২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

বিশ্বের শীর্ষ ব্যাংকগুলোর বেআইনি লেনদেন ফাঁস

-

টাকার উৎস নিয়ে প্রশ্ন ওঠার পরও বিশ্বের বড় ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে গত দুই দশকে বিপুল অঙ্কের সন্দেহজনক তহবিল লেনদেন হওয়ার নতুন এক কেলেঙ্কারি প্রকাশ্যে এসেছে। যুক্তরাষ্ট্রে সরকারের কাছে ব্যাংকগুলোর জমা দেয়া গোপনীয় নথির উদ্ধৃতি দিয়ে বাজফিড ও অন্যান্য গণমাধ্যম বিষয়টি নিয়ে রোববার রিপোর্ট প্রকাশ করেছে।
গণমাধ্যমের রিপোর্টগুলো যুক্তরাষ্ট্রের অর্থ মন্ত্রণালয়ের ফিন্যান্সিয়াল ক্রাইম এনফোর্সমেন্ট নেটওয়ার্কের (ফিনসেন) কাছে ব্যাংক ও অন্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর দাখিল করা ফাঁস হওয়া সাসপিসাস অ্যাক্টিভিটি রিপোর্টসের (সার্স) ভিত্তিতে করা হয়েছে। এ ধরনের (সার্স) দুই হাজার একশটিরও বেশি নথি বাজফিড নিউজের হাতে এসেছে এবং তারা সেগুলো ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম অব ইনভেস্টিগেশন জার্নালিস্ট (আইসিআইজে) ও অন্যান্য গণমাধ্যম সংস্থার সাথে শেয়ার করেছে।
আইসিআইজে জানিয়েছে, সব মিলিয়ে ওই নথিগুলোতে ১৯৯৯ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত দুই ট্রিলিয়ন ডলারেরও বেশি অর্থ লেনদেনের তথ্য আছে, এই তহবিলগুলোকে সন্দেহজনক বলে চিহ্নিত করেছিল আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ইন্টারনাল কমপ্লায়েন্স ডিপার্টমেন্ট। সন্দেহজনক লেনদেনের প্রতিবেদনগুলো (সার্স) সরাসরি অপরাধের প্রমাণ নয় আর ফাঁস হওয়া এই নথিগুলো ফেনসেনের কাছে দাখিল করা প্রতিবেদনগুলোর একটি ক্ষুদ্রাংশ বলে জানিয়েছে আইসিআইজে। আইসিআইজে আরো জানিয়েছে, এই নথিগুলোতে সবচেয়ে বেশি যে বহুজাতিক ব্যাংকগুলোর নাম এসেছে সেগুলো হলো, এইচএসবিসি হোল্ডিংস পিএলসি, জেপিমর্গান চেস অ্যান্ড কোম্পানি, ডয়েচে ব্যাংক এজি, স্ট্যান্ডার্ড চাটার্ড ব্যাংক এবং নিউ ইয়র্ক মেলন করপোরেশন। ব্যাংকগুলো প্রায়ই বিদেশে নিবন্ধিত কোম্পানির অ্যাকাউন্টে কোটি কোটি ডলার ট্রান্সফার করেছে। এ ক্ষেত্রে তারা আসল মালিকের তথ্য যাচাই করেনি। এই কোম্পানিগুলোর বেশির ভাগ ভেনিজুয়েলা, ইউক্রেন ও মালয়েশিয়ায়।
ফিনসেন ফাইলথস কী?
