২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

হাইকু আধুনিক কালে

হাইকু আধুনিক কালে -

হাইকু অতি সাধারণ একটা কাব্য সাহিত্য বা অনু কবিতা! বর্তমান যুগে তা বিশ্ব সমাদৃত। এ কবিতাকে পৃথিবীর ক্ষুদ্রতম কবিতা হিসেবে বিবেচনা বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে! বিশ্বের বিভিন্ন দেশে হাইকু চর্চা হলেও এর-মূল উৎপত্তি স্থান জাপান।
অন্য সব কবিতার থেকে একটু ভিন্ন আঙ্গিক এ-কবিতায় বেশ কিছু উপলব্ধি করা যায়।
দর্শনের কলা গভীরে ডুব দিয়ে সাঁতরিয়ে তুলে-আনা বৈচিত্র্যের প্রস্ফুটিত রূপ, সুনির্দিষ্ট নিয়মের ধারাবাহিক বজায় রেখে মনের বহিঃপ্রকাশ করার নামই হলো হাইকু।
এ কাব্যের মধ্যে যে একটা আর্ট অনুশাসনে নির্ভর করে সেটা পর্যবেক্ষণ করতে পারলেই অনুধাবন করা সম্ভব ।
পৃথিবীর সব কিছুর একটা গতি বিধায়ক অনুসারে অনুকরণ হয়ে আসছে, যেটা আমরা অস্বীকার করতে পারি না!
তাই বলে তো আর অনুশাসনে সীমাবব্ধ নয়।
অনুশাসনের মধ্য থেকেও বিস্তর প্রভাব প্রকাশ করা খুবই সহজ এবং তা সম্ভব! তেমন ধারণা হাইকুর মধ্যে হাইকু বিশেষজ্ঞদের চিন্তা-চেতনায় বিদ্যমান।
মেরে ফেলার উদ্দেশ্যে কাউকে আঘাত করতে হলে উপযুক্ত স্থানে একটা ঘুষিই যথেষ্ট! সচেষ্টভাবে মারতে পারলেই তার প্রাণনাশ করা সম্ভব। ছোট্ট একটা পারমাণু বোমা একটা দেশ একটা জাতিকে যদি ধ্বংস করতে সক্ষম হয়! তাহলে প্রকৃত একটা হাইকু লিখতে পারলেই, হাইকু কবি হিসেবে সুখ্যাতি অর্জন করা খুবই সহজ সাফল্যের বিষয়! হাইকু বিশেষজ্ঞদের একান্ত এবং সুনিশ্চিত অভিমত।
মাৎসুঅ বাসো প্রকৃতি নিয়ে তার চৈতন্যময় দর্শনে তিনি ঠিকই উপলব্ধি করেছিলেন! আধুনিকতা ও কৃত্রিমতার কাছে প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য যাতে হুমকির সম্মুুখীন না হয়ে পড়ে, সে জন্য প্রাকৃতিককে সাহিত্য শিল্পের মাধ্যমে ফুটিয়ে প্রকৃতিস্থ মনোভাব মানুষের মাঝে সর্বস্তরে অনুপ্রেরণা সৃষ্টি করা তার অন্যতম কারণ ও উপর্যুপরি বলে মনে করেন।
এমনি অনুশাসনের মধ্যেও বাংলা সাহিত্য সাবলীলভাবে চর্চা হয়ে আসছে যুগ যুগ ধরে!
যেমন কাব্যের ক্ষেত্রে সনেট, রুবাই, লিমেরিক, ছড়া, গীতিকাব্য ইত্যাদি! গানের ক্ষেত্রে পল্লিগীতি, ভাটিয়ালি, রাগ, উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত, আধুনিক ইত্যাদি প্রত্যেকটার পৃথক পৃথক ছন্দ শব্দের গাঁথুনি রূপ, সুরের বৈচিত্র্য উপস্থাপন ভিন্ন ভিন্নভাবে প্রকাশের বিধানে চলমান।
হাইকুর ক্ষেত্রেও তারও একটা সুনির্দিষ্ট গতিধারা বিধায়ক বটে।
হাইকুর উৎপত্তি স্থান জাপান এবং তাদের কবি, সাহিতিক ইতিহাসবিদরা বিশ্ব সমাদৃত করার জন্য সহজ সরল পথ দেখিয়েছেন। রেঙ্গা, তানকা, ওয়াকা, হক্কু দীর্ঘদিনের প্রচেষ্টায় সাহিত্য চর্চার পণ্ডিতদের নিয়ে আলোচনা পর্যলোচনায় সর্বশেষ সিদ্ধান্তে উপনীত একটা সুনির্দিষ্ট ছক মাত্র তারা বহিঃপ্রকাশ করেছেন!
