২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

বঙ্গবন্ধুর হত্যা মামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি ক্যাপ্টেন মাজেদ কারাগারে

মাজেদ গ্রেফতার মুজিববর্ষের শ্রেষ্ঠ উপহার : স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী; ভারতে আত্মগোপনে ছিলেন
-

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যা মামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত পলাতক আসামি ক্যাপ্টেন (বরখাস্ত) আবদুল মাজেদকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হয়েছে। গতকাল ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম জুলফিকার হায়াৎ তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন। এরপর বেলা ১টা ৫ মিনিটের দিকে তাকে প্রিজন ভ্যানে কেরানীগঞ্জে অবস্থিত ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হয়। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের জেলার মাহবুব আলম সাংবাদিকদের বলেন, ১টা ৪৫ মিনিটে আবদুল মাজেদকে আদালত থেকে কারাগারে আনা হয়। এখন তাকে কারাগারে রাখা হয়েছে।
এর আগে দুপুর সোয়া ১২টার দিকে ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ধারায় তাকে ঢাকা মহানগর হাকিম আদালতে হাজির করে পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি)। এ সময় বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় তাকে গ্রেফতার না দেখানো পর্যন্ত কারাগারে আটক রাখার আবেদন করে কাউন্টার টেরোরিজম।
আবেদনে বলা হয়, আসামি ক্যাপ্টেন (বরখাস্ত) আবদুল মাজেদ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যা মামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি। সে দীর্ঘ দিন পলাতক ছিল। এই মামলায় তাকে গ্রেফতার না দেখানো পর্যন্ত কারাগারে আটক রাখার আবেদন করছি।
এর আগে তাকে মঙ্গলবার ভোররাতে রাজধানীর মিরপুর সাড়ে ১১ নাম্বার থেকে গ্রেফতার করে ডিএমপির কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমের (সিটিটিসি) একটি দল।
যা বললেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল : গতকাল দুপুরে গণমাধ্যমে পাঠানো এক ভিডিও বার্তায় প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আত্মস্বীকৃত খুনি ক্যাপ্টেন আবদুল মাজেদকে (বরখাস্ত) গ্রেফতার করা হয়েছে। ‘এটি মুজিববর্ষের শ্রেষ্ঠ উপহার আমরা দেশবাসীকে দিতে পেরেছি।’
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, আমরা দীর্ঘ দিন বঙ্গবন্ধুর খুনিদের দেশে ফিরিয়ে এনে তাদের সাজা কার্যকর করার অপেক্ষায় ছিলাম। তার মধ্যে অন্যতম একজন খুনি আবদুল মাজেদ পুলিশের কাছে ধরা পড়েছে। আমরা তাকে আদালতে সোপর্দ করি। আদালত তাকে হাজতবাসের জন্য নির্দেশনা দিয়েছে, সেখানে তাকে পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে। তার স্ত্রী সালেহা বেগমের বাড়ি নম্বার-১০/এ, রোড নাম্বার এক, ক্যান্টনমেন্ট আবাসিক এলাকায় সেখানেই বসবাস করছিলেন আবদুল মাজেদ। তার সব তথ্য আমাদের গোয়েন্দাদের কাছে ছিল।