ফিনসেন ফাইলস হচ্ছে ফাঁস হয়ে যাওয়া প্রায় আড়াই হাজার দলিল। ২০০০-২০১৭ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন ব্যাংক যুক্তরাষ্ট্রের কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠিয়েছিল এসব দলিল। ব্যাংকের গ্রাহকরা আসলে যা করছেন, সে বিষয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে এসব দলিলে।
আন্তর্জাতিক ব্যাংকিং ব্যবস্থায় সবচেয়ে কঠোর গোপনীয়তা বজায় রাখা হয়, এমন ধরনের দলিল এগুলো। ব্যাংকগুলো যখন কোনো গ্রাহকের আচরণে সন্দেহজনক কিছু দেখে, তখন তারা এরকম রিপোর্ট পাঠায় মার্কিন কর্তৃপক্ষের কাছে। কিন্তু এসব দলিল অপরাধ বা বেআইনি কোনো কাজের প্রমাণ নয়। এই দলিলগুলো ফাঁস করা হয়েছিল বাজফিড নিউজের কাছে। এরপর সারা বিশ্বের অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের সাথে এসব দলিল শেয়ার করা হয়। ৮৮টি দেশের ১০৮টি সংবাদ প্রতিষ্ঠানের কাছে এসব দলিল বিতরণ করা হয়। বিবিসির প্যানোরামা অনুষ্ঠানও এই অনুসন্ধান কাজে যুক্ত ছিল। শত শত সাংবাদিক এই বিপুল পরিমাণ দলিল ঘেঁটে অনুসন্ধান কাজটি চালিয়েছেন। বেশির ভাগ দলিল খুবই টেকনিক্যাল। ব্যাংকগুলো প্রকাশ করতে চায় না, এমন অনেক কাজকর্ম সাংবাদিকরা তাদের অনুসন্ধানের মাধ্যমে উদঘাটন করেছেন।
ফিনসেন ও সার্স : এ দু’টি সংক্ষিপ্ত শব্দের মানে কী : ফিনসেন হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইমস ইনভেস্টিগেশন নেটওয়ার্কের (ফিনসেন) সংক্ষিপ্ত রূপ। এরা যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি ডিপার্টমেন্টে আর্থিক অপরাধ দমনে কাজ করে। মার্কিন ডলারে যত লেনদেন হয়, সেটা যদি যুক্তরাষ্ট্রের বাইরেও ঘটে থাকে, সেই লেনদেন নিয়ে প্রশ্ন থাকলে তা ফিনসেনের কাছে পাঠাতে হয়।
সার্স হচ্ছে ইংরেজিতে সাসপিসিয়াস এক্টিভিটি রিপোর্টসের সংক্ষিপ্ত রূপ। এরকম সন্দেহজনক লেনদেনের বিষয়গুলো এই সার্সের মাধ্যমে রেকর্ড করে রাখা হয়। কোনো ব্যাংকের যদি তাদের কোনো গ্রাহকের লেনদেন নিয়ে সন্দেহ জাগে, তখন এই সার্স রিপোর্ট লিখে তাদের পাঠাতে হয় মার্কিন কর্তৃপক্ষের কাছে।
এর গুরুত্ব কোথায়?
আপনি যদি কোনো অপরাধমূলক কার্যক্রম চালিয়ে লাভবান হওয়ার পরিকল্পনা কষে থাকেন, তাহলে একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আগে আপনাকে ঠিক করে রাখতে হবে। সেটা হচ্ছে, অর্জিত অবৈধ কালো অর্থ কিভাবে আপনি ‘সাদা’ করবেন। মানি লন্ডারিং মানে হচ্ছে কালো টাকা সাদা করার প্রক্রিয়া। যেমন, মাদক চোরাচালান বা দুর্নীতির মাধ্যমে পাওয়া অর্থ কোনো একটা ব্যাংকের অ্যাকাউন্টে এমনভাবে জমা করা, যাতে আগের অপরাধের সাথে এই অর্থের কোনো যোগসূত্র খুঁজে পাওয়া না যায়। ধরা যাক আপনি একজন রুশ অলিগার্ক বা ধনী গোষ্ঠীপতি ব্যবসায়ী। আপনার বিরুদ্ধে পশ্চিমা দেশগুলো নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে, যাতে আপনি এসব দেশে অর্থ আনতে না পারেন। এখন অর্থ পাচার করতে গেলে আপনাকে একই ধরনের ‘মানি লন্ডারিং’-এর আশ্রয় নিতে হবে।
