২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ইন্দো-প্যাসিফিকে যুক্তরাষ্ট্রের দিক থেকে চীনমুখীও হতে পারে ঢাকা

ফরেন পলিসির প্রতিবেদন
-


যুক্তরাষ্ট্রের ফরেন পলিসির দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দিকে ঝুঁকছে। তবে চীনের সাথে সম্পর্ক গভীর করার জন্য বাংলাদেশ অবশ্যই যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল থেকে সরে আসতে পারে। এতে ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে নির্ধারিত বাংলাদেশের পরবর্তী নির্বাচন যদি অবাধ এবং অন্যায্য বলে বিবেচিত হয়, তাহলে পশ্চিমা দেশগুলো ঢাকার সাথে সম্পর্ককে পিছিয়ে দিতে পারে। তবে আপাতত নিরপেক্ষতার সীমা প্রসারিত করে বাংলাদেশ তার স্বার্থের সাথে এখনো আপস করেনি বলে বিশ্বাস করা হচ্ছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরে জোটনিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করে আসছে। তবে এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং এই অঞ্চলে তার অংশীদারদের দ্বারা অনুসৃত চীনকে মোকাবেলাকারী ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলের সম্পূর্ণ গ্রহণের কাছাকাছি চলে যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। গত মাসে, ঢাকা তার নিজস্ব ইন্দো-প্যাসিফিক আউটলুকের একটি খসড়া চূড়ান্ত করেছে যা তার উদ্দেশ্যগুলোর উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে। এতে একটি মুক্ত, নিরাপদ এবং শান্তিপূর্ণ অঞ্চল তৈরির মতো ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলগুলোর প্রতিফলন করে।
গত ৩০ মার্চ প্রকাশিত ফরেন পলিসির প্রতিবেদনে বলা হয় যে, বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল গ্রহণ করতে চায়। যুক্তরাষ্ট্রের এই ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলে অংশগ্রহণ বাংলাদেশকে প্রধান বাণিজ্য ও বিনিয়োগ অংশীদারের কাছাকাছি নিয়ে আসবে। বাংলাদেশ এবং ভারতের বর্তমান সরকার কাছাকাছি দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে। আর নয়াদিল্লি সম্ভবত ঢাকাকে কৌশলটি গ্রহণ করতে উৎসাহিত করেছে বলে ফরেন পলিসির প্রতিবেদক মাইকেল কুগেলম্যান উল্লেখ করেন।


প্রতিবেদনে বলা হয়, দুই বছর আগে, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপদেষ্টা গওহর রিজভী স্পষ্টভাবে বলেছিলেন যে ‘আমরা ইন্দো-প্যাসিফিক সম্পর্কের অংশ হতে খুব ইচ্ছুক’ এবং ভারত ‘আমাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার।’
একই সাথে প্রতিবেদনে বাংলাদেশ ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলকে গ্রহণ করার পথে এগুলেও চীনকে শান্ত করার চেষ্টা করা হচ্ছে বলে মন্তব্য করে বলা হয়, ঢাকার নিজস্ব খসড়া ইন্দো-প্যাসিফিক আউটলুকে বলা হয়েছে যে দেশটি সংঘাত এড়াতে চায় এবং এর কৌশলে কোনো নিরাপত্তাগত দিক নেই। পর্যবেক্ষকরা বলছেন যে তেমন কিছু যদি হয় তবে সেটিকে ‘নীতি’ বা ‘কৌশল’ না বলে একটি ‘দৃষ্টিভঙ্গি’ বলা যেতে পারে।
প্রতিবেদনে বলা হয় যে, চীনের সাথে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় নেশনস অ্যাসোসিয়েশনের এমন অনেক দেশ নিজস্ব ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল বেছে নিয়েছে। ঢাকাও ইঙ্গিত দেয়নি যে দেশটি কোয়াডে যোগ দেবে। তবে চীনকে এ বিষয়ে উদ্বিগ্ন বলে মনে হচ্ছে। গত সপ্তাহে, বাংলাদেশে নিযুক্ত চীনা রাষ্ট্রদূত ওয়াশিংটনের বিরুদ্ধে ঢাকাকে মার্কিন শিবিরে ঠেলে দেয়ার চেষ্টা করার অভিযোগ তোলেন।
এই অভিযোগ এমন সময় করা হয় যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা বলে যে বাংলাদেশের ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলের একটি অংশ হওয়া উচিত। গত সপ্তাহে জাপানের প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদা নয়াদিল্লিতে দেয়া এক বক্তৃতায় এই অঞ্চলের জন্য একটি ‘নতুন পরিকল্পনা’ গ্রহণের কথা উল্লেখ করে একটি নতুন অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব চুক্তি করাসহ বাংলাদেশের সাথে ব্যাপক সহযোগিতা গড়ার আহ্বান জানিয়েছেন। চলতি মাসেই যুক্তরাজ্যের ইন্দো-প্যাসিফিক মন্ত্রী অ্যান-মেরি ট্রেভেলিয়ান বাংলাদেশ সফর করেন।


