২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

কী লিখছি কী পড়ছি

-

তালপাতা থেকে ল্যাপটপ । প্রায় সাতদশক জীবনের প্রথম চার পাঁচ বাদ দিলে তিন কুড়ি চার-পাঁচ বছর হবে লেখা পড়ার মধ্যেই তো আছি। রাসূলে খোদা সা: বলেছেন, ‘দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত শেখার সময়।’ লেখা এবং পড়ার সাথে সুসম্পর্কের কথা সীতানাথ বসাক তার আদর্শলিপিতে কিংবা ঈশ^র চন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয় তার বর্ণ পরিচয় প্রথম ভাগে না হলেও দ্বিতীয় ভাগে কমবেশি বলেছিলেন। এর মধ্যে কোনো এক মহারথি ছড়া কেটেছিলেন ‘লেখা পড়া করে যে গাড়ি ঘোড়া চড়ে সে’। হীরকের রাজা সবার মস্তিষ্ক প্রক্ষালনের জন্য শুনিয়েছিলেন ‘জানার কোনো শেষ নাই জানার চেষ্টা বৃথা তাই’। ফকির লালন মাঝখান থেকে দিলেন তাগিদ ‘সময় গেলে সাধন হবে না’। ‘শুভস্য শীঘ্রম’ এ রকম একটা মহাজন বাক্য যেমন আছে, ‘সবুরে মেওয়া ফলে’ এ কথাও আছে। পণ্ডিতেরা মগের মুল্লুকে কথা কম বলা বুদ্ধিমানের কাজ মনে করতেন সেই প্রাগতৈহাসিক কাল থেকেই। সুতরাং লেখাপড়া নিয়ে, এর আকার প্রকার ব্যাপ্তি ও বিষয় নিয়ে দোটানায় থাকা এবং অতৃপ্তি বোধের বাইরে আসা যাচ্ছে না।
লেখা পেশা না হলেও নেশা হিসেবে আছে সেই সত্তরের দশকের শুরু থেকেই। পত্রপত্রিকায় লেখা বের হওয়ার আনন্দ এখনো এতটাই টানে যে শেষ রাতে গাত্রোত্থানকালে প্রথমেই মনে পড়ে আজ কোথায় কোথায় লেখা বের হবে। হকারের জন্য অপেক্ষার দিন শেষ, ইদানীং করোনার ভয়ে নেই বললেই চলে। অনলাইনে চোখ রাখলেই পেয়ে যাই সৃষ্টির আনন্দ। সারা দিনে একটা দুটো লেখা না নামাতে পারলে, পত্রিকা কিংবা প্রকাশকের কাছে পাঠাতে না পারলে মনে হয় পেটের ভাত হজম হবে না। একটা বিশেষ সুবিধা, পত্রপত্রিকায় এখন লেখা হাতে লিখে ডাকে পাঠাতে হয় না, সেখানেও কম্পোজের কোনো কাজ নেই। এ সবে আগে কত সময় লাগত! লেখা পাঠিয়ে প্রকাশনার অপেক্ষা যেন শেষ হতে চাইত না। এখন দুপুরে ই-মেইলে লেখা পাঠালে সন্ধ্যা নাগাদ তা প্রিন্টিংয়ের জন্য পেস্ট হয়ে যায়। প্রকাশিত লেখা রাত ১২টার পর অনলাইনে পড়াও যায়। এ কারণে এখন সংসারে, দফতরে, সমাজে মনোযোগে বিচ্যুতি ঘটলেও কিছু না কিছু লেখা চাই প্রতিদিন। ফলে ফরমায়েসি লেখা শেষ করতে পারি না, সৃজনশীল লেখা স্পেস পায় অনেক কষ্টে। বকেয়া লেখার তালিকা বড় হতেই থাকে।
