২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

একটি উপাখ্যান

অনুবাদ : সায়ীদ আবুবকর
মাইকেল মধুসূদন দত্ত। জন্ম : ২৫ জানুয়ারি ১৮২৪ ॥ মৃত্যু : ২৯ জুন ১৮৭৩ -

কোনো এক কালে কতিপয় যৌবনবতী বালা, যাহারা প্রাচ্যের একটি মনোহর গ্রামে বসবাস করিত, গৃহকর্মে ব্যবহার করিবার নিমিত্ত পার্শ্ববর্তী কূপ হইতে জল আনিতে যাইতেছিল। পথিমধ্যে তাহারা দেখিতে পাইল একজন দরবেশ এক চাঁই মৃত্তিকা বালিশের ন্যায় মস্তকের নিচে রাখিয়া একটি বৃক্ষের ছায়ায় আরামের সহিত ঘুমাইয়া আছে । এতদ্দর্শনে প্রাচ্যের এইসকল সুন্দরীর একজন কহিয়া উঠিল, ‘দেখ, লোকটাকে দেখ। সে একজন দরবেশ; সে চায় লোকেরা বিশ্বাস করুক সে পার্থিব জীবনের সমুদয় চাকচিক্য, ভণ্ডামি ও বিলাসিতা পরিত্যাগ করেছে; অথচ এখনো সে বালিশ ছাড়া ঘুমাতে পারে না। কি হতচ্ছাড়া!’ এইরূপে তাহার মনোভাব ব্যক্ত করিয়া সুন্দরীটি তাহার সখীদের সহিত হাসিতে হাসিতে চলিয়া গেল। কিন্তু দরবেশ শুইয়া শুইয়া এই তিক্ত ভর্ৎসনাবাণী শ্রবণ করিল এবং তাহার বিবেক তাহাকে শাঁখের করাতের ন্যায় উভয় দিক হইতে কাটিতে লাগিল। সে মস্তকের নিচ হইতে অবমাননাকর মৃত্তিকার চাঁইটি বাহির করিয়া ছুড়িয়া মারিল এবং টান টান হইয়া এইবার শুইয়া পড়িল, ঘুমানোর প্রশ্নই ওঠে না, শুইয়া শুইয়া সে সেই সুন্দরী বালার জন্য অপেক্ষা করিতে লাগিল, বস্তুত তাহার মুখনিঃসৃত অনুমোদনবাণী ও প্রশংসা-অমৃত পান করিবার উদ্দেশ্যে।

অদৃষ্ট ভালো যে, তাহাকে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করিতে হইলো না কারণ আমাদের সেই রাখালিরা কলসিগুলি জলে পূর্ণ করিয়া তাহাদের মাথার উপর চাপাইয়া হাস্যমুখে অতি দ্রুতই ফিরিয়া আসিল। দরবেশ তাহার কান পাতিয়া রাখিয়াছিল। সে একটি গীতল কণ্ঠ বাজিয়া উঠিতে শুনিল, ‘দেখ, সেই লোকটাকে দেখ। সে একজন দরবেশ; সে চায় যে, লোকেরা বিশ্বাস করুক সে পার্থিব সমুদয় মতামতের ঊর্ধ্বে; অথচ একটি সামান্য বালিকার মন্তব্যই কিভাবে তার মনের স্থিরতাকে উলট-পালট করে দিয়েছে। কি হতচ্ছাড়া!’
এই উপাখ্যানটি আমাদিগকে স্মরণ করাইয়া দেয় এই নগরের কতিপয় পূজনীয় ফুলবাবুর কথা- যদিও তাহাদিগকে দেখিয়া মনে হয় সীমাহীন ঔদ্ধত্য ও উন্নাসিকতার বৈভবে তাহারা আশীর্বাদপুষ্ট; তথাপি জনগণের মতামতকে তাহারা অতিশয় ভয় পাইয়া থাকেন, শিশুরা যেমন অন্ধকারকে ভয় পায়। তাহারা দৃঢ়চিত্ত নহেন। যদি তাহারা মনে করেন কেবল বাহাদুরি দেখাইবার জন্য তাহারা রাষ্ট্রের কল্যাণকর কার্য করিয়া থাকেন, তাহলে তাহাদিগকে তাহা করিতে দিন। কিন্তু কেন তাহারা সর্বাগ্রে বাহাদুরি করিয়া বেড়াইবেন এবং তারপর দ্বারে দ্বারে ঘুরিয়া বেড়াইবেন সম্পাদকের নিকট এই আর্জি জানাইয়া যে, যেন তাহার পক্ষে আমরা লিখি এবং সম্পাদক জনগণের ঘৃণামিশ্রিত ক্রোধ প্রশমিত করিয়া দেয় তাহার বাগ্মিতা ও যুক্তির পরাকাষ্ঠার নিকট আত্মসমর্পণ করিয়া? কেনই বা এইভাবে বালিশের ন্যায় মৃত্তিকার চাঁই ব্যবহার করা এবং তারপর ইহাকে ছুড়িয়া ফেলা, যেহেতু কেহ একজন কহিয়াছে ইহা শোভনীয় নহে?
দৃঢ়তা মর্যাদা দান করে। যদি বালিশ সত্য সত্যই আপনার প্রয়োজন হইয়া থাকে, তাহলে যেভাবেই হউক, মস্তকের নিচে মৃত্তিকার চাঁই রাখিয়া দিন, ছুড়িয়া মারিবেন না পান্থজনে তাহা দর্শন করিরা যাহাই মন্তব্য করুক না কেন। আর যদি বালিশ আপনার আবশ্যক না হয়, মস্তকের নিচে মৃত্তিকার চাঁই না-রাখিয়াই ঘুমান। যদি ঔদ্ধত্য ও বাহাদুরিপনা আপনার আসনকে অলংকৃত করে তাহলে আমাদিগকে তাহা অবিচ্ছন্নভাবে গ্রহণ করিতে দিন; সর্বাগ্রে আমাদিগকে তাহা দিবেন না এবং তারপর নিজেরই হঠকারিতায় নিজেই ভয় পাইয়া যাইবেন না। আর যদি তাহারা আপনার আসনকে অলংকৃত না করিয়া থাকে তাহলে আমাদিগকে আপনার ভদ্রোচিত মনোযোগ ও সংবেদনশীল মহানুভবতা অর্জন করিতে দিন।
যেকোনো ক্ষেত্রে দৃঢ়চিত্ত হউন; হয় উদ্ধতভাবে মহৎ হউন, নয় তো বিনয়ের সহিত মহৎ হউন। যে-ব্যক্তি আগুন জ্বালাইয়া পা চাপা দিয়া তাহা নিভাইতে চাহে কারণ তাহা ভয়ঙ্করভাবে জ্বলিয়া উঠিয়াছে, কিছুতেই তিনি সম্মানের সহিত গৃহীত হইতে পারেন না।


আরো সংবাদ



premium cement