২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

সৈয়দ আলী আহসানের চিত্ত ও বিত্ত

জন্ম : ২৬ মার্চ ১৯২২, মৃত্যু : ২৫ জুলাই ২০০২ -

বাংলা সাহিত্যের হাতেগোনা কয়েকজন কবি-সাহিত্যিকের মধ্যে সৈয়দ আলী আহসান একজন। তার লেখার চিত্ত ও বিত্তবৈভবে মুগ্ধ হবে না এমন পাঠক খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। যদিও পাঠ্যবইয়ের কবিতার মাধ্যমে তার সাথে আমার প্রথম পরিচয়, কিন্তু পরবর্তী সময়ে তার লেখার প্রেমে পড়ে যাই। বিশেষ করে কবিতার কথা না বললেই নয়। সেই কবে পড়েছিলাম কবির লেখা আমার পূর্ববাংলা কবিতাটি। এখনো যা মনের গহিনে মাঝে মাঝেই উঁকি দেয়। বিড় বিড় করে আনমনে পাঠ করি।
সৈয়দ আলী আহসান আমার পূর্ববাংলা কবিতায় বলেছেন- ‘আমার পূর্ববাংলা একগুচ্ছ স্নিগ্ধ অন্ধকারের তমাল/অনেক পাতার ঘনিষ্ঠতায়/একটি প্রগাঢ় নিকুঞ্জ/ সন্ধ্যার উন্মেষের মতো/সরোবরে অতলের মতো/কালোকেশ মেঘের সঞ্চয়ের মতো/ বিমুগ্ধ বেদনার শান্তি/আমার পূর্ববাংলা বর্ষার অন্ধকারে/অনুরাগ হৃদয়/ছুঁয়ে যাওয়া/সিক্ত নীলাম্বরী...।’