মাৎসুঅ বাসোর (১৬৪৪-১৬৯৪) হক্কু নামে ।
মাৎসুঅ বাসোর এই হক্কু নামকে আবার পরিবর্তন এনে মাসাওকা সিকি (১৮৬৭--১৯০২) হাইকু নামে, নাম হাইকু প্রচলন করেন।
এই হক্কুকে আবার ইনেনাগা সাবুরো বিখ্যাত ঐতিহাসিক ইতিহাসরচয়িতা তার হিস্ট্ররি অব জাপানিস কালচার গ্রন্থে ১৯৫৯ খ্রি: হাইকু লেখার নিয়মকে তিনি অল্প কিছু কথায় সহজ-সরলভাবে বুঝিয়েছেন।
হাইকুতে ১৭টি অক্ষরের সিলেবল থাকে ও তিন লাইনে বিভক্ত এবং ঋতু বৈচিত্র্যসমৃদ্ধ।
আমরা জানি যে, সিলেবল মানে জিহ্বার গতি না বদলিয়ে একবারে উচ্চারণ সক্ষম শব্দ বা শব্দাংশ, এক স্বর বিশিষ্ট শব্দ বা শব্দাংশ! যা বাংলা ভাষায় যুক্তাক্ষরের মধ্যে পড়ে না। বিশ্ব সমাদৃত করার লক্ষ্যে তিনি এ সিলেবলের প্রতি গুরুত্ব দিয়েছেন।
প্রকৃত নিয়ম মেনে হাইকু লিখতে হলে ৫/৭/৫ সিলেবল, তিন লাইনে সীমাবব্ধ, প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে ঋতু সম্পর্ক বজায় রেখে লেখার মান নির্ণয় করার নামই হলো হাইকু।
জাপান চার ঋতুর দেশ হয়েও যদি হাইকুতে ঋতুর ধারাবাহিকতা অব্যাহত রেখে হাইকু লিখতে পারে, তাহলে আমরা ছয় ঋতুর দেশ হয়ে আমরা কেন পারব না? নিশ্চয় পারব।
যেহেতু হাইকুতে অন্ত্যমিলের বা ছন্দ মিলের কথা বলা হয়নি আবার অন্ত্যমিল বা ছন্দ মিল রাখা যাবে না এমন কথাও মূল নীতিমালায় বলা হয়নি! তবে সিলেবলের কথা যেখানে একান্তভাবে বলা হয়েছে, সে ক্ষেত্রে অক্ষরবৃত্ত মাত্রা,স্বর বা শব্দাংশ মেনে লেখায় অতি শ্রেয়। এখানে উদাহরণস্বরূপ অন্ত্যমিল ও অন্ত্যমিল-ছাড়া হাইকু নিম্নে তুলে ধরা হলো!