লেখার কত শত ভাব ভাবনা মাথায় আসে; কিন্তু ‘আমি যে দেখেছি কত যে স্বপ্ন মুকুলেই ঝরে যায়’। সারা দিন লেখার কত শত শিরোনাম পান তামাক খাওয়ার নাম করে মাথায় আসা-যাওয়া করে। আজকাল যা লিখতে চাইছি তা যেন সিলেবাসে নেই। যা লিখতে চাই তা সুকান্ত, সুনীল, নীলকণ্ঠ, মোহিতলাল, জসীমউদ্দীনরা লিখে গেছেন মনে হয়। পরিপাশর্^ পরিস্থিতি ঘটনা দুর্ঘটনা এসব লেখার শিরোনামের সরবরাহকারী, কার্যাদেশ না পেলেও ভাব কল্পনাদের তো ভ্যাট টাক্স দিতে হয় না। শিক্ষাজীবনে ছিলাম সাহিত্যের সাগরেদ, কিন্তু কর্মজীবনে এসে পারা না পারার রেষারেষিতে বেশ বিপাকে পড়তাম, পড়ি এখনো। শেক্সপিয়র প্রায় প্রশ্ন রাখেন, অনুযোগ তোলেন, ‘পড়লেন কি আর করলেন কি!’ ভরদুপুরে অর্থনীতির আটচালায় সাহিত্যের সাথে প্রেম মানায়? আবার সাহিত্যের হাত ধরতে গেলে অর্থনীতি বাঁকা চোখে তাকায়। গল্প লিখতে গেলে প্রবন্ধের ধাঁচ আঁচ এসে পড়ে, আবার প্রবন্ধের মধ্যে কাব্যলক্ষ্মীর বাকপ্রতিমা, সরস নিরস শব্দের সারথীরা কিলবিল করে। আজীবন আমলার কামলাগিরিতে ন্যায়নীতি রীতি-পদ্ধতি প্রক্রিয়ার সুর সাধতে গিয়ে এখন ইমনকে প্রায়ই পাশে পাই না। মেঘমল্লার মধ্যে ‘বৈশেখি মেঘের কাছে জল চাওয়া’র চল চলে আসে।
সমাজ ন্যায়নীতিনির্ভরতার পথ থেকে কেটে পড়তে চাইছে, সুশাসন নির্বাসনে, সুবচন লাপাত্তা, সৎচিন্তা, সৎ ধ্যান, বিদ্যা-বুদ্ধি প্রতিবন্ধিত্বের বলয়ে, স্বচ্ছতা-জবাবদিহিতা তেমন তাক লাগাতে পারছে না। শুদ্ধাচার সদাচার যাদের পৈতে হওয়ার কথা, তাদেরই এখন সদাচারের মন্ত্র পড়াতে হচ্ছে। রক্ষকরা ভক্ষকের ভূমিকায় ভালোই অভিনয় করে চলেছে। বাহবাও পাচ্ছে। এদিকে সমাজ সংসার সংস্কৃতি সব ভেঙে খানখান হয়ে যাচ্ছে। ‘সামাজিক দূরত্ব’-এর দোহাই দিয়ে দৈহিক দূরত্বের কাজ ভাগিয়ে নিয়ে সামাজিক মূল্যবোধকে শেষ করে দিচ্ছে। সামাজিক মাধ্যমের মধ্যস্ততায় ভালো-মন্দ সাদা কালো বৈধ-অবৈধকে বাপের নাম ভোলাতে ব্যস্ত। ভাষার মর্যাদা আদায়ে আত্মত্যাগকারী জাতি আকাশ সংস্কৃতির প্রতি আত্মঘাতী অতি উদারতা দেখাতে গিয়ে নিজস্ব স্বকীয়তা কৃষ্টি কালচারকে বিসর্জন দিতে, বিকৃত উচ্চারণে মাতৃভাষার মানসম্মান খোয়ানোর ফন্দি ফিকিরে। শিক্ষা শিক্ষার জায়গাতে নেই, প্রকৃতি বিমুখ হয়েই মানুষ প্রকৃতির প্রতিশোধ মোকাবেলা করছে, শোষণ বঞ্চনা ও বণ্ঠন বৈষম্যের বিরুদ্ধে সংগ্রামে বিজয়ী জাতির ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান তৈরিতে রোলমডেলের মওকা মিলছে। প্রতারক, প্রবঞ্চক শোষকরা আগে আসত সাত সমুদ্র তের নদী, মাঝে কিছু দিন হাজার মাইল দূর থেকে, আর এখন? তারা এখন তো আরো কাছে, একেবারে দোরগোড়ায় এমনকি ঘরের ভেতরও। তবে এসব বাতচিত যাতে কমে আসে তার জন্য সম্মোহনের আত্মহননের নীতি নিয়মের প্রয়োগ চর্চ্চা চলছে।
