২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

এমসি কলেজে গণধর্ষণে তোলপাড়

অভিযুক্ত ৬ ছাত্রলীগ নেতা, উত্তাল ক্যাম্পাস, অভিযানে অস্ত্র উদ্ধার
ধর্ষণের ঘটনায় উত্তাল সিলেট এমসি কলেজ ক্যাম্পাস। ধর্ষণের ঘটনায় অভিযুক্ত আসামিরা (ইনসেটে) : নয়া দিগন্ত -

সিলেট এমসি কলেজ ছাত্রাবাসে ছাত্রলীগ ক্যাডারদের গণধর্ষণের ঘটনায় সারা দেশে তোলপাড় চলছে। আট বছর আগে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের পৈশাচিক অগ্নিসংযোগের ঘটনার পর আবারো আলোচনায় এলো এই কলেজটি। সরকারি নির্দেশে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও ছাত্রাবাস বন্ধ থাকার মধ্যে কী করে ওই প্রতিষ্ঠানে সশস্ত্র দুর্বৃত্তরা অবস্থান করছিল তা নিয়ে বিস্মিত সবাই। গত শুক্রবার সন্ধ্যায় কলেজ ক্যাম্পাসে বেড়াতে আসা এক গৃহবধূকে ধরে নিয়ে হোস্টেলের কক্ষে মারধর ও স্বামীর সামনে ধর্ষণের ঘটনায় বিভিন্ন মহল থেকে নিন্দার ঝড় বইছে। এ ঘটনার প্রতিবাদে ক্যাম্পাস ও সংলগ্ন সড়কে ব্যাপক বিক্ষোভ করেছে শিক্ষার্থীরা। পুলিশ ঘটনার রাতেই ছাত্রাবাসে অভিযান চালিয়ে এক অভিযুক্তের কক্ষ থেকে অস্ত্রশস্ত্র উদ্ধার করলেও জড়িত ছয় ছাত্রলীগ ক্যাডার এখনো পলাতক। এ দিকে সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ওই তরুণী এখন মানসিকভাবে বিপর্যস্ত অবস্থায় রয়েছেন বলে জানিয়েছেন পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ইউনুসুর রহমান।
সিলেটের ছাত্রলীগ ক্যাডাররা এখনো বেপরোয়া। সরকারি দলের ছাত্র সংগঠনে থাকার দাপটে তারা যা ইচ্ছে তাই করে যাচ্ছে। গত কয়েক বছরে তারা অসংখ্য অপকর্মের পাশাপাশি নিজ দলের অন্তত এক ডজন নেতাকর্মীকে নৃশংসভাবে খুন করেছে। এই ক্যাডারদের বেশির ভাগের অবস্থান এমসি কলেজ সংলগ্ন টিলাগড় পয়েন্ট ও আশপাশ এলাকায়। কতিপয় প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতা তাদের জামাই আদরে লালন করায় তারা অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে নির্বিঘেœ। এরাই ২০১২ সালের ৮ জুলাই এমসি কলেজ ছাত্রাবাস পুড়িয়ে দিয়ে উল্লাস করে। ওই ঘটনার ৮ বছর পর এ হোস্টেলেই গত শুক্রবার সন্ধ্যায় এক নবদম্পতিকে ধরে এনে মারধর করে ৬ ছাত্রলীগ ক্যাডার। এরপর স্বামীকে বেঁধে তার সামনেই তরুণী স্ত্রীকে ধর্ষণ করে তারা। এ জঘন্য ঘটনার পর শুধু সিলেট নয়; সারা দেশে নানা মহল থেকে ধিক্কার আর নরাধমদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি উঠেছে। এ ঘটনায় গতকাল বিকেলে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত কেউ ধরা পড়েনি।
স্বামীর সাথে এমসি কলেজে বেড়াতে এসে ওই কলেজের ছাত্রাবাসে ছাত্রলীগ ক্যাডারদের ধর্ষণের শিকার তরুণী বধূ এখন সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। এ ঘটনায় ৬ ছাত্রলীগ নেতাসহ ৯ জনকে অভিযুক্ত করে থানায় মামলা করা হয়েছে। শুক্রবার মধ্যরাতে ছাত্রাবাসটিতে অভিযান চালায় পুলিশ। এ সময় আগ্নেয়াস্ত্রসহ বেশকিছু অস্ত্র উদ্ধার করা হয়। ছাত্রলীগ নেতাদের অপকর্মের প্রতিবাদে ও তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে গতকাল শনিবার দুপুরে এমসি কলেজ ও সংলগ্ন সিলেট সরকারি কলেজের ছাত্ররা সিলেট-তামাবিল সড়ক অবরোধ করে বিক্ষাভ প্রদর্শন করে।
বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, শুক্রবার বিকেলে ওই তরুণী স্বামীকে নিয়ে প্রাইভেটকারে এমসি কলেজে ঘুরতে আসেন। এ সময় ছাত্রলীগের ৬ ক্যাডার তাদের জিম্মি করে ছাত্রাবাসে নিয়ে যায়। সেখানে মারধরের পর স্বামীকে বেঁধে তরুণীকে ধর্ষণ করে। রাত সাড়ে ১০টার দিকে ওই দম্পতিকে ছাত্রাবাস থেকে উদ্ধার করে পুলিশ। পরে ধর্ষণের শিকার তরুণীকে ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ওসিসি সেন্টারে ভর্তি করা হয়। রাতেই এ ঘটনা জানাজানি হলে সর্বত্র ক্ষোভের সঞ্চার হয়। ছাত্রলীগ ক্যাডারদের গ্রেফতার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছে বিভিন্ন সংগঠন। গণধর্ষণের ঘটনায় ৬ জনের নামে মামলা করা হয়েছে শাহপরাণ থানায়। একই মামলায় অজ্ঞাত আরো তিনজনকে আসামি করা হয়েছে। শুক্রবার মধ্যরাতে এ মামলা দায়ের করেন ওই তরুণীর স্বামী।
শাহপরাণ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আব্দুল কাইয়ুম মামলার সত্যতা নিশ্চিত করে বলেন, মামলায় ৬ জন সরাসরি জড়িত বলে অভিযুক্ত করা হয়েছে। অন্য ৩ জনের বিরুদ্ধে সহযোগিতার অভিযোগ আনা হয়েছে। আসামিরা হলোÑ এমসি কলেজ ছাত্রলীগের নেতা ইংরেজি বিভাগের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী শাহ মো: মাহবুবুর রহমান রনি (২৫), কলেজ ছাত্রলীগ নেতা এম সাইফুর রহমান (২৮), ছাত্রলীগ নেতা তারেক (২৮), অর্জুন লস্কর (২৫), রবিউল ইসলাম (২৫) ও মাহফুজুর রহমান মাছুম (২৫)। তাদের মধ্যে সাইফুর রহমানের গ্রামের বাড়ি বালাগঞ্জে, রবিউলের বাড়ি সুনামগঞ্জ জেলার দিরাই উপজেলায়, মাহফুজুর রহমান মাছুমের বাড়ি সিলেট সদর উপজেলায়, অর্জুনের বাড়ি সিলেটের জকিগঞ্জে, রনির বাড়ি হবিগঞ্জে এবং তারেক সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর উপজেলার বাসিন্দা।
এ দিকে শুক্রবার মধ্যরাতে ছাত্রাবাসটিতে অভিযান চালায় পুলিশ। এ সময় পিস্তলসহ বেশকিছু অস্ত্র উদ্ধার করা হয়। পুলিশ জানায়, অভিযানকালে একটি বিদেশী পিস্তল, চারটি রামদা, দু’টি লোহার পাইপ উদ্ধার করা হয়। ধর্ষণের ঘটনায় অভিযুক্ত ছাত্রলীগ নেতা সাইফুর রহমানের কক্ষ থেকে এসব অস্ত্র উদ্ধার করা হয়। অভিযানে অংশ নেয়া শাহপরাণ থানার এসআই লিপটন পুরকায়স্থ অস্ত্র উদ্ধারের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। শাহপরাণ থানার ওসি আব্দুল কাইয়ুম বলেন, যাদের কক্ষ থেকে অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র আইনে মামলা করা হবে।
অস্ত্র নিয়ে থাকত ছাত্রলীগ ক্যাডাররা : করোনাভাইরাস পরিস্থিতির কারণে মার্চ থেকে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার ঘোষণা দিয়েছিল সরকার। সরকারের নির্দেশনা থাকার পরেও এমসি কলেজের ছাত্রাবাসে প্রভাব খাটিয়ে অস্ত্র নিয়ে থাকত ছাত্রলীগের কিছু চিহ্নিত ক্যাডার। ক্যাডারদের পাশাপাশি কলেজের বিভিন্ন বিভাগের সাধারণ শিক্ষার্থীরাও ছাত্রাবাসে বসবাস করে আসছিলেন। সিলেট মহানগর পুলিশের উপ পুলিশ কমিশনার (গণমাধ্যম) জ্যোর্তিময় সরকার বলেন, অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে ছাত্রাবাসে পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। সেই সাথে কলেজ কর্তৃপক্ষের নির্দেশে ছাত্রাবাস ছাড়ছেন শিক্ষার্থীরা।
