০৮ মে ২০২৪, ২৫ বৈশাখ ১৪৩১, ২৮ শাওয়াল ১৪৪৫
`


শুরুতেই স্বপ্নভঙ্গ

বিসিএস প্রিলি দিতে পারেননি ঢাকা ও রংপুরের অনেক পরীক্ষার্থী
রাজশাহীতে রাস্তায় পরীক্ষার্থীর কান্না-গড়াগড়ি : নয়া দিগন্ত -


বিসিএস ক্যাডার হওয়ার স্বপ্ন শুরুতেই ভেঙে গেল রংপুরের ৮১ শিক্ষার্থীর। ১-৪ মিনিট বিলম্ব করায় মহানগরীর বিভিন্ন কেন্দ্রে ৪৬তম বিসিএস প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় বসতে পারেননি তারা। পায়ে ধরেও অনেকে প্রবেশ করতে পারেননি। বাগবিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়ায় ২ শিক্ষার্থীকে আটকও করেছে পুলিশ। গতকাল শুক্রবার সকাল সাড়ে ৯টা থেকে ৯ টা ৩৫ মিনিটের মধ্যে এ ঘটনা ঘটে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সকাল ১০টায় পরীক্ষা শুরু হলেও ৩০ মিনিট আগে কেন্দ্রে প্রবেশ করার নির্দেশনা ছিল। কিন্তু কিছু পরীক্ষার্থী সকাল সাড়ে ৯টার ১-২ মিনিট দেরি করে আসেন। অনেকেই আসেন ৫ মিনিট পর। তারা হলে প্রবেশ করতে চাইলে বাধা দেন কর্তব্যরত ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশ। পরীক্ষার্থীদের অনেকেই অনুনয় বিনয় করেও ঢুকতে পারেননি। বাগবিতণ্ডায় জড়ানোর কারণে বেগম রোকেয়া কলেজ কেন্দ্র ও পুলিশ লাইন্স স্কুল অ্যান্ড কলেজ কেন্দ্রের সামনে থেকে দুইজন শিক্ষার্থীকে আটক করা হয়।

রংপুর মহানগর পুলিশের উপপুলিশ কমিশনার (অপরাধ) আবু মারুফ হোসেন জানান, নিয়ম ভেঙে কেন্দ্রে প্রবেশের চেষ্টা ও বিশৃঙ্খলার কারণে দুইজনকে আটক করা হয়েছিল। পরীক্ষা শেষে তাদের ছেড়ে দেয়া হয়।
নগরীর ১৮টি কেন্দ্রের সবগুলোতে এ ধরনের ঘটনায় তিন শতাধিক পরীক্ষার্থী পরীক্ষা দিতে না পারার খবর পাওয়া গেছে। কিন্তু তিনটি কেন্দ্রের ৮১ জনের তথ্য স্বাধীনভাবে যাচাই করেছেন প্রতিবেদক। এর মধ্যে বেগম রোকেয়া কলেজ কেন্দ্রে ২৫ জন, লায়ন্স স্কুল অ্যান্ড কলেজ কেন্দ্রে ৪৬ জন ও পুলিশ লাইন্স স্কুল অ্যান্ড কলেজ কেন্দ্রে ১০ জন সাড়ে ৯টার সামান্য পরে আসায় মোট ৮১ জন পরীক্ষা দিতে পারেননি।