আমাদের সবার প্রিয় বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক, সম্পাদক, অনুবাদক ও জাতীয় অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসান ১৯২২ সালের ২৬ মার্চ মাগুরা জেলার আলোকদিয়া গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ঢাকা শহরের আরমানিটোলা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এন্ট্রান্স এবং ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজ (বর্তমানে ঢাকা কলেজ) থেকে এফএ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে ১৯৪৩ খ্রিষ্টাব্দে স্নাতক এবং ১৯৪৪ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর তিনি কলকাতা চলে যান এবং সেখানেই বিয়ে করেন। অতঃপর যথাক্রমে অল ইন্ডিয়া রেডিও কলকাতা কেন্দ্রে এবং রেডিও পাকিস্তান ঢাকা কেন্দ্রে কর্মসূচি নিয়ামক হিসেবে চাকরি করেছেন। তিনি ১৯৪৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে প্রভাষক এবং ১৯৫৩ সালে সৈয়দ আলী আহসান করাচি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রধান নিযুক্ত হন। ১৯৬০ থেকে ১৯৬৭ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত বাংলা একাডেমির পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এরপর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের চেয়ারম্যান এবং ১৯৭২ সাল থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দের ২৭ সেপ্টেম্বর থেকে ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এ ছাড়াও তিনি ১৯৭৭-৭৮ সালে বাংলাদেশ সরকারের শিক্ষা, সংস্কৃতি, ক্রীড়া ও ধর্ম সম্পর্কিত মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টা, সুইডেনের নোবেল কমিটির সাহিত্য শাখার উপদেষ্টা এবং জাতীয় অধ্যাপক ছিলেন। বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হিসেবেও তিনি শিক্ষিত মহলে সমধিক পরিচিত। এখানেই শেষ নয়, ১৯৭১ সালে সৈয়দ আলী আহসান বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তিনি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শব্দসৈনিক হিসেবে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন। এ সময় তিনি ‘চেনাকণ্ঠ’ ছদ্মনামে বিশেষ পরিচিত ছিলেন। বর্ণিল কর্মজীবন শেষে কবি ২০০২ সালের ২৫ জুলাই তিনি ঢাকায় ইন্তেকাল করেন। তাকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদসংলগ্ন কবরস্থানে সমাহিত করা হয়। আমরা তার রূহের মাগফিরাত কামনা করি।
প্রিয় কবির বর্ণাঢ্য কর্মজীবন পর্যালোচনা করলে সহজেই তার সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভ করা যায়। এসব কিছুর বাইরে তিনি সম্পাদনার দায়িত্ব এবং নিজের লেখালেখির কাজও অত্যন্ত সফলভাবে পালন করেছেন। যা থেকে সহজেই অনুমেয় যে তিনি অসাধারণ চিত্ত এবং বিত্তের অধিকারী একজন প্রকৃত মানুষ ছিলেন। এত বড় বড় পদের অধিকারী হয়েও তিনি ছিলেন একজন নিরহঙ্কার এবং সাদা মনের মানুষ।
কবিতা সম্বন্ধে সৈয়দ আলী আহসানের ধ্যানধারণা সমকালীন অন্য কবিদের চিন্তাভাবনার সাথে তেমন একটা মেলবন্ধন লক্ষ করা যায়নি। যদিও তার রচনায় রয়েছে ঐতিহ্য-চেতনা, সৌন্দর্যবোধ এবং স্বদেশপ্রীতি, যা অন্য কবিদের লেখাতেও বর্তমান। কবির অসংখ্য গ্রন্থের মধ্যে ‘একক সন্ধ্যায় বসন্ত’কে তার সেরা সঙ্কলন হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ‘একক সন্ধ্যায় বসন্ত’ কাব্যগ্রন্থে প্রধানত গদ্য-কবিতা স্থান পেয়েছে, সেই গদ্য-কবিতা রবীন্দ্রনাথ ও ত্রিশের কবিদের গদ্য-কবিতা থেকে পৃথক। কেননা তার কবিতায় উপমা ও শব্দ ব্যবহারে রয়েছে নতুনত্ব ও আধুনিকতা। উপমা ব্যবহারে জীবনানন্দ দাশের সাথে তার পার্থক্য বেশ চোখে পড়ার মতো। জীবনানন্দে আছে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য উপমা; কিন্তু সৈয়দ আলী আহসান প্রধানত ব্যবহার করেছেন বিমূর্ত উপমা। তার উপমার কারুকাজ, স্থাপনা কৌশল নিঃসন্দেহে সচেতন পাঠককে মুগ্ধ করবে। তার ‘একক সন্ধ্যায় বসন্ত’ কাব্য সঙ্কলনের শ্রেষ্ঠ কবিতা ‘প্রার্থনা’ ও ‘আমার পূর্ববাংলা’ কবিতা দু’টি। তার কবি প্রতিভার উদাহরণ পাওয়া যায় নিম্নোক্ত চরণগুলোতে- ‘এভাবেই আমার দিন রাত্রির অধীরতা/অনেক বনের মধ্য দিয়ে/অনেক নদী সমুদ্রের স্বচ্ছতায়/একদিন হয়তো পাহাড়ের দুর্গমতায়/পাথরের নিশ্চেতন সংকট পার হয়ে/ইউলিসিস ইথাকায় ফিরবে’।/ (প্রার্থনা, একক সন্ধ্যায় বসন্ত)
এবার সৈয়দ আলী আহসানের সাহিত্যকর্ম থেকে কিছুটা আলোকপাত করা যাক।
তার প্রকাশিত গ্রন্থের তালিকা নিচে প্রদান করা হলো- কাব্যগ্রন্থ : অনেক আকাশ ১৯৬০, একক সন্ধ্যায় বসন্ত ১৯৬২, সহসা সচকিত ১৯৬৮, উচ্চারণ ১৯৬৮, আমার প্রতিদিনের শব্দ ১৯৭৩, প্রেম যেখানে সর্বস্ব।

