২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`


কারিগর

-


আমি অত্যন্ত নিবিষ্ট মনে তার কাজ দেখছিলাম। সাধারণ একটি কাজ। কিন্তু কি অসাধারণভাবেই না লোকটি সেটি করছে। কাজের আয়োজন, যন্ত্রপাতি- সব কিছু ছিমছাম। সব কিছুই গোছগাছ, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও অত্যন্ত পরিপাটি। আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো তার কাজ দেখছিলাম।
আসলে মন্ত্রমুগ্ধ হওয়ারই কথা। কয়জন মানুষ এভাবে সুন্দর করে কাজ করতে পারে। কাজকে ভালো না বাসলে এভাবে কাজ করা যায় না।
একজন নায়কের মতো তার সুন্দর চেহারা। সুস্বাস্থ্যের অধিকারী লোকটি। পরনে লুঙ্গি, গায়ে গেঞ্জি। শুদ্ধ ও সুন্দর করে প্রমিত বাংলায় কথা বলে। একটি নিউমার্কেটের গেটে বসে সে কাজ করে। সে জুতার কারিগর।

সে জুতা সেলাই করে, জুতা কালি করে। আমিও তাকে আমার জুতা জোড়া কালি করতে দিয়েছি। তার বসার জন্য ছোট্ট একটি মাদুর। আমার জুতা কালি করার সময় প্রথমেই সে জুতাটি পরিষ্কার করল। জুতা পরিষ্কার করার সময় ফ্লোরে যে ধুলাবালি পড়ল তা একটি হাতব্রাশ দিয়ে সরিয়ে ফেলল। ব্রাশটি যেখান থেকে নিয়েছিল, সেখানে রাখল। তার কাজের সব উপকরণ, উপাদান সব কিছু সুন্দর করে সাজানো। তারপর তরল কালির শিশিটি থেকে একটি টুথব্রাশ দিয়ে কালি নিয়ে জুতায় সুন্দর করে লাগিয়ে দিলো। যেখানকার কালির শিশি সেখানে রাখল। ব্রাশটি রাখল ব্রাশের জায়গায়।

তারপর এক টুকরা কাপড় নিয়ে জুতা মুছল। মুছার ফলে তরল কালি সমভাবে জুতার সব জায়গায় লেগে গেল। যেখানে বেশি কালি ছিল সেটি কাপড়ের টুকরায় চুষে নিলো। এরপর কাপড়ের টুকরাটি সুন্দরমতো ভাঁজ করে জায়গামতো রাখল। পাঁচ-ছয়টি জুতার ব্রাশের মধ্য থেকে একটি ব্রাশ নিয়ে সে জুতার উপর আলতোভাবে ব্রাশ করল। এবার জুতাটি পাশে রেখে সে জুতার রঙের সাথে মিলিয়ে কালি তৈরি করতে লাগল। ব্যাপারটি সাধারণ, কিন্তু সে সেটি করছিল অসাধারণ মনোযোগসহকারে। জুতার রঙের সাথে ম্যাচ করে, এমন কিছু পাউডার একটি বড় কালির কৌটার উল্টা পাশে রাখল। তারপর ক্রিম মিশিয়ে কালি প্রস্তুত করতে লাগল। কালি প্রস্তুতের যে প্রক্রিয়া তাতেও একটি ছন্দ আছে। আমার বেশ ভালো লাগছিল দেখতে। বসার জায়গা নেই, তাই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমি এসব দেখছিলাম।

জুতার কারিগরের পাশেই কেউ একজন ছবি বিক্রি করে। নিউমার্কেটের গেটের দক্ষিণ দিকের দেয়ালজুড়ে বেশ সুন্দর সুন্দর ছবি টাঙানো আছে। ছবির এই দোকানটি গেটের সৌন্দর্য বড়িয়ে দিয়েছে। ছবিতে ফুল-ফল, পাখ-পাখালি যেমন আছে, তেমনি বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যও ফুটে উঠেছে। সেখানে ঐতিহাসিক স্থানের ছবি যেমন আছে, তেমনই ধর্মীয় ছবিও আছে।
এর মধ্যে একজন ক্রেতা এসে জিজ্ঞাসা করল। ছবির দাম কত? আমার ধ্যান ভঙ্গ হলো। আমি সেদিকে তাকালাম। ছবির দোকানে কোনো বিক্রেতা দেখলাম না। সে হয়তো জরুরি কাজে পাশেই কোথাও গেছে। হ্যাংলা পাতলা একজন খরিদ্দার। সাথে তিনটি অল্প বয়স্ক ছেলেমেয়ে। সে কাকে দাম জিজ্ঞাসা করল বুঝতে পারলাম না। জুতার কারিগর উত্তর দিলো, ‘নিচের সারির ছবির দাম ৮০ টাকা, আর উপরের সারির ছবির দাম ১০০ টাকা’।

তার এই জবাবে লোকটি দানবের মতো ফুঁসে উঠল। রাগে তার ঘাড় শক্ত এবং বাঁকা হয়ে গেল। সে চিৎকার করে বলে উঠল, ‘এবার ছবির মান সম্মান গেল রে, গেল। সব গেল। কলির কাল। সব গেল।’ লোকটি ছবির দিকে তাকিয়ে চিৎকার করছিল। তাই আমি বুঝতে পারছিলাম না, সে কাকে এই কথাগুলো বলছে।
আমি না বুঝলেও যার বুঝার সে কিন্তু ঠিকই বুঝেছে। জুতার কারিগর তার কাজ বন্ধ করে দিয়েছে। সে স্থির এবং হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে লোকটির দিকে। তার মুখে যে বেদনা এবং অসহায়ত্ব ফুটে উঠেছে, তা ধারণ করার ক্ষমতা ভাষার নেই। আমি ১০ ফুট দূরে দাঁড়িয়ে শুধু দেখলাম, ছবিগুলোর মান-সম্মান গেল না। মান-সম্মান গেল সেই ঘাড় বাঁকা করা এবং চিৎকার করা লোকটির। আর তার লালিত পতনমুখী মানবতাবিরোধী মূল্যবোধের।
দুঃখ হয় : কাজ ও কাজের মানুষরা মর্যাদা পায় না। সে তো লুটপাট করছে না। চুরি করছে না। মাদকের ব্যবসায় করছে না। ক্যাসিনো বানিয়ে জুয়া খেলছে না। সে তার কাজ করেছে। যে তার কাজকে প্রার্থনার মতো ভালোবেসে।
তাই বলি। শত সহস্রবার বলি। ভাই, তুমি মানুষ। তোমার জয় হোক!

 

 

 

 

 


আরো সংবাদ



premium cement