কবি সৌমিত বসুর (পশ্চিমবঙ্গ ভারত) হাইকু
বিকেল হোক
সেই তোমার কোলে
রাখবো ঘুম।
কবি মৌ মধুবন্তির (বাংলাদেশ, প্রবাসী কানাডা) হাইকু
একলা চলো
শরৎ ধারা হলে
কুসুম তোল।
কবি শাহীন রেজার (বাংলাদেশ) হাইকু
আলোর চিল
আলেয়া হয়ে যাবে
ছুঁড়ো না ঢিল।
কবি ইমরুল ইউসুফের (বাংলাদেশ) হাইকু
কয়লা কালো
রাতে কালো ভ্রমর
মানায় ভালো।
আমার নিজের লেখা হাইকু
মেঠো ফড়িং
বেড়ায় ঘাস বনে
নাড়ায় শিং।
প্রকৃত নিয়ম কে সবল রেখে অগ্রসর হলে কখনো যাত্রা বিফল হবে না এবং বিতর্কের ঊর্ধ্বে থেকে এ চর্চায় সাফল্যদায়ক নিশ্চয়।
যেমন বলা চলে, মূল ধারার বাইরে এসে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে ভোটে জয় লাভ করা সম্ভব কিন্তু- রাজনীতিতে স্থায়ীভাবে টিকে থাকা একটা দুরূহ ব্যাপার বটে, এমনকি নেতৃত্ব ধরে রাখা অসম্ভব হয়ে পড়ে, যা মাঝ পথে হাবুডুবু খেয়ে ব্যর্থতার শিকার হতে হয়।
বাঙালি ও বাংলা ভাষাভাষী মানুষ সবসময় কর্ণ শ্রুতিমধুরতায় অভ্যস্ত সে কারণে শ্রুতিমধুর ধারাকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা বাংলায় হাইকু চর্চা দেখা যায় বেশি। এর-ই ধারাবাহিকতায় বাংলা ভাষায় অসংখ্য হাইকু লেখক হাইকু লিখে চলেছেন। এখানে হাইকুর মূল ধারার কোনো খর্ব হয় না।
মানুষের মুখে মুখে খুবই জনপ্রিয় অনেক খনার বচন আছে যা
সর্বত্র গ্রহণযোগ্য, যেমন...
অভদ্র বর্ষা কাল
হরিণি চাটে
বাঘের গাল.../৫=১৭ সিলেবল হলেও হাইকু বলে পরিচিতি ঘটেনি! তার মূল কারণ হলো
এখানে তিন লাইনে ৫/৭/৫ না হয়ে, হয়েছে ৭/৫/৫ যেটা হাইকুর মূল ধারার বাইরে।
আরো এমনি একটা লেখা...
আঙ্গুল ফুলে মোটা হয়
কলা গাছ হয় না...৭ =১৭
এখানেও ১৭ সিলেবল হলেও হাইকু বলে পরিচিতি ঘটেনি! এ-দুু’টো লেখাতে আমার মনে হয়, মূল ধারার বিশৃঙ্খলিত কারণে।
এই লেখা দু’টিতে ঋতু বৈচিত্র্যের ঘাটতি নেই, সিলেবলেও সঙ্গতিপূর্ণ! এখানেই বোঝা যায় লাইন ভাঙার নিয়মটা কেমন গুরুত্ব বহন করে এবং তা মূল ধারার ভূমিকা তাৎপর্য কতটা মূল্যে প্রবাহিত।
বিষয়টা এমনি হয়ে দাঁড়ায়!
যে রোগে ঘোড়া মরে, আসুন আমরা ঘোড়া না মেরে রোগ-জীবাণুকে মারি। মূল গঠনকে বজায় রেখে, সুচিন্তিত প্রতিভাকে বিকশিত করি! যার গ্রহণযোগ্য সর্বস্তরেই প্রাপ্তি। হাইকুর শর্তে শর্ত মেনে হাইকু চর্চা একান্তই শ্রেয়।
হাইকু রাজ্যের মহারাজ হাইকু কবি মাৎসুঅ বাসোর গবেশনা অতি সূক্ষ্ম
ছিল, তা আজ এ চর্চার কবিরা পুঙ্খানুপুঙ্খ রূপে অনুভবে ভাবানিত্ব, একান্ত নব্য সাহিত্য কৌশলের রূপরেখা চিত্রকে একটা ক্ষুদ্র কবিতা রূপ দেয়ার বিষয়টা অতিচমকপ্রদ করে তুলেছেন।
যা আধুনিক প্রজন্মে এসেও তাকে স্মরণ ও বরণে সাধুবাদ জানায় এবং এ চর্চার ধারাবাহিকতা অব্যাহত আছে ও বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসেও থাকবে। এই জনপ্রিয় হাইকু লেখার জন্য বৈচিত্র্যকে নিপাট স্বচৈতন্য ভাষায় যেকোনো প্রাকৃতিক চিত্র নদী-নালা খাল বিল ফুল ফল পশু পাখি কীটপতঙ্গ ইত্যাদি, প্রাকৃতির দর্শন ততখানিক কিভাবে উপলবব্ধি করা হয়েছিল তা তার উদাহরণে আমরা কেমন ফলবান হতে পারি বা আসা করতে পারি, এমনকি আগামী প্রজন্মকে কী ইঙ্গিত করলে জাতি সমাজ উপকৃত হবে ও জ্ঞান অর্জন করতে পারবে।
হাইকুতে অনেক কিছু উহ্য থাকে যা বুঝে নিতে হয়। এর অনেক সময় বাংলা ভাষায় পূর্ণ ব্যাকরণ সমৃদ্ধ নাও হতে পারে। শব্দের খেলার মধ্যে হাইকু লেখা যে গূঢ় রহস্য, সেই রহস্য যে উদ্ঘটন করতে পারবে, তার কাছে হাইকু লেখা খুবই সহজ সাফল্য হবে নিশ্চয়!