শিক্ষার্থীদের সড়ক অবরোধ : এমসি কলেজ ছাত্রাবাসে ধর্ষণের ঘটনায় আন্দোলনে নেমেছেন শিক্ষার্থীরা। গতকাল শনিবার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে এমসি ও সরকারি কলেজের প্রায় শতাধিক শিক্ষার্থী কলেজের সামনে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন। অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে কলেজ ও ছাত্রাবাসে বিপুল পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। শিক্ষার্থীর অভিযোগ করেন, করোনা পরিস্থিতিতে কলেজ বন্ধ থাকার পরেও ছাত্রাবাস কিভাবে খোলা রাখেন কলেজ কর্তৃপক্ষ। এ সময় শিক্ষার্থীরা ধর্ষণের ঘটনার সাথে জড়িতদের দ্রুত গ্রেফতারের দাবি জানান। অন্যথায় তারা কঠোর কর্মসূচি ঘোষণা করবেন বলে জানান।
ঘটনা ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করেন আ’লীগ নেতারা : একটি সূত্র জানায়, এ ধর্ষণের ঘটনা ধাপাচাপা দেয়ার চেষ্টা করেন স্থানীয় কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতা। তারা আপস-মীমাংসারও চেষ্টা চালান। প্রথমদিকে পুলিশও বিষয়টি গণমাধ্যমের কাছে এড়িয়ে যায়। পরে গণমাধ্যমসহ বিভিন্ন মাধ্যমে বিষয়টি জানাজানি হয়ে যাওয়ায় ধাপাচাপা দেয়ার চেষ্টা বিফলে যায়। তবে দীর্ঘ সময়ক্ষেপণের কারণে ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয় অভিযুক্তরা। সন্ধ্যার পর এই খবর পেয়ে টিলাগড় এলাকার একাধিক আওয়ামী লীগ নেতা ও কয়েকজন সাবেক ছাত্রলীগ নেতা ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন। প্রথমে তারা বিষয়টি ধাপাচাপা দেয়ার চেষ্টা করেন। খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে যাওয়ার পর তারা বিষয়টি আপসে শেষ করার চেষ্টা চালান। এ সময় ধর্ষণের শিকার নারী ও তার স্বামীকে আপস-মীমাংসার জন্য চাপ দেয়া হয় বলেও জানা গেছে। তবে ধর্ষণ ঘটনার খবর পেয়ে গণমাধ্যম কর্মীরা ঘটনাস্থলে হাজির হওয়ায় ধামাপাচা দেয়ার চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যায়। এ সময় আওয়ামী লীগ নেতারাও ঘটনাস্থল থেকে সরে পড়েন। আপস-মীমাংসার চেষ্টার অভিযোগ অস্বীকার করে সিলেট মহানগরের শাহপরাণ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কাইয়ুম চৌধুরী জানান, এক দম্পতিকে আটকে রাখা হয়েছে খবর পেয়েই আমরা এমসি কলেজ ছাত্রাবাসে যাই। এরপর সেখান থেকে তাদের উদ্ধার করি।
তদন্ত কমিটি গঠন : এমসি কলেজের ছাত্রাবাসে গৃহবধূকে (১৯) ধর্ষণের ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। গতকাল শনিবার দুপুরে কলেজ কর্তৃপক্ষ জরুরি বৈঠকে বসে এই কমিটি গঠন করে। তিন সদস্যবিশিষ্ট কমিটিকে আগামী ৭ কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেয়া হয়। কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর সালেহ উদ্দিন আহমদ বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, কলেজের গণিত বিভাগের প্রধান আনোয়ার হোসেনকে আহ্বায়ক, হোস্টেল সুপার জামাল উদ্দিন ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জীবন কৃষ্ণ ভট্টাচার্যকে সদস্য করে কমিটি গঠন করা হয়েছে।

 


আরো সংবাদ



premium cement