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ধানমন্ডির ৩২ নাম্বারের বাসায় বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের সময় ক্যাপ্টেন আবদুল মাজেদ, নুর এবং রিসালদার মোসলেহ উদ্দিন এই তিনজনের অবস্থান সেখানে ছিল। এ ছাড়া আরো কয়েকজন ছিলেন। এই খুনি শুধু বঙ্গবন্ধুর খুনে অংশগ্রহণ করেননি। তিনি জেলহত্যায়ও অংশগ্রহণ করেছিলেন বলে আমাদের জানা রয়েছে। খুনের পরে জিয়াউর রহমানের নির্দেশ মোতাবেক তিনি (আবদুল মাজেদ) বঙ্গভবন এবং অন্যান্য জায়গায় কাজ করেছেন। আমরা আশা করি, তার দণ্ডাদেশ আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী কার্যকর করতে পারব। যারা যারা এই কাজে (গ্রেফতারে) সম্পৃক্ত ছিলেন তাদের সবাইকে ধন্যবাদ দিয়ে এটাকে মুজিববষের্র শ্রেষ্ঠ উপহার আমরা দেশবাসীকে দিতে পেরেছি বলে মনে করি ।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, বঙ্গবন্ধুর খুনিদের তৎকালীন জিয়াউর রহমান সরকার বিচারের বদলে নানাভাবে পুরস্কৃত করেছে। তাদের যাতে বিচার না হয়, সেই ব্যবস্থাটাও পাকাপোক্ত করেছিলেন। এই খুনিকে আমরা দেখেছি বিভিন্ন সময় জিয়া সরকার দূতাবাসে চাকরি ছাড়া দেশে-বিদেশে চাকরি দিয়েছেন। ১৯৯৭ সালে আওয়ামী লীগ সরকার যখন ক্ষমতায় আসে তার আগে এই খুনি আত্মগোপন করেন। এর পর থেকে আমাদের গোয়েন্দারা তাকে নজরদারিতে রেখেছিল।
এত দিন কোথায় ছিলেন : গ্রেফতার হওয়া মাজেদ পুলিশের কাছে বলেন, গ্রেফতার এড়াতে দীর্ঘ দিন তিনি ভারতসহ বিভিন্ন দেশে আত্মগোপনে ছিলেন। তবে রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি হেমায়েত উদ্দিন খান হিরণ আদালতে তোলার পর তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। তখন মাজেদ তাকে বলেন, গ্রেফতার এড়াতে তিনি গত ২০ থেকে ২২ বছর ধরে কলকাতায় আত্মগোপনে ছিলেন।
কিভাবে ফিরলেন : আদালতে আইনজীবীর জিজ্ঞাসাবাদে কিছু না বললেও আইনশৃঙ্খলারবাহিনী ধারণা করছে, করোনাভাইরাসের কারণে ভারত থেকে অনেককেই পুশব্যাক করা হয়েছে। সে কারণে সেখান থেকে ২৬ মার্চ ময়মনসিংহের সীমান্ত এলাকা দিয়ে অবৈধভাবে বাংলাদেশে প্রবেশ করে থাকতে পারেন মাজেদ। এর আগে লিবিয়া ও পাকিস্তানে আত্মগোপনে ছিলেন তিনি।
সূত্র জানায়, ১৯৯৫ সালের দিকে বাংলাদেশ থেকে ভারতে যান তিনি। সেখান থেকে পাকিস্তানে, এরপর লিবিয়ায়। সেখান থেকে ২০১৬ সালে আবারো ভারতে ফেরেন তিনি।
যেভাবে গ্রেফতার : পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের পরিদর্শক জহিরুল হক আদালতকে জানান, সোমবার দিবাগত রাত ৩টা ৪৫ মিনিটে আবদুল মাজেদকে গাবতলীতে রিকশায় ঘোরাফেরা করতে দেখা যায়। তখন সন্দেহ হয় পুলিশের। এ সময় তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। তার কথাবার্তা অসংলগ্ন মনে হয়। জিজ্ঞাসাবাদের মুখে তিনি স্বীকার করেন, তার নাম মাজেদ। তিনি বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত ও মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত খুনি।
এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের অপরাধ তথ্য ও প্রসিকিউশন বিভাগের উপকমিশনার এবং আদালত পুলিশ প্রধান মো: জাফর হোসেন সাংবাদিকদের জানান, আদালতে হাজির করার সময় আসামি মাজেদের পরনে ছিল সাদা পাঞ্জাবি ও পাজামা তার উপরে বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট ও মাথায় হেলমেট ছিল। এ সময় তার হাতে ছিল হাতকড়া ও মুখে মাস্ক পরা ছিল। শুনানির সময় আদালতে কোনো আইনজীবী মাজেদের পক্ষে দাঁড়াননি। পরে শুনানি শেষে আদালতের আদেশের পরপরই মাজেদকে প্রিজন ভ্যানে করে কেরানীগঞ্জে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠিয়ে দেয়া হয়।
