২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`


বেড়েই চলেছে বেসরকারি খাতে বিদেশী ঋণ

৫ বছরের ব্যবধানে বেড়েছে ১০৮ শতাংশ, চাপ বাড়বে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে
-

বেসরকারি পর্যায়ে বিদেশী ঋণ বেড়েই চলেছে। আবার যথাসময়ে এসব ঋণ পরিশোধ না হওয়ায় খেলাপির খাতায় চলে যাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান মতে, গত ডিসেম্বর শেষে অফশোর ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে এ ঋণের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮১ হাজার ১৪৭ কোটি টাকা, যা পাঁচ বছর আগে ২০১৬ সালের ডিসেম্বর শেষে ছিল ৩৯ হাজার কোটি টাকা। পাঁচ বছরের ব্যবধানে বিদেশী ঋণ বেড়েছে ৪২ হাজার কোটি টাকা, যা শতকরা হিসেবে ১০৮ ভাগ। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে এ চিত্র উঠে এসেছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, গত দুই বছর করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে স্বাভাবিক বিনিয়োগের গতি মন্থর হয়ে যায়। বড় অঙ্কের প্রণোদনার অর্থ বিতরণ করা হয়। এক বছরে প্রায় এক লাখ ৯ হাজার কোটি টাকার বিভিন্ন প্রণোদনা প্যাকেজের ঋণ বিতরণ করা হয়। সরকার ব্যাংকগুলোকে সাড়ে চার শতাংশ থেকে ৫ শতাংশ পর্যন্ত সুদ ও মুনাফার ওপর ভর্তুকি দেয়। উদ্যোক্তারা এ খাত থেকে ঋণ পায় চার থেকে সাড়ে চার শতাংশে সুদে। কিন্তু এর পরও বেসরকারি খাতে বিদেশী ঋণ বেড়ে যায়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, দেশে কার্যত ৬০টি ব্যাংকের মধ্যে ১২টি ব্যাংকের মাধ্যমে কোনো বিদেশী ঋণ নেয়নি উদ্যোক্তারা। ৪৮টি ব্যাংকের মাধ্যমে গত ডিসেম্বর শেষে বিদেশী ঋণ এসেছে ৮১ হাজার ১৪৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে এক হাজার ১০৯ কোটি টাকাই খেলাপি হয়ে গেছে। অর্থাৎ গ্রাহকরা সময় মতো বিদেশী এসব ঋণ পরিশোধ করেননি। খেলাপি হওয়ায় এসব ঋণ পরিচর্চা ব্যয়ও বেড়ে যাচ্ছে।

পাঁচ বছর আগের পরিসংখ্যানের দিকে তাকালে দেখা যায়, ২০১৬ সালের ডিসেম্বর শেষে ওবিইউর মাধ্যমে বিদেশী ঋণ এসেছিল ৩৯ হাজার ২২৮ কোটি টাকা। পাঁচ বছরের ব্যবধানে বিদেশী ঋণ বেড়েছে ৪২ হাজার কোটি টাকা, যা শতকরা হিসেবে প্রায় ১০৮ শতাংশ।

বেসরকারি খাতে বিদেশী ঋণ বেড়ে যাওয়ায় এর বিপরীতে নির্দিষ্ট মেয়াদান্তে বৈদেশিক মুদ্রায় সুদ চলে যাচ্ছে দেশের বাইরে। আর এ কারণে বঞ্চিত হচ্ছেন দেশের আমানতকারীসহ সাধারণ গ্রাহক।

অফশোর ব্যাংকিংয়ে ঋণ বেড়ে যাওয়ার বিষয়ে ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, এতে দু’ধরনের সঙ্কটে পড়তে যাচ্ছে দেশ। প্রথমত, চলমান পরিস্থিতিতে বিদেশী ঋণের সুদ পরিশোধ করতে তেমন সমস্যা হচ্ছে না। কিন্তু বিনিয়োগচাহিদা আরো বাড়লে তখন বৈদেশিক মুদ্রার ব্যবহার বেড়ে যাবে। আর আজকে যে বিদেশী ঋণ নেয়া হচ্ছে তাও একসময় সুদে আসলে পরিশোধ করতে হবে। এক দিকে বিনিয়োগচাহিদা বাড়লে বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদা বাড়বে, পাশাপাশি বিদেশী ঋণের সুদসহ আসল পরিশোধ করতে চাপে পড়বে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। তখন আজকে যে ডলার পাওয়া যাচ্ছে ৮৬ টাকায়, চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় ওই ডলার কিনতে অতিরিক্ত চার টাকাও ব্যয় করতে হলে বিদেশী ঋণের প্রকৃত সুদও বেড়ে যাবে।

