিতে অভিযান চালানোর তীব্র বিরোধিতা করেছেন। গতকাল তিনি এ প্রতিবেদককে বলেন, নাবিকদের জীবন বিপন্ন হতে পারে, এমন কোনো সামরিক পদক্ষেপকে আমাদের কোম্পানি সমর্থন করে না। বাংলাদেশ সরকারও একই অবস্থান পরিষ্কার করেছে বলেও তিনি জানান। তিনি জানান, আমাদের প্রথম অগ্রাধিকার হলো জিম্মি নাবিকদের নিরাপদে ফিরিয়ে আনা। তাই আমরা আলোচনার মাধ্যমে এই সঙ্কটের সুরাহা করতে চাই। জিম্মি নাবিকদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, নাবিকরা সুস্থ ও নিরাপদ আছেন। এখন পর্যন্ত জিম্মিকারীরা তাদের কোন চাহিদা জাহাজ কর্তৃপক্ষকে জানায়নি বলেও তিনি জানান।
প্রসঙ্গত, গত ১২ মার্চ ৫৫ হাজার টন কয়লা বোঝাই করে মোজাম্বিক থেকে দুবাই যাওয়ার পথে ভারত মহাসাগর থেকে বাংলাদেশী জাহাজ এমভি আব্দুল্লাহকে ২৩ নাবিকসহ নিজেদের জিম্মায় নেয় সোমালিয়ার জলদস্যুরা। জাহাজটি কয়েক দফায় স্থান পরিবর্তন করে এখন সোমালিয়ার গদভজিরান উপকূলের কাছে নোঙ্গর করা আছে। ইতঃপূর্বে একই গ্রুপের মালিকানাধীন জাহাজ এমভি জাহান মনি ২০১০ সালের ৫ ডিসেম্বর সোমালীয় জলদস্যুদের হাতে জিম্মি হয়েছিল ২৫ নাবিক ও চিফ ইঞ্জিনিয়ারের স্ত্রীসহ। সে সময় প্রায় ১০০ দিনের দরকষাকষিতে জিম্মি নাবিক ও জাহাজটি অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করেছিল কবির গ্রুপ।

জিম্মি নাবিকসহ জাহাজ উদ্ধারের জন্য সরকার কৌশলে এগোচ্ছে : পররাষ্ট্রমন্ত্রী
কূটনৈতিক প্রতিবেদক জানান, ভারত মহাসাগরে জলদস্যুদের হাতে ২৩ নাবিকসহ জিম্মি বাংলাদেশী জাহাজ এমভি আবদুল্লাহকে উদ্ধার করতে সরকার কৌশলে এগোচ্ছে বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ। এ ক্ষেত্রে একটি সমাধানে পৌঁছানো সম্ভব বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
গতকাল পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ঢাকায় নিযুক্ত সংযুক্ত আরব আমিরাতের রাষ্ট্রদূত আব্দুল্লাহ আল আলী হামুদির সাথে সৌজন্য সাক্ষাৎ শেষে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি এ কথা জানান। পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, আমাদের উদ্দেশ্য নাবিকদের সুস্থভাবে মুক্ত করা। একই সাথে জাহাজ উদ্ধার করা। এ জন্য আমরা নানা কৌশলে এগোচ্ছি। আশা করি একটা সমাধানে যেতে পারব।
বাংলাদেশী জাহাজ নিয়ে বার্তা সংস্থা রয়টার্সের সংবাদ নিয়ে করা প্রশ্নের জবাবে ড. হাছান বলেন, খবরের ওপর ভিত্তি করে কোনো মন্তব্য করব না।
রয়টার্সের খরবে বলা হয়েছে, এমভি আবদুল্লাহর জিম্মি নাবিকদের ‘বল প্রয়োগে’ উদ্ধারের প্রস্তাব দিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের নৌবাহিনী। এ ছাড়া অভিযান চালানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে সোমালিয়ার পুলিশ ও আন্তর্জাতিক নৌবাহিনী। কিন্তু বল প্রয়োগে উদ্ধার অভিযানের কঠোর বিরোধিতা করেছে জাহাজটির মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান কেএসআরএম। প্রতিষ্ঠানটি সমঝোতার মাধ্যমে এই সঙ্কটের সামাধান চায়। নাবিকদের জীবন ঝুঁকিতে পড়তে পারে, তাই সংশ্লিষ্ট নৌবাহিনীগুলোকে বল প্রয়োগে কোনো উদ্ধার অভিযান পরিচালনা না করার জন্য জোরাল অনুরোধ জানিয়েছে বাংলাদেশ সরকার। নাবিকদের জীবনের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করতে অভিযান চালানোর প্রস্তাবে সরকার ও মালিকপক্ষ রাজি হয়নি বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মেরিটাইম অ্যাফেয়ার্স ইউনিটের সচিব খুরশেদ আলম।

গত শনিবার ভারতীয় নৌবাহিনী আরেকটি পণ্যবাহী জাহাজ জলদস্যুদের হাত থেকে উদ্ধার করেছে। মাল্টার পতাকাবাহী এমভি রুয়েন গত ডিসেম্বরে হাইজ্যাক হয়েছিল। ভারতীয় সেনারা জাহাজটির ১৭ ক্রুকে মুক্ত এবং ৩৫ জলদস্যুকে গ্রেফতার করেছে।
পান্টল্যান্ড সোমালিয়ার একটি আধা-স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল, যেখানে অনেক জলদস্যু দলের ঘাঁটি রয়েছে। ওই এলাকার পুলিশ বাহিনী বলেছে, এমভি আবদুল্লাহকে দখল করে থাকা জলদস্যুদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক নৌবাহিনীর অভিযানের একটি পরিকল্পনা তারা জানতে পেরেছে।
মোজাম্বিক থেকে ৫৫ হাজার টন কয়লা নিয়ে আরব আমিরাত যাওয়ার পথে গত ১২ মার্চ ভারত মহাসাগরে সোমালি জলদস্যুদের কবলে পড়ে এমভি আবদুল্লাহ। জলদস্যুরা জাহাজটির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ২৩ নাবিকের সবাইকে জিম্মি করে রেখেছে।
এ ছাড়া বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিপির সদস্যদের ফেরত পাঠানোর প্রশ্নে হাছান মাহমুদ বলেন, প্রায় ২০০ জনের মতো বিজিপি সদস্য বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। ইতঃপূর্বে আমরা মিয়ানমারের সাথে আলাপ-আলোচনা করে অনেককে ফেরত পাঠিয়েছি। একই প্রক্রিয়ায় তাদেরও ফেরত পাঠানোর জন্য আলোচনার মধ্যে আছি। আশা করছি, আমরা আশ্রয় নেয়া বিজেপি সদস্যদের শিগগিরই ফেরত পাঠাতে পারব।


আরো সংবাদ



premium cement