২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

মোর্শেদকে অব্যাহতি মানবাধিকার লঙ্ঘন : রাষ্ট্রপতিকে অ্যামনেস্টি

-

ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় (ঢাবি) মার্কেটিং বিভাগের অধ্যাপক ড. মোর্শেদ হাসান খানকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেয়া আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের লঙ্ঘন বলে অভিহিত করেছে মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। গত বুধবার সংগঠনটির ওয়েবসাইটে এ তথ্য জানানো হয়েছে। সেখানে রাষ্ট্রপতি মো: আব্দুল হামিদ বরাবর একটি চিঠিতে এই মন্তব্য করে অ্যামনেস্টি। ড. মোর্শেদের নিরাপত্তাসহ একাধিক বিষয়ে জরুরি ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানিয়ে ‘পদচ্যুত অধ্যাপক হুমকিতে’ শীর্ষক চিঠিতে বলা হয়Ñ অধ্যাপক মো: মোর্শেদ হাসান খান রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগের মুখোমুখি হয়েছেন। এমনকি পত্রিকায় মতপ্রকাশের জন্য তাকে পেশাগত অবস্থান থেকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে। ড. মোর্শেদ অজ্ঞাত ব্যক্তিদের কাছ থেকে একাধিক মৃত্যুর হুমকি পেয়েছেন। তাকে বিশ^বিদ্যালয়ের বাসায় না যেতে বলা হয়েছে। সেখানে তার ক্যান্সার আক্রান্ত স্ত্রী ও ছোট সন্তান থাকেন। অ্যামনেস্টির বিবৃতিতে বলা হয়Ñ শুধু ২০১৯ সালেই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের (ডিএসএ) আওতায় ৭৩২টি মামলায় কমপক্ষে ১ হাজার ৩২৫ জনকে আটক করা হয়। দোষী প্রমাণিত হলে অধ্যাপক মোর্শেদ যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের মুখোমুখি হতে পারেন। এমতাবস্থায় রাষ্ট্রপতি তথা বিশ^বিদ্যালয়ের চ্যান্সেলরকে দ্রুত পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে চিঠিতে।
অ্যামনেস্টির দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক গবেষক সুলতান মুহাম্মদ জাকারিয়া কলম্বো থেকে এই চিঠির বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি ড. মোর্শেদ ও তার পরিবারকে নিরাপত্তা দেয়া এবং চাকরিতে পুনর্বহালের জন্য সরকারের কাছে আহ্বান জানান।
চিঠিতে অ্যামনেস্টি জানায়, একটি পত্রিকায় মতপ্রকাশের কারণে অধ্যাপক ড. মোর্শেদ হাসান খানকে হয়রানি, ভয় দেখানোর বিষয়ে আমি উদ্বিগ্ন। রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ এবং মৃত্যুর হুমকির মুখেই ঢাবি সিন্ডিকেট ড. মোর্শেদকে চাকরি থেকে বাদ দিয়েছে। এটি খুবই আশঙ্কার বিষয় যে, একজন শিক্ষাবিদ শুধু তার বাকস্বাধীনতার অধিকার প্রয়োগের কারণে তার জীবন আজ হুমকির মুখোমুখি। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করার অভিযোগে তদন্ত কমিটির ত্রুটিপূর্ণ রিপোর্ট পর্যালোচনা ছাড়াই ড. মোর্শেদকে ১৯৭৩ সালের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আদেশের বিধি ৫৬(৩) এর অধীনে ‘ নৈতিক স্খলন’ বা ‘অদক্ষতা’ এর ভিত্তিতে বরখাস্ত করা হয়েছে।
চিঠিতে বলা হয় শুধু মতপ্রকাশের কারণে বাংলাদেশ দণ্ডবিধি ১৮৬০ এর ১২৪(এ) ধারার অধীনে ড. মোর্শেদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ আনা হয়েছে। এ জাতীয় অভিযোগ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এতে ‘নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার’ বিষয়ক আন্তর্জাতিক চুক্তির (আইসিসিপিআর) ১৯ অনুচ্ছেদের লঙ্ঘন করেছে। বাংলাদেশ একটি রাষ্ট্র হিসেবে এই চুক্তি প্রত্যয়ন করেছে। তা ছাড়া এটি জানতে পেরে আমরা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন যে, ফোন এবং সোস্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে অধ্যাপক মোর্শেদ অজ্ঞাত ব্যক্তিদের তরফ থেকে মৃত্যুর হুমকির সম্মুখীন হয়েছেন বলে জানা গেছে।
চিঠিতে অধ্যাপক মোর্শেদ হাসান খান এবং তার পরিবারের সুরক্ষা এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। ড. মোর্শেদ হাসান খানের বরখাস্ত পুনর্বিবেচনা করে তাকে পদে পুনর্বহাল এবং তার বিরুদ্ধে বাংলাদেশ দণ্ডবিধি ধারা ১২৪(এ) এর অধীনে আনা সমস্ত অভিযোগ অনবিলম্বে বাতিল করার আহ্বান জানানো হয়েছে রাষ্ট্রপতিকে।