নিয়ম ভেঙে কোনো গ্রাহক যেন এভাবে অর্থ পাচার করতে না পারে বা কালো অর্থ সাদা করতে না পারে, সেটা নিশ্চিত করা ব্যাংকগুলোর কাজ। আইন অনুযায়ী, ব্যাংকগুলোকে অবশ্যই জানতে হবে তাদের গ্রাহক কারা। যুক্তরাষ্ট্রের কাছে একটা সার্স রিপোর্ট পাঠিয়ে দিলেই ব্যাংকগুলোর দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। গ্রাহকদের কাছ থেকে কালো অর্থ নেয়া অব্যাহত রেখে তারা এটা আশা করতে পারে না যে কর্তৃপক্ষই এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে। যদি ব্যাংকগুলোর কাছেই কোনো অপরাধমূলক কাজের প্রমাণ থাকে তখন তাদেরই এরকম লেনদেনে বন্ধে ব্যবস্থা নেয়া উচিথত।
ফার্গাস শিয়েল কাজ করেন ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম অব ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্টসের (আইসিআইজে) সাথে। তিনি বলছেন, বিশ্বজুড়ে কী বিপুল পরিমাণ কালো অর্থ পাচার হচ্ছে তার ওপর দৃষ্টিপাতের সুযোগ করে দিয়েছে এই ফাঁস হওয়া দলিলগুলো। তিনি বলেন, এই লেনদেনের সাথে কী বিপুল অঙ্কের অর্থ জড়িত, সেটাও তুলে ধরেছে এসব দলিল। ফিনসেন ফাইলসের দলিলগুলোতে আছে প্রায় দুই লাখ কোটি ডলারের লেনদেনের কথা। অথচ ২০০০-২০০১৭ সাল পর্যন্ত যত সার্স রিপোর্ট পাঠানো হয়েছে, এই ফিনসেন ফাইলস কিন্তু তার একটি অতি ক্ষুদ্র অংশ।
ফাঁস হওয়া দলিল থেকে যা জানা গেছে : একটি আন্তর্জাতিক ব্যাংক জালিয়াত চক্রকে চুরি করা কোটি কোটি ডলার পাচার করতে দিয়েছে। মার্কিন তদন্তকারীদের কাছ থেকে এই স্কিমটি যে একটি ধাপ্পাবাজি সেটা জানার পরও তারা এই লেনদেন হতে দিয়েছে। জেপি মর্গান একটি কোম্পানিকে লন্ডনের একটি অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে ১০০ কোটি ডলার লেনদেন করতে দিয়েছে। অথচ জেপি মর্গান জানতোই না কোম্পানিটির মালিক কে। পরে জেপি মর্গান জানতে পারে যে এই কোম্পানিটির মালিক হয়তো এমন এক অপরাধী গোষ্ঠীর নেতা, যার নাম আছে যুক্তরাষ্ট্রের এফবিআইয়ের সবচেয়ে দুর্ধর্ষ দশ ফেরারি আসামির তালিকায়। রুশ প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিনের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ একজন সহযোগী তার বিরুদ্ধে জারি করা নিষেধাজ্ঞা এড়াতে লন্ডনের বার্কলেজ ব্যাংককে ব্যবহার করেছেন। অথচ এই নিষেধাজ্ঞার উদ্দেশ্যই ছিল তিনি যেন পশ্চিমা বিশ্বের কোনো আর্থিক সেবা ব্যবহার করতে না পারেন। এই পাচার করা অর্থ দিয়ে শিল্পকর্ম কেনা হয়েছে। ফিনসেনের ইন্টেলিজেন্স বিভাগের মতে, ব্রিটেন এখন সাইপ্রাসের মতোই ‘উচ্চ ঝুঁকির এলাকা’। ব্রিরটনে নিবন্ধিত যে পরিমাণ কোম্পানির নাম সার্স রিপোর্টে এসেছে, সেই কারণেই এটা হয়েছে। ফিনসেন ফাইলে ব্রিটেনের তিন হাজারের বেশি কোম্পানির নাম আছে। বিশ্বের আর কোনো দেশের এত বেশি কম্পানির নাম ফিনসেন ফাইলে নেই। ইরানের বিরুদ্ধে যে নিষেধাজ্ঞা জারি রয়েছে, সেটি এড়াতে সংযুক্ত আরব আমিরাতের একটি কোম্পানি সহায়তা করছিল। কিন্তু এ নিয়ে সতর্ক করে দেয়ার পরও সংযুক্ত আরব আমিরাতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক কোনো ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হয়। সঙ্ঘবদ্ধ অপরাধী গোষ্ঠী, সন্ত্রাসবাদ ও মাদক চোরাচালানকারীদের কালো টাকা পাচার করতে দিয়েছে ডয়েচে ব্যাংক। জর্দানের একটি ব্যাংক আরব ব্যাংকেথর গ্রাহকের অ্যাকাউন্ট এক দশকের বেশি সময় ধরে সন্ত্রাসবাদের অর্থ জোগানোর কাজে ব্যবহৃত হয়েছে। অথচ স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক তাদের অর্থ লেনদেন করতে দিয়েছে।
এবারের ফাঁস হওয়া দলিল কেন আলাদা : সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এরকম আরো অনেক আর্থিক দলিল ফাঁস হয়েছে। এর মধ্যে ছিল ২০১৭ সালের প্যারাডাইস পেপার্স : অফশোর আইনি সেবা প্রতিষ্ঠান অ্যাপলবি এবং করপোরেট সেবা প্রতিষ্ঠান এস্টেরার বিপুল পরিমাণ গোপন দলিল ফাঁস হয়ে গিয়েছিল। এই দু’টি প্রতিষ্ঠানই ‘অ্যাপলবি’ নামে কার্যক্রম চালাত। তবে ২০১৬ সালে অ্যাস্টেরা স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ শুরু করে। ফাঁস হওয়া দলিল থেকে জানা গিয়েছিল রাজনীতিক, নামকরা তারকা ও ব্যবসায়ী নেতাদের আর্থিক লেনদেনের খবর।
২০১৬ সালের পানামা পেপার্স : বিশ্বের ধনী লোকজন কিভাবে অফশোর প্রতিষ্ঠান ব্যবহার করে কর ফাঁকি দেয় তা প্রকাশ পেয়েছিল আইনি প্রতিষ্ঠান মোসাক ফনসেকার ফাঁস হয়ে যাওয়া দলিলপত্রের মাধ্যমে। ২০১৫ সালে সুইস লিকস : এইচএসবিসির সুইস প্রাইভেট ব্যাংকের কিছু দলিল ফাঁস হয়ে যায়। এতে দেখা যায় এই ব্যাংকটি কিভাবে সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকিং গোপনীয়তাবিষয়ক আইন ব্যবহার করে তাদের গ্রাহকদের কর ফাঁকি দিতে সাহায্য করছিল। ২০১৪ সালের লাক্স-লিকস : অ্যাকাউন্টিং প্রতিষ্ঠান প্রাইসওয়াটারহাউসকুপার্সের কিছু দলিল ফাঁস হলো, যাতে দেখা গেল বড় বড় কম্পানি লুক্সেমবার্গের করব্যবস্থাকে ব্যবহার করছে, যাতে করে তাদের কর প্রদানের অঙ্ক অনেক কমিয়ে আনা যায়। তবে ফিনসেন ফাইলস আগের ফাঁস হওয়া দলিলপত্র থেকে একটু আলাদা। এগুলো কেবল একটি বা দু’টি কোম্পানির দলিলপত্র নয়। এসব দলিল এসেছে বহু ব্যাংক থেকে। এই দলিলপত্রে ধরা পড়েছে অনেক সন্দেহজনক লেনদেন যার সাথে জড়িত অনেক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান। যেসব ব্যাংকের মাধ্যমে এসব লেনদেন হয়েছে, তাদের চোখে বিষয়টি ধরা পড়ার পরও কেন তারা ব্যবস্থা নেয়নি, সে প্রশ্নও উঠেছে। ফিনসেন বলেছে, এসব দলিল ফাঁস হওয়ার ফলে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তার ওপর এর প্রভাব পড়তে পারে। এতে তাদের নিজস্ব তদন্তে বিঘœ হতে পারে। যেসব প্রতিষ্ঠান এবং ব্যক্তি এসব রিপোর্ট পাঠিয়েছে তাদের নিরাপত্তাও হুমকির মুখে পড়তে পারে। ফিনসেন অবশ্য গত সপ্তাহে অর্থ পাচার-বিরোধী কার্যক্রম ঢেলে সাজানোর লক্ষ্যে এক প্রস্তাব ঘোষণা করেছে। যুক্তরাজ্যও ঘোষণা করেছে যে, জালিয়াতি ও অর্থ পাচার প্রতিরোধে তারা কোম্পানি নিবন্ধন সংক্রান্ত তথ্যের নিয়মনীতি সংস্কার করে ঢেলে সাজাচ্ছে।


আরো সংবাদ



premium cement