২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

অসহনীয় লোডশেডিং

অসহনীয় লোডশেডিং -


-নগরজীবন দুর্বিষহ
-এলাকাভেদে পানির জন্য হাহাকার
-বাড়ছে রোগবালাই

স্ত্রী, দুই শিশুসন্তান নিয়ে পশ্চিম শেওড়াপাড়ায় থাকেন আমিনুল ইসলাম। পানির অভাবে দুই দিন ধরে গোসল করেন না। তীব্র তাপদাহের পাশাপাশি লোডশেডিংয়ে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছেন। স্ত্রী ও দুই শিশুসন্তানকে এক আত্মীয়ের বাসায় নিয়ে দুই দিন পর গোসল করিয়ে এনেছেন। তিনি নিজে পানির জার কিনে গোসল করবেন। আগে যেখানে পানির জারের দাম ছিল ৫০ টাকা। সেখানে এখন কিনতে হচ্ছে ৮০ টাকায়। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, মাথার ওপর তীব্র তাপদাহ। এর মধ্যে শুরু হয়েছে বিদ্যুতের ঘন ঘন লোডশেডিং। একই সাথে পানির সঙ্কট দেখা দিয়েছে। আমরা এ কী আজব শহরে বাস করছি তা বুঝতে পারছি না। তিনি বলেন, বাড়তি বিদ্যুতের দাম দিচ্ছি। কিন্তু বিদ্যুৎ পাচ্ছি না।

রাজধানীতে এ চিত্র প্রায় বেশির ভাগ এলাকায়। বিদ্যুতের ঘন ঘন লোডশেডিংয়ে অতিষ্ঠ নগরবাসী একটু স্বস্তির জন্য বাজারে ছুটছেন চার্জার ফ্যানের জন্য। কিন্তু বাজারে চার্জার ফ্যানের সঙ্কট দেখা দিয়েছে। যাওবা কিছু পাওয়া যাচ্ছে তার দামও চড়া। এদিকে রাজধানীর বেশির ভাগ এলাকায় পানির সঙ্কট দেখা দিয়েছে। বলা হচ্ছে ঘন ঘন লোডশেডিংয়ের কারণে পানির পাম্প চালাতেও হিমশিম খাচ্ছেন ওয়াসার কর্মচারীরা। অনেক এলাকায় মিলছে দুর্গন্ধযুক্ত পানি। আমিনুল ইসলাম জানান, পশ্চিম শেওড়াপাড়ায় আগে থেকেই পানি কম পাওয়া যেতো। এখন পানির সরবরাহ একেবারেই কমে গেছে। গোসল করার মতো পানি নেই। যে পানিটুকু পাওয়া যাচ্ছে তা দুর্গন্ধযুক্ত। পানির সাথে সুতার মতো লাল লাল পোকা আসছে। বাধ্য হয়ে ব্যবহার অনুপযোগী এ পানি খেয়ে অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়ছেন।

ডলার সঙ্কটের কারণে কয়লা আমদানি করতে না পারায় পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র ইতোমধ্যেই বন্ধ হয়ে গেছে। এর ফলে বিদ্যুতের লোডশেডিংয়ের তীব্রতা আরো বেড়ে গেছে। গতকাল বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড থেকে যে তথ্য দেয়া হচ্ছে তাতেই দেখা গেছে গতকাল দুপুর ১২টায় লোডশেডিং করা হয়েছে দুই হাজার ৬১০ মেগাওয়াট। ওই সময়ে বিদ্যুতের চাহিদা দেখানো হয়েছে ১৪ হাজার ৯০০ মেগাওয়াট। আর উৎপাদন দেখানো হয়েছে ১২ হাজার ১৬৬ মেগাওয়াট। বিদ্যুৎ বিভাগের এ হিসাবের সাথেও বাস্তব অবস্থার গরমিল রয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। গ্রামাঞ্চলে গড়ে ৮ থেকে ১৬ ঘণ্টা লোডশেডিং করা হচ্ছে। দিনের অর্ধেক সময় লোডশেডিং করে যদি চাহিদা হয় ১৪ হাজার ৯০০ মেগাওয়াট। পুরো সময় বিদ্যুৎ দিলে এ চাহিদাতো প্রায় দ্বিগুণ হওয়ার কথা। কিন্তু চাহিদা কোনো সময়ই ১৫ হাজার মেগাওয়াটের ওপরে দেখানো হয় না। সুতরাং পিডিবি থেকে চাহিদার যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় তার সাথে বাস্তবতার তেমন কোনো মিল নেই।

