০৯ মে ২০২৪, ২৬ বৈশাখ ১৪৩১, ২৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`


আতঙ্কে এলাকা ছেড়েছে গণ্ডামারা এলাকার পুরুষ

বাঁশখালীতে শ্রমিক-পুলিশ সংঘর্ষে দুই মামলায় আসামি সাড়ে ৩ হাজার

-

চট্টগ্রামের বাঁশখালীর গণ্ডামারায় কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রে চীনা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাছে বকেয়া বেতন পরিশোধ, বেতন বৃদ্ধি, রমজানে কর্মঘণ্টা কমানো এবং ইফতারের সময় এক ঘণ্টার ছুটিসহ নানা দাবিতে সংঘর্ষের ঘটনায় বিক্ষোভকারী শ্রমিকদের বিরুদ্ধে দু’টি পৃথক মামলা হয়েছে। দু’টি মামলায় সাড়ে তিন হাজারের বেশি ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে।
গত শনিবারের ঘটনার পর থেকেই বাঁশখালির গণ্ডামারাসহ আশপাশের এলাকায় আতঙ্কাবস্থা বিরাজ করছে। হয়রানি ও হামলার আশঙ্কায় গণ্ডামারার বেশির ভাগ পুরুষ ইতোমধ্যে এলাকা ছেড়ে চলে গেছেন বলে স্থানীয় সূত্র জানিয়েছে।
বাঁশখালী থানার ওসি শফিউল কবির গতকাল দুপুরে নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, বিদ্যুৎকেন্দ্রে পুলিশের ওপর হামলার ঘটনায় শনিবার রাতে উপপরিদর্শক (এসআই) রাশেদ বাদি হয়ে দুই থেকে আড়াই হাজার অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তির বিরুদ্ধে একটি মামলা করেছেন। এ ছাড়া যানবাহনে অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুরের অভিযোগে নির্মাণাধীন এসএস পাওয়ার প্ল্যান্টের প্রধান সমন্বয়ক ফারুক আহমেদ বাদি হয়ে ২২ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত আরো এক হাজার ৪০ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন। গতকাল দুপুর পর্যন্ত এ ঘটনায় কাউকে গ্রেফতার করা হয়নি বলে তিনি জানান। বিদ্যুৎকেন্দ্র এলাকার পরিস্থিতি এখন সম্পূর্ণ শান্ত দাবি করে তিনি জানান, সেখানে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে শতাধিক পুলিশ মোতায়েন রয়েছে।
গত শনিবারের ঘটনার জন্য পরস্পরকে দায়ী করছে পুলিশ ও শ্রমিকরা। আর বিদ্যুৎকেন্দ্রের বেশির ভাগ শেয়ারের মালিক এস আলম গ্রুপের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে, ২০১৬ সালের মতো এবারের বিক্ষোভের পেছনেও তৃতীয় পক্ষের ‘উসকানি’ রয়েছে। গণ্ডামারার স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, শনিবারের ঘটনার পর একদিকে শোক আর আতঙ্কের জনপদে পরিণত হয়েছে পুরো গণ্ডামারা ও আশপাশের এলাকা। এ ঘটনায় দায়েরকৃত মামলায় কয়েক হাজার অজ্ঞাত আসামি থাকায় ২০১৬ সালের ন্যায় আবার হয়রানির ভয়ে শনিবার সন্ধ্যায় বিদ্যুৎকেন্দ্রের শ্রমিকসহ বেশির ভাগ পুরুষকেই এলাকা ছেড়ে চলে যেতে দেখা গেছে।