দ্বিতীয়ত, গত দুই বছরের করোনাভাইরাসের ধকলের কারণে অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। আবার যেগুলো চালু রয়েছে সেগুলোর অনেকেই শ্রমিক ছাঁটাই করেছে। এদিকে নিত্যপণ্যের দামও বেড়ে গেছে। সব মিলে ব্যাংকে আমানতপ্রবাহ কমে গেছে। এক দিকে বিনিয়োগচাহিদা বাড়ছে, অপর দিকে কমছে আমানতপ্রবাহ। কিন্তু রেমিট্যান্স কমে যাওয়ার ধারা অব্যাহত রয়েছে। ফলে ব্যাংকের পণ্য আমদানির দায় মেটাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে হাত পাততে হচ্ছে। সব মিলেই বৈদেশিক মুদ্রার ওপর চাপ রয়েছে। এমনি পরিস্থিতিতে বিদেশী ঋণ সুদে আসলে পরিশোধ করতে গিয়ে বৈদেশিক মুদ্রার মজুদের ওপর চাপ আরো বেড়ে যাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে দেশের প্রথম প্রজন্মের একটি ব্যাংকের তহবিল ব্যবস্থাপক জানিয়েছেন, এখন অফশোর ব্যাংকিংয়ের নামে দেদার আনছে বিদেশী তহবিল। আগে মূলধনী যন্ত্রপাতিসহ কয়েকটি খাতে অফশোর ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে তহবিল জোগান দেয়ার সুযোগ ছিল। এখন সার, আলু বীজসহ আরো কয়েকটি খাতে এ তহবিল আনার সুযোগ দেয়া হয়।

জানা গেছে, বাংলাদেশ ব্যাংক একজন ব্যবসায়ীর কাছ থেকে ব্যাংকের সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ সুদ আরোপের অনুমোদন দেয়া আছে। ব্যাংকগুলো ব্যবসায়ীদের চাহিদা অনুযায়ী বিদেশী প্রতিষ্ঠান থেকে সাড়ে ৩ থেকে সাড়ে ৪ শতাংশ সুদে বৈদেশিক মুদ্রায় ঋণ নিয়ে গ্রাহকের বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদা মেটাচ্ছে।

যেমন, কোনো গ্রাহক ৫০ কোটি ডলারের মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি করল। স্থানীয় ব্যাংক বিদেশী প্রতিষ্ঠান থেকে বৈদেশিক মুদ্রায় ৪ শতাংশ সুদে আমানত নিয়ে বিদেশী রফতানিকারক প্রতিষ্ঠানকে বৈদেশিক মুদ্রায় পরিশোধ করল। শর্তানুযায়ী ছয় মাস পর আমদানিকারক সর্বোচ্চ ৬ শতাংশ সুদে সংশ্লিষ্ট ব্যাংককে পরিশোধ করছে। এটাই অফশোব ব্যাংকিং। এভাবে ঋণ নেয়া বা দেয়ার সুনির্দিষ্ট সীমারেখা দেয়া নেই বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে। এ সুযোগে কিছু কিছু ব্যাংক দেদার আনছে বিদেশী ঋণ। আর নির্দিষ্ট মেয়াদ শেষে সুদে আসলে বৈদেশিক মুদ্রায় পরিশোধ করা হচ্ছে। তিন মাস থেকে পাঁচ বছর মেয়াদে এ ধরনের ঋণ নেয়া হচ্ছে।

ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, বৈদেশিক ঋণের হ্রাস এখনই টেনে ধরতে হবে। বৈদেশিক দায় আরো বাড়লে চাপ বেড়ে যাবে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে। কেননা, প্রতি মাসেই তিন শ’ থেকে সাড়ে তিন শ’ কোটি ডলার পরিশোধ করতে আয় আমদানির দায় মেটাতে। এর সমপরিমাণ বৈদেশিক ঋণের দায় মেটাতে হলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ প্রবল চাপের মুখে পড়ে যাবে, যা এক সময় এর চাপ সামলানো কঠিন হয়ে পড়বে। চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে দেশ।

দেখুন:

আরো সংবাদ



premium cement