লায়ন্স স্কুল অ্যান্ড কলেজ কেন্দ্রে পরীক্ষায় বসতে না পারা হামিদুর রহমান জানান, ‘আমি ২০২০ সালে রংপুর কমিউনিটি মেডিক্যাল থেকে এমবিবিএস পাস করেছি। লায়ন্স স্কুলে আমার সিট ছিল। আমি ৯টা ৩৪ মিনিটে গেটে আসি। কিন্তু কর্তব্যরত ম্যাজিস্ট্রেট সাড়ে ৯টার পর কাউকে ঢুকতে দেয়নি। অথচ এর আগের বিসিএস পরীক্ষায় ক্যান্ট পাবলিক স্কুল কেন্দ্রে আমার সিট পড়েছিল, সেখানে অনেকেই পরীক্ষা শুরুর ১০ মিনিট আগেও কেন্দ্রে ঢুকতে আমি দেখেছি। কিন্তু এবার এখানে ৫০-৬০ জনকে ম্যাজিস্ট্রেট ঢুকতে দেয়নি। একই কেন্দ্রে পরীক্ষায় বসতে না পারা শোভন সরকার জানান, আমার বাসা কুড়িগ্রাম। কারমাইকেল কলেজ থেকে অনার্স মাস্টার্স শেষ করি। আমি যানজটের কারণে ৯টা ৩৪ মিনিটে লায়ন্স স্কুল কেন্দ্রের গেটে উপস্থিত হই। কিন্তু ম্যাজিস্ট্রেট আমাকে ভেতরে ঢুকতে দেয়নি। আমরা এ সময় ৪০-৫০ জন ছিলাম। তাকে অনুরোধ করলেও তিনি সাফ জানিয়ে দেন, ৯টা ৩০ মিনিটেই গেট বন্ধ করা হয়েছে। এতদিনের প্রিপারেশন আমার ৩-৪ মিনিটেই নষ্ট হয়ে গেল। আমি এক বছর থেকে কনটিনিউ পড়াশুনার মধ্যেই ছিলাম। এটা আমার লাস্ট বিসিএস ছিল। আরেক পরীক্ষার্থী মুন্নি আক্তার জানান, আমি কারমাইকেল কলেজ থেকে হিসাববিজ্ঞানে অনার্স মাস্টার্স করেছি। আমার আসতে ৪ মিনিট লেট হয়েছে। আমি ম্যাজিস্ট্রেটের পায়ে পর্যন্ত ধরেছি। কান্নাকাটি করছি। কিন্তু তিনি আমাকে ঢুকতে দেয়নি। ৪০-৪৫ জনের মতো ছিলাম আমরা। আমার এত বছরের কষ্ট, পরিকল্পনা, পড়াশোনা তিন-চার মিনিটেই শেষ হয়ে গেল। আর যেন কারো এ রকম না হয়। এজন্য আমি ম্যাজিস্ট্রেটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানাই।
এ বিষয়ে রংপুরের ডিসি মোহাম্মদ মোবাশে^র হোসেন জানান, প্রত্যেকটি শিক্ষার্থীকে মোবাইলে ম্যাসেজসহ আগেই সার্কুলার জারি করে এই তথ্য জানানো হয়েছিল সকাল সাড়ে ৯টাতেই কেন্দ্রে প্রবেশ বন্ধ হয়ে যাবে। কিন্তু তারা তা না মেনে প্রবেশের চেষ্টার মাধ্যমে তাদের দায়িত্বহীনতা প্রমাণ করেছে।

এ বিষয়ে জানতে রংপুর বিভাগীর কমিশনায় জাকির হোসেনের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, ‘সরকারি কর্মকমিশনের নির্দেশনা অনুযায়ী যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করেছেন কর্তব্যরতরা। কখন উপস্থিত হবে বিষয়টিও স্পষ্টভাবে নির্দেশনা দেয়া হয়েছিল।’
সরকারি কর্মকমিশন রংপুর আঞ্চলিক কেন্দ্রের উপপরিচালক রোকসানা বেগম জানান, সাড়ে ৯টার পর কেউ কেন্দ্রে প্রবেশ করতে পারবে না। এটা পিএসসির হেড অফিস থেকে নির্দেশনা। এখানে আমাদের করণীয় কিছু নাই। ম্যাজিস্ট্রেটরা তাদের দায়িত্ব পালন করেছেন। পিএসসি রংপুর আঞ্চলিক কেন্দ্রের সহকারী পরিচালক আলতাফ হোসেন জানান, রংপুরের ১৮টি কেন্দ্রে ৩০ হাজার ৪৫১ জন পরীক্ষার্থীর পরীক্ষায় অংশগ্রহণের কথা ছিল। এর মধ্যে অনুপস্থিত ছিলেন ৭ হাজার ৫০ জন।