এসব জ্বালা, যন্ত্রণা, বঞ্চনার বেদনা নিয়ে দিন কাটে, এ সবের সমাধান প্রত্যাশায় থাকি, তবে প্রতিকার প্রার্থনার অবস্থাটা এখন ‘দুর্বল ঈমানের পরিচয়’র পর্যায়ে পৌঁছেছে। প্রতারণা, প্রবঞ্চনা, অন্যায়, অনিয়ম, দুর্নীতির কালো থাবা দিন দিন এমনভাবে বিকাশ ও বিস্তার লাভ করছে যে লেখায় শ্যাম রাখি না কুল রাখি অবস্থায় পড়তে হচ্ছে। লেখার মধ্যে, চিন্তাচেতনার মধ্যে, পক্ষ বিপক্ষ বিধিনিষেধের নিগড় মেনে চলতে গিয়ে লেখা শতবর্ষের নীরবতার সহযাত্রী হয়ে যাচ্ছে যেন। মশহুর মার্কিন দৈনিকের সাবটাইটেলে যখন দেখি ‘ডেমোক্রাসি ইজ ডায়িং ইন ডারকনেস’ তখন পুঁজিবাদী প্রজাতন্ত্র ধাঁচের লেখার ইচ্ছা ও সাহস জাগে। কিন্তু ওই পর্যন্তই। কখনো মনে হয় অমর্তলোক অধিবাসী প্লেটো সক্রেটিস অ্যারিস্টটলদের দিয়ে ‘গণতন্ত্রের লেবাস সেকাল ও একাল’ শিরোনামে একটা স্মারক বক্তৃতার আয়োজন করা যায় কিনা।
স্বাভাবিকভাবে লেখার মালমশলা আহরণেই পড়ার তাগিদ আসে।
ইদানীং তাই অর্থনীতি চর্চা, নিকট কিংবা সুদূর অতীতের চিন্তাভাবনাবিষয়ক বই পড়ার মধ্যে আছি। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র, প্লেটোর রিপাবলিক, ম্যাকিয়াভ্যালির প্রিন্স, ভারতবর্ষে ব্রিটিশ রাজের শেষ দিনগুলোয় এ দেশীয় আর্থসামাজিক ধর্ম ও রাজনীতি নিয়ে লেখা বই এ মন দিতে হচ্ছে। মাঝে করোনা এসে পড়াশোনার ধাঁচ ও ধারা ওলটপালট করে দিয়েছে। করোনা যে অর্থনীতির বারোটা বাজিয়ে ছেড়েছে তাকে পুনরুদ্ধারের পথ পন্থা সমস্যা সমাধান নিয়ে পাঠে মন দিতে হচ্ছে। কখনো সখনো করোনা প্রতিরোধ ও প্রতিষেধক, চিকিৎসা পদ্ধতি, এর আর্থসামাজিক অভিঘাতেও চোখ পড়ছে। ভাষাচার্য ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর সামাজিক চিন্তাভাবনার চৌহদ্দি তত্ত্বতালাসে গিয়ে বিশ্বভারতীর সাবেক উপাচার্য পণ্ডিত পবিত্র সরকার লক্ষ করেছিলেন গবেষণার সুউচ্চ চূড়ায় যার থাকার কথা, যেখান থেকে তার আরো অনেক কিছু দেয়ার ছিল তাকে সমাজের সব ছোটখাটো বিষয়ে ব্যাপৃত হতে গিয়ে, তাকে সম্মান ও সমীহের গজদন্ত মিনার থেকে নামতে হয়েছিল। আসলে সমকালীন বিশৃঙ্খল পরিবেশে চিন্তাচেতনার গজেন্দ্রগামিতায় সৃজনশীল সত্তাও যেন হয়ে পড়ছে করোনায় ক্লিষ্ট। তবুও শুভদিন, সময় ও চিন্তার রাজ্যে সুদিন সুবাতাস ফিরে আসুক এ প্রত্যাশা সবার, যাদের লেখা যারা পড়ে তাদেরও।


আরো সংবাদ



premium cement