সম্পাদিত প্রবন্ধ গ্রন্থ : বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত আধুনিক যুগ মুহম্মদ আবদুল হাইয়ের সাথে ১৯৫৬, কবিতার কথা ১৯৫৭, কবিতার কথা ও অন্যান্য বিবেচনা ১৯৬৮, আধুনিক বাংলা কবিতা : শব্দের অনুষঙ্গে ১৯৭০, রবীন্দ্রনাথ : কাব্য বিচারের ভূমিকা ১৯৭৩, মধুসূদন : কবিকৃতি ও কাব্যাদর্শ ১৯৭৬ আধুনিক জার্মান সাহিত্য ১৯৭৬, যখন কলকাতায় ছিলাম, আহমদ পাবলিশিং হাউজ, ২০০৪ বাংলা সাহিত্যে ইতিহাস মধ্যযুগ শিল্পবোধ ও শিল্পচৈতন্য, জীবনের শিলান্যাস
সম্পাদিত গ্রন্থ : পদ্মাবতী ১৯৬৮, মধুমালতী ১৯৭১
অনূদিত গ্রন্থ : ইকবালের কবিতা ১৯৫২, প্রেমের কবিতা ১৯৬০, ইতিহাস ১৯৬৮, রাজা ইডিপাস
ইসলামী গ্রন্থ : মহানবী, আল্লাহ আমার প্রভু।
অন্যান্য গ্রন্থ : যখন সময় এলো, রক্তাক্ত বাংলা, পাণ্ডুলিপি, বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা, রজনীগন্ধা, চর্যাগীতিকা
আমাদের আত্মপরিচয় এবং বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ, ১৯৭৫ সাল, বাংলাদেশের সংস্কৃতি।
উল্লেখ করার মতো একটি ঘটনা এই যে, সেনেগালের সাবেক প্রেসিডেন্ট, ফরাসি ভাষার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি লিউপোল্ড সেডর সেংঘর ছিলেন কবি সৈয়দ আলী আহসানের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। সৈয়দ আলী আহসানকে নিয়ে লেখা তার কবিতায় তিনি বলেছিলেন : ‘তুমি এলে/তোমার চোখ আমার চোখের/সামনে দিয়ে চলে গেল,/ তোমার চোখ ঈষদুষ্ণ বারির স্পর্শে/চুম্বকের স্বাদ পেল।’
সেংঘরের এই পঙক্তি যে যথার্থ, তার প্রমাণ আমরা পাই কবি অন্নদাশংকর রায়ের লেখায়।
সৈয়দ আলী আহসান সম্পর্কে বলেছেন, ‘তিনি একজন সত্যিকার কবি। যেমন হৃদয়বান, তেমনি রূপদর্শী। যে ভাষায় তিনি লেখেন, তা খাঁটি বাংলা। তার কবি পরিচয়ই শ্রেষ্ঠ পরিচয়।’ আধুনিক উর্দু সাহিত্যের প্রখ্যাত কবি কলিম সাসারামী সৈয়দ আলী আহসানের ষাটতম জন্মদিনে তাকে শ্রদ্ধা জানিয়েছিলেন এই বলে : ‘যখন বিধাতা সাহিত্যের জন্য একটি উজ্জ্বল কেন্দ্রবিন্দুর কথা ভাবলেন, সৈয়দ আলী আহসান সাহিত্যের দিগন্তে আবির্ভূত হলেন কিরণসঞ্চারি সূর্যের মতো। এবং তখন কাব্যলোক আনন্দের সারৎসার এবং উচ্ছ্বলতা-উৎফুল্লে নৃত্যরত হলো। স্বর্গ থেকে ধরিত্রী পর্যন্ত উপাদান সঙ্গীতে সমৃদ্ধ হলো।’
এমনি করে অনেক বিখ্যাত কবি-সাহিত্যিকবরেণ্য ব্যক্তি সৈয়দ আলী আহসানের স্তুতি গেয়েছেন। আমি গভীরভাবে বিশ্বাস করি, একজন কবি হিসেবে, একজন লেখক হিসেবে একজন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ হিসেবে সর্বোপরি একজন সত্যিকারের মানুষ হিসেবে সৈয়দ আলী আহসান অতুলনীয় এবং সর্বজন শ্রদ্ধেয়। তিনি একজন অনুসরণীয় এবং অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব। তার জীবন চরিত এবং লেখা নিয়ে আরো গবেষণা হওয়া উচিত বলে আমি মনে করি।


আরো সংবাদ



premium cement
সোনারগাঁওয়ে বৃষ্টির জন্য ইসতিসকার নামাজ আদায় নেপালের পানিবিদ্যুৎ কিনছে ভারত, বাংলাদেশের অগ্রগতি কতটুকু? ‘নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত অমান্য করলে বিএনপি থেকে চিরতরে বহিষ্কার’ ইউক্রেনের জন্য ৬ বিলিয়ন ডলারের প্যাকেজ ঘোষণা যুক্তরাষ্ট্রের বগুড়ার শেরপুর প্রেসক্লাবের পুন: সভাপতি নিমাই-সম্পাদক মান্নান হিট স্ট্রোকে পাইকগাছার ইটভাটা শ্রমিকের মৃত্যু মুন্সীগঞ্জে অটোরিকশার ধাক্কায় শিশু নিহত বিচারকের আসনে জয় চৌধুরী হামাস ও ফিলিস্তিনি গ্রুপগুলোর মধ্যে ঐক্য আলোচনার আয়োজন করছে চীন গফরগাঁওয়ে রাজিব হত্যা মামলার আসামি গ্রেফতার ও বিচার দাবি লক্ষ্মীপুর জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক ইমতিয়াজ আটক

সকল