এর জন্য ব্যতিক্রম হাইকু সাধনায়, সাধক হতে পারলেই ভক্তের অভাব হবে না।
এ জন্য বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঠিকই অনুভব করেছিলেন, এ কবিতা গান গাওয়ার কবিতা নয়, এ কবিতা অনুভবের কবিতা। কবিগুরু তার ভাব দর্শায় বিচক্ষèতার কথা প্রকাশ করেছেন অকপটে। এ কারণে হাইকু কবিতা আলোচনা করা খুবিই কঠিন হয়ে দাঁড়ায়! পাঠক তার ইচ্ছা মতো অনুভবে ব্যাখ্যা করেন! তাই বলেতো আর হাইকু আলোচনা সাহিত্য যে-পিছিয়ে আছে এমনটা নয়! বরঞ্চ ইতোমধ্যে বাংলাসাহিত্যে বেশ লক্ষণীয় হয়েছে, হাইকু চর্চা ও তার ওপরে স্ন্দুরশৈলী গঠনমূলক সুদীর্ঘ আলোচনা।
এ কবিতায় ইদানীং কর্ণ শ্রুতিগত স্বর শব্দচয়ন হাইকুগুলো শিশুদের কাছে প্রিয় হয়ে উঠেছে, নতুনত্বের সুন্দর ছন্দ ও অন্ত্যমিল গঠন শব্দ স্বর শৈলীর কারণে।
এখন শুধুই অপেক্ষা মাত্র পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত স্থান দখল করে নিতে পারলেই ‘হাইকু সাহিত্য আন্দোলন’ সার্থক এবং সফল হবে! যেমনটিও হয়েছিল সনেটের ক্ষেত্রে।
এখন বিষয়টা হলো হাইকু লেখকদের হাইকুর মতো হাইকু লেখা চাই!
মোটা সুতোয় চিকন জাল বুনতে পারলেই কিস্তিমাত।
প্রকৃতপক্ষে যে তার জীবন দর্শায় একটি হাইকু লিখতে পেরেছে সে-হাইকু কবি, যে দু’টি হাইকু লিখেছেন সে হাইকুর কারিগর আর যে তিনটি হাইকু লিখেছেন সে হাইকুর সম্রাট!
মাৎসুঅ বাসো ও হাইকু বিশেষজ্ঞদের রাজকীয় এমন অভিমত প্রকাশ করে গেছেন।
অতএব এখানে বোঝা যায় একটা হাইকুর গুরুত্ব কতটা গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে! আর কেমন হাইকু রচনা করতে পারলে এমন উপাধি পাওয়া যাবে। হাইকুর উপকরণ দুধ ছেনে মাখম তোলা ও কবির দর্শনকে মনোনিবেশ আর একাগ্র সাধনার প্রতি ফলনই একজন হাইকু কবির মূল পরিচয় যা; দর্শন ধ্যানের ছবি, রচনায় প্রস্ফুটিত হাইকুর মূল লক্ষ্য। বিধায়-
তাক করো টিমটিমে
ধরে আনো ঘুঘু
এর-ই নাম হাইকু।
এই ক্ষুদ্র দর্শন-কাব্যের রূপ ব্যাখ্যা যেমন কয়েক সেকেন্ড স্বপ্নে সারা পৃথিবী প্রদক্ষিণ করার মতো। যা এই অনু কাব্যের চৈতন্য শক্তির প্রতিফলন; মাত্রা যত সূক্ষ্ম শক্তি তত তীব্র।


আরো সংবাদ



premium cement