নির্দেশনা এলো পরীক্ষা শুরুর পর
৪৬তম বিসিএসের প্রিলিমিনারি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছে। সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত এ পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। পরীক্ষা ঘিরে শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে সরকারি কর্মকমিশনের (পিএসসি) একটি গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা ছিল সময়সূচি ও কেন্দ্রে প্রবেশের বিষয়ে। তবে অধিকাংশ শিক্ষার্থীদের কাছে পিএসসির নির্দেশনাটি পৌঁছেছে পরীক্ষার দিন পরীক্ষা শুরুরও ১৬ মিনিট পর। এ দিকে নির্ধারিত ৩০ মিনিট আগেই কেন্দ্রের গেট বন্ধ করে দেয়ায় পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারেননি অসংখ্য শিক্ষার্থী। খবর ঢাকা পোস্টের।
শুক্রবার সাড়ে ৯টায় দিকে রাজধানীর তেজর্গাও স্কুল অ্যান্ড কলেজ কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, নির্দেশনা জটিলতায় অন্তত ২০ জনের মতো শিক্ষার্থী কেন্দ্রে প্রবেশ করতে পারেননি। তাদের দাবি, শেষ সময়ে কেন্দ্রের সামনে অপেক্ষমাণ শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে কোনো সতর্কতা না দিয়েই গেট বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।

বেলা সাড়ে ১০টার দিকে তেজগাঁও স্কুল অ্যান্ড কলেজ কেন্দ্রের সামনে বসা তানজিয়া শারমিন নামের এক শিক্ষার্থীর সাথে কথা হলে তিনি পিএসসি থেকে মোবাইলে পাঠানো পরীক্ষাবিষয়ক একটি নির্দেশনা দেখান, যা এসেছে সকাল ১০টা ১৬ মিনিটে। তিনি বলেন, নির্দেশনায় বলা হয়েছে প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে সাড়ে ৯টার মধ্যে কেন্দ্রে প্রবেশ করতে হবে। কিন্তু সাড়ে ৯টার এই নির্দেশনা যদি ১০টার পর পরীক্ষা শুরু হলে আসে, তাহলে এই নির্দেশনা দিয়ে আমি কী করব? তানজিয়া শারমিন বলেন, আমি ঠিক ৯টা ২০ মিনিটেই পরীক্ষা কেন্দ্রে এসে পৌঁছেছি। যেহেতু কিছু সময় বাকি আছে, তাই চাইছিলাম বাকি সময়টাতে একনজর রিভিশন দিই। গেটের পাশেই বসে শিটে চোখ বুলাচ্ছিলাম। কিন্তু ৯টা ৩০ মিনিটেই গেটটা বন্ধ করে দিলো। আমার মতো এতগুলো শিক্ষার্থী যে গেটের বাইরে বসা, কর্তৃপক্ষ কোনো সতর্কতা বা নির্দেশনাও দেয়নি। ৯টা ৩১ মিনিটেও তাদের কাছে বারবার আকুতি জানিয়ে কোনো কাজ হয়নি।

কুমিল্লা থেকে ঢাকায় বিসিএস পরীক্ষা দিতে এসেছিলেন শাউলিনা রহমান। ১৫ মিনিট আগেই উপস্থিত হলেও শেষ সময়ে পরীক্ষার কেন্দ্রে ঢুকতে পারেনি। তিনি বলেন, আমি ৯টা ১৫ মিনিটেই এ এলাকায় চলে এসেছি। ঠিক ৯টা ৩১ মিনিটে রাস্তায় গেটের সামনে ছিলাম। সর্বশেষও আমি দেখলাম ঢুকতে দিচ্ছে, তখন আমি বাচ্চাটাকে এক পাশে বসিয়ে রেখে এসে দেখি গেট বন্ধ করে দিয়েছে। শাউলিনা বলেন, মূল গেটের দেওয়াল টপকে দ্বিতীয় গেটে এসেছি কিন্তু এখান থেকেও ঢুকতে দেয়নি। ম্যাজিস্ট্রেটকে বারবার রিকোয়েস্ট করার পরও ঢুকতে দেয়নি।
শুধু তানজিয়া শারমিন আর শাউলিনা রহমানই নয়, অন্তত ২০ জনের বেশি শিক্ষার্থী তেজগাঁও স্কুল অ্যান্ড কলেজে শেষ সময়ে পরীক্ষার কেন্দ্রে ঢুকতে পারেননি। শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, তাদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন যাদের এটাই ছিল জীবনের শেষ বিসিএস। শেষ স্বপ্নটা এভাবে ভেঙে যাওয়ায় অনেককে গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে হাউমাউ করে কাঁদতেও দেখা গেছে।