এ দিকে ঘন ঘন লোডশেডিংয়ে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে দেশের মানুষ। গ্রামে তো তেমন দিনের বেলায় গাছের নিচে বসা যায়। কিন্তু ইটপাথরে ঘেরা নগরজীবন তো চার দেয়ালের মধ্যেই আবদ্ধ থাকতে হয়। এতে গরমের অনুভব তীব্র আকারে দেখা দেয়। এ দিকে সামর্থ্যবানরা ইলেকট্রিক চার্জার ফ্যান কিনে লোডশেডিংয়ের তীব্রতা থেকে কিছুটা রেহাই পাওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু এ চার্জার ফ্যানেরও মজুদ শেষ হয়ে গেছে। ক্রেতার ভিড়ে যেসব দোকানে চার্জার ফ্যান পাওয়া যাচ্ছে তা অনেকেরই নাগালের বাইরে দাম হাঁকানো হচ্ছে। মনির ইসলাম নামক এক ক্রেতা বলেন, একেতো প্রচণ্ড গরম, তারপর আবার শুরু হয়েছে তীব্র লোডশেডিং। তাই চার্জার ফ্যান কিনতে এসেছিলাম। কিন্তু এসে দেখলাম চার্জার ফ্যান নেই। সব নাকি শেষ হয়ে গেছে। লোডশেডিং ও গরমের কারণে চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় গত দুই দিনে নাকি সব শেষ হয়ে গেছে। হাসান নামক আরেক ক্রেতা বলেন, কিছু কিছু দোকানে চার্জার ফ্যান পাওয়া যাচ্ছে। দাম হাঁকানো হচ্ছে প্রকৃত মূল্যের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি। যে টাকা নিয়ে মার্কেটে এসেছিলেন, দাম নাগালের বাইরে যাওয়ায় তিনি চার্জার ফ্যান কিনতে পারেননি। এদিকে গরমে প্রাণ যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। বিশেষ করে রাতে লোডশেডিংয়ের কারণে ঘুমানোই যায় না। তাই অফিসে এসে কাজে মনোযোগ থাকে না। শুধু ঝিমুনি আসে।

শফিক আজম স্ত্রী সন্তান নিয়ে থাকেন রাজধানীর শান্তিনগরে। একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। গতকাল দুপুরে চলমান তাপদাহে বিদ্যুতের অব্যাহত লোডশেডিংয়ে অতিষ্ঠ হয়ে রোববার সকালে গেলেন এলাকার ইলেকট্রনিক্সের দোকানে। উদ্দেশ্য, চার্জার ফ্যান কেনা। একে একে ৪-৫টি দোকান ঘুরেও কোনো দোকানেই মিলল না চার্জার ফ্যান। দোকানিদের বক্তব্য, ক্রেতার চাপ বেশি। স্টকে থাকা সবই বিক্রি হয়ে গেছে। এ দিকে চার-পাঁচ দোকান ঘুরে না পেয়ে অবশেষে তিনি যান ওয়াল্টনের শোরুমে। শান্তিনগর মোড় থেকে মালিবাগের দিকে এগোতেই রাজিয়া মঞ্জিলে ওই শোরুমে যাওয়ার পরও হতাশ হতে হলো। শোরুমের এক কর্মী বললেন, গতকালই (শনিবার) আমাদের এখানে অন্তত ১০০ চার্জার ফ্যান বিক্রি হয়েছে। স্টক শেষ। কোম্পানিতে অর্ডার পাঠানো হয়েছে। দুই-তিন পর এল পেতে পারেন।’ এ দিকে কিছু কিছু দোকানে চার্জার ফ্যান পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু দাম হাঁকানো হচ্ছে নাগালের বাইরে।