প্রসঙ্গত, ড. মোর্শেদ হাসান খান রাষ্ট্রপতি শহীদ জিয়াউর রহমানের ভূমিকা সম্পর্কে ২০১৮ সালের ২৬ মার্চ দৈনিক নয়া দিগন্তে একটি মতামত লিখেছিলেন। পরে একই বছরের ২ এপ্রিল ‘মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত’ এবং ‘জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের অসম্মান’ করার অভিযোগ এনে তাকে সব শিক্ষামূলক ও প্রশাসনিক দায়িত্ব থেকে সাময়িক অব্যাহতি দেয় ঢাবি প্রশাসন। ওই বছরের ২৮ মে ঢাবি এই অভিযোগগুলো তদন্তের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রোভিসির নেতৃত্বে ৫ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। প্রায় দুই বছর ধরে অজ্ঞাত কারণে বিষয়টি চাপা পড়েছিল। ২০২০ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি ঢাবি কর্তৃপক্ষ ড. মোর্শেদের বিরুদ্ধে ২০১৮ সালে আনীত অভিযোগ বিচারের জন্য ট্রাইব্যুনাল গঠন করে। এই অভিযোগের জবাব দিতে ট্রাইব্যুনাল তাকে সাত দিন সময় দিয়েছিল, যা তিনি করেছিলেন। গত ৯ সেপ্টেম্বর ঢাবি সিন্ডিকেট তাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করে।
অ্যামনেস্টি জানায়, ১৯৭৩’র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আদেশের ৫৬(৩) অনুসারে একজন শিক্ষককে কেবলÑ ‘নৈতিকস্খলন, অদক্ষতা, বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন ও চাকরিবিধি পরিপন্থী’ কাজের সাথে যুক্ত থাকার অপরাধে টার্মিনেট করা যেতে পারে। তবে তদন্ত কমিটির মাধ্যমে তদন্ত রিপোর্টের ভিত্তিতে। এমনকি তদন্ত কমিটিতে শিক্ষক বা কর্মকর্তা কর্তৃক মনোনীত কোনো ব্যক্তি প্রতিনিধিত্ব করতে পারেন। ততক্ষণ পর্যন্ত কোনো শিক্ষক বা কর্মকর্তা বরখাস্ত হবেন না। ড. মোর্শেদের বিষয়ে গঠিত তদন্ত কমিটির এক সদস্য উক্ত আইনের উল্লেখ করে কমিটির সিদ্ধান্তের বিষয়ে মতবিরোধের একটি নোট (নোট অব ডিসেন্ট) দিয়েছেন। তিনি অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালকে বলেছেন ‘এই মামলায় একটি গুরুতর প্রক্রিয়াগত ত্রুটি পরিলক্ষিত হয়েছে। যেহেতু বিধি ৫৬(৩) প্রদত্ত দু’টি কারণের কোনোটিই নয়। অধ্যাপক মোর্শেদ অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালকে বলেছেন ১৯৭৩ সালের আদেশের ৫৬(৩) বিধি তাকে তদন্ত কমিটিতে প্রতিনিধি রাখারও অধিকার দিয়েছে। কিন্তু এই ক্ষেত্রে সেটা করা হয়নি।’
ড. মোর্শেদকে বরখাস্তের দিন ক্ষমতাসীন ছাত্রলীগের সাথে যুক্ত ঢাবির এক শিক্ষার্থী ঢাকার সিএমএম আদালতে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা করেন। বাংলাদেশ দণ্ডবিধির ১২৪(এ) ধারায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে। এই ধারায়Ñ যে কারো বিরুদ্ধে শুধু সরকারের সমালোচনা করার জন্য অভিযোগ আনা যেতে পারে। এ ধরনের আইনি বিধানগুলো আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ। তা ছাড়া এটা নাগরিক এবং রাজনৈতিক অধিকার সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক চুক্তির (আইসিসিপিআর) ১৯ অনুচ্ছেদের লঙ্ঘন করে। অ্যামনেস্টির দাবিÑ ২০১৮ সালের মার্চে কিছু অজ্ঞাত ব্যক্তি ড. মোর্শেদকে ডেকে নিবন্ধে তার মতপ্রকাশের জন্য মৃত্যুর হুমকি দিয়েছে। তারপরও তিনি মৃত্যুর একাধিক হুমকি পেয়েছেন। ২০১৮ সালের মার্চে প্রথম হুমকির পরে তিনি তাৎক্ষণিকভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরকে ফোন করে নিরাপত্তা চেয়েছিলেন।
ড. মোর্শেদ এই প্রতিবেদককে জানান, অসাবধানতাবশত ২০১৮ সালের ২৬ শে মার্চ নয়া দিগন্তে প্রকাশিত আমার একটি নিবন্ধে ‘বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি’র অভিযোগ তোলা হয়। এ নিয়ে সমালোচনা হলে আমি ওই দিনই তাৎক্ষণিকভাবে ক্ষমা ও দুঃখ প্রকাশ করে উক্ত প্রবন্ধে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে যেসব বাক্য ব্যবহৃত হয়েছে তা প্রত্যাহার এবং বঙ্গবন্ধুর প্রতি আমার সম্মান ও শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে প্রেস বিজ্ঞপ্তি দেই; যা ২০১৮ সালের ২৭ মার্চ নয়া দিগন্তে প্রকাশিত হয়। এমনকি নয়া দিগন্ত অনলাইন থেকেও ‘জ্যোতির্ময় জিয়া’ শীর্ষক লেখাটি তাৎক্ষণিকভাবে সরিয়ে ফেলা হয়। তবুও আমাকে চাকরি থেকে অব্যাহতির সিদ্ধান্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৯৭৩-এর আদেশ এবং ঢাবির প্রথম স্ট্যাটিউটের সম্পূর্ণবিরোধী। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের সবধরনের নিয়ম মেনে আমার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের বিরুদ্ধে বক্তব্য তুলে ধরেছি। এরপরও আমাকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অব্যাহতি দেয়া বিশ্ববিদ্যালয় আদেশের পরিপন্থী। আমার প্রতি কোনো ন্যায়বিচার করা হয়নি। বর্তমানে তাকে বিশ^বিদ্যালয়ের বাসায় না যাওয়ার জন্য অজ্ঞাত ব্যক্তিরা হুমকি দিচ্ছে বলে তিনি অভিযোগ করেন।

 


আরো সংবাদ



premium cement