২০ মে ২০২৪, ০৬ জৈষ্ঠ ১৪৩১, ১১ জিলকদ ১৪৪৫
`


আইএমএফের শর্ত বাস্তবায়নে নতুন পদ্ধতিতে দর নির্ধারণ

ডলারের দাম বাড়ল ৭ টাকা

-


আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছ থেকে ঋণ পাওয়ার শর্ত বাস্তবায়নে নতুন পদ্ধতিতে ডলারের দর নির্ধারণ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। নতুন এ পদ্ধতির নাম ক্রলিং পেগ। এ পদ্ধতি চালু করায় এক দিনেই প্রতি ডলারের দাম এক লাফে ৭টা বেড়ে ১১৭ টাকা হয়েছে। ব্যাংকগুলো এই ১১৭ টাকাই ভিত্তি ধরে আমদানি রফতানিতে ডলারের দর নির্ধারণ করবে। ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, যেহেতু দেশে পর্যাপ্ত ডলার সরবরাহ নেই। এ কারণে গ্রাহকদের কাছ থেকে করপোরেট ডিলিংয়ের মাধ্যমে বাড়তি দাম আদায় করবে। এতে সামগ্রিক আমদানি ব্যয় বেড়ে যাবে। আর আমদানি ব্যয় বাড়লে বেড়ে যাবে মূল্যস্ফীতি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি ব্যাংকের ট্রেজারি হেড গতকাল নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, ক্রলিং পেগের মাধ্যমে ডলারের দর নির্ধারণ করায় লাভের চেয়ে লোকসানের পাল্লাই ভারী হবে। কারণ এত দিন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরোক্ষ হস্তক্ষেপে ব্যাংকারদের শীর্ষ সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি) এবং ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলারস অ্যাসোসিয়েশন (বাফেদা) ডলারের দর নির্ধারণ করে দিত। আর ওই দর ছিল ১১০ টাকা। আর এর ওপর ভিত্তি ধরেই ব্যাংকগুলো করপোরেট ডিলিংয়ের মাধ্যমে আরো ১০ থেকে ১৫ টাকা বাড়তি আদায় করত। এখন ক্রলিং পেগের মাধ্যমে ডলারের দর নির্ধারণ করা হয়েছে ১১৭ টাকা। এ থেকে ১০ থেকে ১৫ টাকা বেড়ে গেলে ডলারের প্রকৃত দর আরো বেড়ে যাবে। ফলে সামগ্রিক ব্যয় আরো বাড়বে। তিনি বলেন, বাজারে ডলারের সঙ্কট রয়েছে। ব্যাংকগুলোর হাতে পর্যাপ্ত ডলার নেই। এর ফলে কোনো ইতিবাচক ফল বয়ে আনবে না বলে তারা আশঙ্কা করছেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের এক দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, আইএমএফের কাছ থেকে ঋণ পাওয়ার শর্ত হিসেবে ডলারের দর ও ঋণের সুদহার বাজারভিত্তিক করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। আর এরই ভিত্তিতে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ডলারের মূল্য নির্ধারণে ক্রলিং পেগ পদ্ধতি চালু করার ঘোষণা আসে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে চলতি বছরের ২২ জানুয়ারি ক্রলিং পেগ পদ্ধতি চালুর কথা জানিয়েছিল। এ পদ্ধতি কার্যকর করার পদ্ধতি জানতে আইএমএফের শরণাপন্ন হয় বাংলাদেশ ব্যাংক। পরে গত মার্চের মধ্যে এই পদ্ধতি চালু করার কথা বলা হয়। সর্বশেষ মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে এসে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ-সংক্রান্ত ঘোষণা দিলো।

ক্রলিং পেগ পদ্ধতি কী : জানা গেছে, কোনো দেশের মুদ্রার অবমূল্যায়ন প্রকট আকার ধারণ করলে ক্রলিং পেগ পদ্ধতিতে বৈদেশিক মুদ্রার মান নির্ণয় করা হয়। এই পদ্ধতিতে ডলারের একটি সর্বনিম্ন ও সর্বোচ্চ দাম ধরে দেয়া হয়। মূলত অস্থিতিশীল মুদ্রাবাজারে সমতা আনতে আপৎকালীন পদ্ধতি হিসেবে এটিকে ব্যবহার করা হয়। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাব অনুযায়ী, বর্তমানে আর্জেন্টিনা, ভেনিজুয়েলা, হন্ডুরাসের মতো দেশগুলোতে এ পদ্ধতিতে ডলারের দাম নির্ধারণ করা হয়।
বর্তমানে ডলার বা অন্যান্য বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময়ের ক্ষেত্রে দুই ধরনের পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। একটি হার্ড পেগ এবং অপরটি সফট পেগ। হার্ড পেগ পদ্ধতিতে সরকার বৈদেশিক মুদ্রার মান নিজে ঠিক করে দেয় এবং সে অনুযায়ী লেনদেন হয়। আর সফট পেগ পদ্ধতিতে বাজারের ওপরে মুদ্রার মান ছেড়ে দেয়া হয়। তবে সরকার বা ব্যাংক চাইলে সফট পেগ পদ্ধতিতে ডলারের একটি সম্ভাব্য দাম ধরে দিতে পারে। এছাড়া অনেক দেশে ডলারের মান সম্পূর্ণ বাজারমুখী রাখতে এবং হস্তক্ষেপবিহীন মান নির্ধারণে ‘ফ্লোটিং এক্সচেঞ্জ রেট’ ব্যবহার করা হয়। এতে বাজার ও অর্থনীতির সাথে তালমিলিয়ে ডলারের দাম ওঠানামা করে।

বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রাবাজার বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, গত দুই বছর ধরে দেশে বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে অস্থিরতা বিরাজ করছে। বাজারে চাহিদা অনুযায়ী ডলার সরবরাহ না থাকায় প্রতিনিয়তই ডলারের দাম বেড়ে যাচ্ছে। দুই বছর আগে প্রতি ডলার পেতে যেখানে ব্যয় করতে হতো ৮০ টাকা। এখন তা বেড়ে হয়েছে ১১০ টাকা। তবে প্রকৃত দর আরো বেশি। ব্যাংকভেদে এ দর এখন ১২৫ টাকা ব্যয় করতে হচ্ছে প্রতি ডলারের জন্য। ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, দেশে ডলারের সঙ্কট প্রকট আকার ধারণ করছে। আমদানির চাহিদা অনুযায়ী ব্যাংকগুলোর হাতে পর্যাপ্ত ডলার নেই। এ কারণে আমদানিকারকরা বেশি দাম দিয়ে হলেও নিজেদের প্রয়োজন মেটানোর জন্য বেশি দরে ডলার কিনছে। যেমন বর্তমানে এবিবি ও বাফেদা প্রতি ডলার নির্ধারণ করে দিয়েছে ১১০ টাকা। কিন্তু ব্যাংকগুলো গ্রাহকদের কাছে আগাম ডলার বিক্রি করছে বর্তমান দরের চেয়ে ১০ শতাংশ বা ১২ শতাংশ বেশি। একজন গ্রাহকের কোনো মাসের ১০ তারিখে আমদানি ব্যয় পরিশোধের জন্য ডলার প্রয়োজন। সে ব্যাংকে আগাম ১০ শতাংশ বেশি দরে ১০ দিন আগে ডলার বুকিং দিয়ে রাখছে। ব্যাংকিং ভাষায় এটাকে করপোরেট ডিলিং বলা হয়। আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি এ পদ্ধতির কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকেও তেমন কিছু করার থাকে না। আর এভাবে ১১০ টাকার ডলার আমদানি পর্যায়ে এসে ব্যাংকভেদে ১২০ টাকা থেকে ১২৫ টাকায় উঠে যাচ্ছে।

ক্রলিং পেগের মাধ্যমে ডলারের দর নির্ধারণ করা হয়েছে ১১৭ টাকা। এটাকে সর্বোচ্চ দর ধরে মধ্যবর্তী দরে ডলার লেনদেন করতে পারবে। ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, ১১৭ টাকাকে ভিত্তি ধরে ১০ শতাংশ প্রিমিয়াম নির্ধারণ করলে আগাম ডলার বুকিংয়ের ক্ষেত্রে গ্রাহকদের ১৩০ টাকার ওপরে পড়ে যাবে। এভাবেই সামগ্রিক ব্যয় বেড়ে যাবে।
ডলারের বাজারে এই অস্থিরতা প্রশমনে ক্রলিং পেগ কতটা ভূমিকা রাখতে পারবে এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ডলার সঙ্কটের মূল কারণ উদঘাটন না করে শুধু ক্রলিং পেগ পদ্ধতি ব্যবহারের মাধ্যমে বাজারে ভারসম্য আনা অসম্ভব। কারণ যারা ডলার আয় করছেন তারা দেশে ডলার না পাঠিয়ে বিদেশে হয় বিনিয়োগ করছেন অথবা সুইস ব্যাংকের মতো বিদেশী ব্যাংকে জমা করছেন। দেশে ডলার না পাঠানোর কারণ হচ্ছে, এরা ডলার পাঠিয়ে আশানুরূপ লাভ পাচ্ছেন না, আর না হলে নিজের টাকার অঙ্কে যে সম্পদ আছে তা ডলারে রূপান্তর করলে সম্পত্তির পরিমাণ কয়েকগুণ বেড়ে যাচ্ছে। গত কয়েক বছরে টাকার লাগাতার অবমূল্যায়নের কারণে দেখা গেছে ব্যাংকে টাকা রেখে সুদ বা মুনাফা মিলিয়ে যা লাভ হয়, শ্রেফ টাকাকে ডলারে রূপান্তর করলে তার থেকে বেশি লাভ হয়। টাকা এবং ডলারের এ ব্যবধান কমিয়ে না আনলে কোনোভাবেই ক্রলিং পেগ পদ্ধতি কাজে আসবে না।

 

 


আরো সংবাদ



premium cement