প্রচণ্ড গরমের মধ্যে বিদ্যুতের ভয়াবহ লোডশেডিংয়ের কারণে চার্জার ফ্যানের চাহিদা সবচেয়ে বেশি হলেও এই মার্কেটে এসি, আইপিএস, সোলার প্যানেল এবং ব্যাটারির বিক্রি বেড়ে গেছে। প্রভাব পড়েছে দামেও। এ অবস্থায় ঢাকার বাইরে থেকে আসা ক্রেতাদের এসব পণ্য কিনতে গিয়ে বিপাকে পড়তে হচ্ছে।
একে তো ভয়াবহ গরম, তার ওপর চলছে বিদ্যুতের লোডশেডিং। এ অবস্থায় গরমজনিত রোগবালাই বাড়ছে। বিশেষ করে শিশুরা বেশি অসুস্থ হয়ে পড়ছে। ফলে ওষুধের দোকানে ভিড় বেড়েছে। সবচেয়ে বেশি চাহিদা শিশুদের সর্দিজ্বর, কাশির সিরাপ, ওরস্যালাইন ও গ্লুকোজের। দোকানীরা বলছেন, ৪-৫ দিনে এলার্জি ট্যাবলেট, স্যালাইন, ঘামাচি পাউডার, গ্লুকোজ, টেস্টি স্যালাইন, জুস, কোমল পানীয় বিক্রি বেড়েছে। আর শিশুদের সর্দিজ্বর ও কাশির ওষুধের বিক্রিও অনেকটা বেড়ে গেছে। তবে এসব ওষুধের সাপ্লাইয়ে কোনো ঘাটতি নেই।’

রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় পানির তীব্র সঙ্কট : তীব্র গরমের মধ্যে বিদ্যুতের ঘনঘন লোডশেডিংয়ের কারণে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় পানির তীব্র সঙ্কট দেখা দিয়েছে। প্রচণ্ড তাপদাহে পানির অভাবে সাধারণ মানুষ হন্যে হয়ে ঘুরছে। সামর্থ্যবানরা পানি কিনে চাহিদা মেটালেও সাধারণ মানুষ পড়ছে বিপাকে। তাদের একমাত্র ভরসা ঢাকা ওয়াসার গাড়িতে সরবরাহ করা পানি। কিন্তু গাড়ির পানি কিনতেও ওয়াসা কর্মচারীদের দ্বিগুণ টাকা দিতে হচ্ছে। এ ছাড়া পানি নিতে ওয়াসার এটিএম বুথগুলোতেও দীর্ঘ লাইন পড়ে যাচ্ছে।
রাজধানীর শেওড়াপাড়া, কাজীপাড়া, মিরপুর, আগারগাঁও, সিপাহীবাগ, মাতুয়াইল, জুরাইন, শাহজাহানপুর, খিলগাঁও, উত্তর বাড্ডা, মধ্য বাড্ডা, কুড়িল, ভাটারা, রূপনগর, কালাচাঁদপুর, রায়েরবাজারসহ বেশ কয়েকটি এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গরম বাড়ার পর থেকেই এসব এলাকায় পানির সঙ্কট বেড়েছে। কিছু এলাকার পানিতে দুর্গন্ধও পাচ্ছেন এলাকাবাসী।

ঢাকা ওয়াসার উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (কারিগরি) এ কে এম সহিদ উদ্দিন নয়া দিগন্তকে বলেন, ওয়াসার উৎপাদন ক্যাপাসিটি প্রয়োজনের তুলনায় বেশি আছে। কিন্তু নিয়মিত বিদ্যুৎ না থাকায় প্রয়োজনীয় পানি উৎপাদন করা যাচ্ছে না। এ কারণে কিছু এলাকায় সংকট দেখা দিচ্ছে। তবে আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছি। এখন আমাদের বৃষ্টির দিকে চেয়ে থাকা ছাড়া আর কোনো উপায় দেখছি না।
ঢাকা ওয়াসা ভূগর্ভের উৎস থেকে উৎপাদনের ৬৬ ভাগ পানি আহরণ করে। বাকি ৩৪ ভাগ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট থেকে সংগ্রহ করে তা নগরবাসীর জন্য সরবরাহ করে ওয়াসা। জানা গেছে দৈনিক এক হাজার ৪৯২ গাড়িতে করে সমস্যাগ্রস্ত এলাকায় পানি সরবরাহ করে ওয়াসা।
সরেজমিন দেখা গেছে, রাজধানীর শেওড়াপাড়া এলাকায় তিন-চার দিন ধরে পানির সঙ্কট। তাই বাধ্য হয়ে অনেকেই ওয়াসার গাড়ির পানি কিনে ব্যবহার করছেন। এলাকার বাসিন্দা আমিনুল ইসলাম বলেন, দিনে দু-একবার করে পানি আসে। তা দিয়ে সব কাজ করা সম্ভব হয় না। এ জন্য ওয়াসার গাড়ির পানি বেশি দামে কিনে খেতে হচ্ছে। আবার এলাকার অনেকে স্থানীয় সরবরাহকারীদের কাছ থেকে জারের পানি কিনে খাচ্ছেন।

 


আরো সংবাদ



premium cement