রফিকুল ইসলাম নামে এক অভিভাবকের সাথে কথা হলে তিনি বলেন, এই কেন্দ্রে যা হয়েছে, তা সম্পূর্ণ অন্যায়। কর্তব্যরত ম্যাজিস্ট্রেট ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অনেকটা এককগুয়েমি দেখিয়েছে। নয়তো এক মিনিটের জন্য এতগুলো শিক্ষার্থীর স্বপ্ন নষ্ট হয়ে যেত না। এক মিনিট তো মানুষের ঘড়ির কাঁটাও এ দিক-সে দিক হয়। এখানকার কর্তৃপক্ষ সম্পূর্ণ অমানবিকতা দেখিয়েছে।

এ দিকে পরীক্ষা শুরুর পর পিএসসির গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা আসা প্রসঙ্গে জানতে পিএসসি চেয়ারম্যান মো: সোহরাব হোসাইনের সাথে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তিনি কল রিসিভ করেননি। তবে এর কিছুক্ষণ আগেই পরীক্ষার্থীদের কেন্দ্রে ঢুকতে না পারা প্রসঙ্গে জানতে যোগাযোগ করা হলে পিএসসি চেয়ারম্যান বলেন, আমাদের নিয়মই ছিল ৩০ মিনিট আগে কেন্দ্রে প্রবেশ করতে হবে। এ বিষয়ে আমরা বারবার বলেছি, একটু সময় নিয়ে কেন্দ্রে আসবেন, ৩০ মিনিট আগেই কেন্দ্রে প্রবেশ করবেন। তারপরও যদি কোনো শিক্ষার্থী যথাসময়ে পরীক্ষার কেন্দ্রে আসতে না পারে, তাহলে আমাদের দৃষ্টিতে সে পরীক্ষার অযোগ্য।
এক মিনিটের জন্যও শিক্ষার্থীদের কথা বিবেচনা করা যেত কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, একজন এসে বলবে এক মিনিট, আরেকজন এসে বলবে পাঁচ মিনিট, এসব শুনলে তো আমার হবে না।

রাজশাহীতে রাস্তায় পরীক্ষার্থীর কান্না-গড়াগড়ি
রাজশাহী ব্যুরো জানায়, নির্ধারিত সময়ের কিছু পরে আসায় রাজশাহীতে পরীক্ষা হলে ঢুকতে দেয়া হয়নি ফাহাদ ফয়সাল নামে এক বিসিএস পরীক্ষার্থীকে। পরীক্ষা দিতে না দিলে মরে যাবেন- এমন বহু কাকুতি-মিনতি করেও কোনো কাজ হয়নি। ভেতরে প্রবেশ করতে না পেরে পরে ফাহাদ রাস্তায় শুয়ে গড়াগড়ি দিতে থাকেন এবং কান্নায় ভেঙে পড়েন। এ সময় তিনি বারবার বলছিলেন, এই পরীক্ষা না দিতে পারলে আমি মরে যাব স্যার। আমি আর বাঁচব না। এটাই আমার শেষ পরীক্ষা। একপর্যায়ে কাঁদতে কাঁদতে কেন্দ্রের সামনে থেকে ফিরে যান ফাহাদ। ঘটনাটি ঘটেছে গতকাল সকালে রাজশাহী নগরীর বড়কুঠি এলাকায় থাকা মসজিদ মিশন একাডেমি পরীক্ষাকেন্দ্রের সামনে।
প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় অংশ নেয়া কথা ছিল ফাহাদ ফয়সালের। তার বাড়ি নওগাঁ জেলায়।
জানা গেছে, ফাহাদ কেন্দ্রের সামনে এসেছিলেন ৯টা ৪০ মিনিটে। এরই মধ্যে পরীক্ষা কেন্দ্রের প্রধান ফটক বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। শুক্রবার রাজশাহী নগরীর ২৯টি কেন্দ্রে বিভাগের আটটি জেলা থেকে পরীক্ষার্থী ছিলেন ৩১ হাজার ৯৪৭ জন। এর মধ্যে পরীক্ষা দিয়েছেন ২৪ হাজার ১১৮ জন।

 


আরো সংবাদ



premium cement