বিদ্যুৎকেন্দ্রটিতে দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়িক গ্রুপ এস আলম গ্রুপের ছয়টি কোম্পানির ৭০ শতাংশ এবং চীনা কোম্পানি সেপকোথ্রি ইলেক্ট্রিক পাওয়ার কনস্ট্রাকশন করপোরেশন ও এইচটিজি ডেভেলপমেন্ট গ্রুপ কোম্পানি লিমিটেডের ৩০ শতাংশ বিনিয়োগ রয়েছে। চীনা প্রতিষ্ঠানটিই বিদ্যুৎকেন্দ্রটি তৈরি করে দিচ্ছে। সেখানে চীনা ও বাংলাদেশী মিলিয়ে প্রায় পাঁচ হাজার শ্রমিক কাজ করছে। কয়েকটি শ্রমিক সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে চুক্তিভিত্তিক, স্থায়ী ও অস্থায়ী শ্রমিক নিয়োগ দেয়া হয়। এদের বেশির ভাগই দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে আসা; স্থানীয় শ্রমিকের সংখ্যা তুলনামূলক কম। সেখানে দিন-রাত মিলিয়ে কয়েক পালায় কাজ চলে। প্রকল্প এলাকার ভেতরেই শ্রমিকদের থাকায় জায়গা।
প্রসঙ্গত, বাঁশখালীর গণ্ডামারা ইউনিয়নে নির্মাণাধীন ১৩২০ মেগাওয়াটের ‘এসএস পাওয়ার প্ল্যান্টে’ গত শনিবার শ্রমিকদের সাথে পুলিশের সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে পাঁচ শ্রমিক নিহত হন। আহত হয়েছেন অনেকেই। ইতোপূর্বেও এই বিদ্যুৎ প্রকল্পের কাজের শুরুতে ২০১৬ সালে জমি অধিগ্রহণ নিয়ে স্থানীয়দের সাথে পুলিশের সংঘর্ষে পাঁচজন নিহত হয়।
শ্রমিক নিরাপত্তা ফোরামের উদ্বেগ : চট্টগ্রামের বাঁশখালীর গণ্ডামারায় নির্মাণাধীন বিদ্যুৎকেন্দ্রে বকেয়া বেতন পরিশোধ ও কাজের সময়সীমা পরিবর্তনের দাবিতে আন্দোলনরত শ্রমিকদের ওপর পুলিশের গুলিবর্ষণে পাঁচজন শ্রমিক নিহত এবং পুলিশসহ ৩০ জন শ্রমিক আহতের ঘটনায় শ্রমিক নিরাপত্তা ফোরাম-এসএনএফ গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করছে।
শ্রমিক নিরাপত্তা ফোরাম মনে করে, আন্দোলনরত শ্রমিকদের ওপর পুলিশের গুলিবর্ষণের বিষয়টি অনাকাক্সিক্ষত ও অন্যায়, যা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। কোভিড-১৯ সময়েও মাথার ঘাম পায়ে ফেলে দেশের অর্থনীতিকে যে শ্রমিকরা টিকিয়ে রেখেছেন সেসব শ্রমিককে জীবনের নিরাপত্তা ও সুরক্ষার অধিকার লঙ্ঘন করে পুলিশ কর্তৃক এভাবে গুলি করে হত্যাও চরম নিন্দনীয়।
ফোরাম উপরি উক্ত ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের জোর দাবি জানাচ্ছে। পাশাপাশি দোষী ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা, নিহত শ্রমিকদের পরিবারকে আজীবন আয়ের সমান ক্ষতিপূরণ, আহত শ্রমিকদের সুচিকিৎসা ও ক্ষতিপূরণ প্রদানের দাবি জানাচ্ছে। একই সাথে শ্রমিকদের ন্যায়সঙ্গত দাবি মেনে নেয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছে। শ্রমিক নিরাপত্তা ফোরাম সারা দেশে শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছে।
শ্রমিক নিরাপত্তা ফোরাম স্মরণ করিয়ে দিতে চায় যে, সমবেত হওয়ার এবং ন্যায্য দাবিতে আন্দোলন করা যেকোনো নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার যা অন্যান্য মানবাধিকার দলিলেও সুষ্পষ্ঠভাবে উল্লিখিত আছে। মহামারি করোনাকালীন শ্রমিকরা নানা দুর্দশার মধ্যে রয়েছেন। অনেকে চাকরি হারিয়েছেন, অনেকের মজুরি কমে গেছে। তা সত্ত্বেও শ্রমিকদের বেতন যথাসময়ে কেন পরিশোধ করা হলো না সে বিষয়টি খতিয়ে দেখার এবং তদন্ত করে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য শ্রমিক নিরাপত্তা ফোরাম জোর দাবি জানাচ্ছে।


আরো সংবাদ



premium cement