প্রতিবেদনে বলা হয়, বৈশ্বিক নেতৃস্থানীয় দেশগুলো কেন বাংলাদেশকে ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলে অংশ নিতে চাইছে তা বোঝা সহজ। এ অঞ্চলটি কৌশলগত এলাকায় অবস্থিত যা ভারতের সীমান্তবর্তী এবং দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া উভয়ের প্রবেশদ্বার হিসেবে কাজ করে। যুক্তরাষ্ট্রের ও কোয়াড নামে পরিচিত চতুর্ভুজ নিরাপত্তা সংলাপের অন্যান্য সদস্য আর অনেক ইউরোপীয় দেশের সাথে ঢাকার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, অবকাঠামোগত ঋণের মাধ্যমে চীন বাংলাদেশে তার নিজস্ব প্রভাব বাড়িয়েছে, যাকে মার্কিন কর্মকর্তারা ব্যক্তিগতভাবে ঢাকার জন্য খারাপ চুক্তি হিসেবে বর্ণনা করেছেন। চীনের প্রতিদ্বন্দ্বীরা ভারত মহাসাগরের পশ্চিমাঞ্চলে জিবুতিতে অবস্থিত সামরিক ঘাঁটিসহ তার বর্ধিত নৌ উপস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন। এ সবই বাংলাদেশের অদূরবর্তী সামুদ্রিক এলাকায় অবস্থিত। চীন বাংলাদেশের অস্ত্রের একটি বড় সরবরাহকারীও। তাই যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক ভিশনে ঢাকাকে নিজস্ব বলয়ে পাওয়া একটি কৌশলগত বিজয় হবে।


প্রতিবেদনে মাইকেল কুগেলম্যান উল্লেখ করেন, আরো কৌতূহলী প্রশ্ন হলো বাংলাদেশ কেন ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল এবং চীনকে মোকাবেলার লক্ষ্যের সাথে যুক্ত হতে চাইবে। বাংলাদেশের কর্মকর্তারা কখনোই দেশটির প্রতিষ্ঠাতা নিরপেক্ষতার নীতি থেকে বিচ্যুত হননি, যা ১৯৭৪ সালে প্রতিষ্ঠাতা পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের একটি লাইনে তুলে ধরা হয়েছিল : ‘সবার সাথে বন্ধুত্ব, কারো সাথে বিদ্বেষ নয়।’ বাংলাদেশের লক্ষ্য প্রতিদ্বন্দ্বী রাষ্ট্রগুলোর সাথে সম্পর্কের ভারসাম্য বজায় রাখা। ভারতের পররাষ্ট্রনীতিও জোটনিরপেক্ষ, তবে তারা চীনকে কৌশলগত প্রতিদ্বন্দ্বী বলে মনে করে। এর পরও ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলে যুক্ত হবার মূল কারণ হিসেবে পশ্চিমের সাথে ঢাকার বাণিজ্য ও বিনিয়োগ নির্ভরতার বিষয়টি উল্লেখ করা হয়।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ঢাকাকে নিজস্ব বলয়ে নেবার ব্যাপারে চীন-রাশিয়া বলয় এবং যুক্তরাষ্ট্র-জাপান-ইউরোপ বলয়ের মধ্যে সরব-নীরব প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলছে। বাংলাদেশ কোন পক্ষে যাবে এ নিয়ে সুস্পষ্ট কোনো কথা না বললেও অতি সম্প্রতি ঢাকার চীন-রাশিয়া বলয়ের প্রতি ঝোঁক এবং কর্তৃত্বমূলক পরিবেশে একতরফা নির্বাচন অনুষ্ঠানের দিকে যাওয়ার প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে।

 


আরো সংবাদ



premium cement