জানা গেছে, ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। বিদেশে থাকায় প্রাণে বেঁচে যান কেবল বঙ্গবন্ধুর দুই মেয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার বোন শেখ রেহানা। পরে এই হত্যাকাণ্ডের বিচারের পথ রুদ্ধ করে দেয়া হয়। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরপরই দায়মুক্তি (ইনডেমনিটি) অধ্যাদেশ জারি করা হয়। ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালের ১২ নভেম্বর দায়মুক্তি আইন বাতিল করে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। ওই বছরের ২ অক্টোবর ধানমন্ডি থানায় বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত সহকারী মহিতুল ইসলাম বাদি হয়ে মামলা করেন।
পরে ১৯৯৮ সালের ৮ নভেম্বর তৎকালীন ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ কাজী গোলাম রসুল ১৫ জনকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দিয়ে রায় ঘোষণা করেন। নিম্ন আদালতের এই রায়ের বিরুদ্ধে আসামিদের আপিল ও মৃত্যুদণ্ড নিশ্চিতকরণের শুনানি শেষে ২০০০ সালের ১৪ ডিসেম্বর হাইকোর্ট দ্বিধাবিভক্ত রায় দেন। ২০০১ সালের ৩০ এপ্রিল হাইকোর্টের তৃতীয় বেঞ্চ ১২ আসামির মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে তিনজনকে খালাস দেন। এরপর ১২ আসামির মধ্যে প্রথমে চারজন ও পরে এক আসামি আপিল করেন; কিন্তু এরপর ছয় বছর আপিল শুনানি না হওয়ায় আটকে যায় বিচারপ্রক্রিয়া।
দীর্ঘ ছয় বছর পর বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে আপিল বিভাগে একজন বিচারপতি নিয়োগ দেয়ার পর বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলাটি আবার গতি পায়। ২০০৭ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর আপিল বিভাগের বিচারপতি মো: তাফাজ্জাল ইসলামের নেতৃত্বাধীন তিন বিচারপতির বেঞ্চ মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত পাঁচ আসামির লিভ টু আপিল শুনানির জন্য গ্রহণ করেন। আপিলের অনুমতির প্রায় দুই বছর পর ২০০৯ সালের অক্টোবরে শুনানি শুরু হয়। ২০০৯ সালের ১৯ নভেম্বর সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ পাঁচ আসামির আপিল খারিজ করেন। ফলে বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সদস্যদের নৃশংসভাবে হত্যার দায়ে হাইকোর্টের দেয়া ১২ খুনির মৃত্যুদণ্ডাদেশ বহাল থাকে।
পরে ২০১০ সালের ২৮ জানুয়ারি ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ডাদেশ কার্যকর করা হয় সৈয়দ ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার রশীদ খান, মহিউদ্দিন আহমদ (ল্যান্সার), এ কে বজলুল হুদা এবং এ কে এম মহিউদ্দিনের (আর্টিলারি)। ওই রায় কার্যকরের আগেই ২০০২ সালে পলাতক অবস্থায় জিম্বাবুয়েতে মারা যান আরেক আসামি আজিজ পাশা।
কিন্তু ফাঁসির দণ্ডাদেশ পাওয়া বাকি ছয় আসামি বিদেশে পলাতক থাকেন। তাদের বিষয়ে ইন্টারপোল থেকে রেড নোটিশ জারি করে প্রতি পাঁচ বছর পরপর নবায়ন করা হচ্ছিল। এরা হলেনÑ খন্দকার আবদুর রশিদ, এ এম রাশেদ চৌধুরী, শরিফুল হক ডালিম, এস এইচ এম বি নূর চৌধুরী, আবদুল মাজেদ ও রিসালদার মোসলেহ উদ্দিন খান।

 


আরো সংবাদ



premium cement