২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

পয়লা বৈশাখের একাল সেকাল

-

‘এসো হে বৈশাখ, এসো, এসো’।
চৈত্রের শেষদিন গিয়ে যখন বৈশাখের প্রথম দিন আসে, সূর্য ওঠার আগে থেকেই বাজত এই গান। অন্যরকম এক অনুভূতিতে সকালের ঘুম ভাঙত। যখনকার কথা বলছি আজ থেকে প্রায় ২০ বছর আগের কথা হবে। এখনকার মতো এত তথ্যপ্রযুক্তি ছিল না। মাঝে মাঝে রেডিওতে গানগুলো শুনতাম। গ্রামের হঠাৎ দু-একটা বাড়িতে টেলিভিশন দেখা যেত। সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠেই পান্তা খাওয়ার ধুম পড়ত। অবশ্য এখনকার মতো লোকদেখানো গরম ভাতে পানি ঢেলে খাওয়া হতো না বা বৈশাখ উপলক্ষে একদিনের জন্য পান্তা খাওয়া হতো না। তখনকার সময়টাই এমন ছিল যে, মানুষ প্রায় প্রতি সকালেই পান্তা ভাত খেত।
পয়লা বৈশাখকে ঘিরে গ্রামে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হতো। লাঠিখেলা, ঘোড়দৌড়, ষাঁড়ের লড়াই, মোরগের লড়াই, বাউল গান, পালাগান, গ্রামীণ কিচ্ছা এবং বাহারি খাবারের আয়োজন করা হতো। গ্রামের আরেকটি ঐতিহ্যের বিষয় ছিল মেলা। গ্রামের কোনো নদীর তীরে বা বড় বটগাছের নিচে যেখানে বিস্তৃত জায়গা রয়েছে সেখানে বসত মেলা। দূর-দূরান্ত থেকে লোকজন আসত মেলায়।
পয়লা বৈশাখের সকাল থেকেই ঘরে ঘরে চলত রান্নাবান্নার আয়োজন। তবে সে আয়োজনটা থাকত প্রতিদিনের চেয়ে একটু আলাদা। বিশেষ কিছু রান্নার পাশাপাশি অবশ্যই পায়েস রান্না করা হতো। বৌ-ঝিরা সকাল থেকেই আনন্দের সাথে রান্নাবান্নায় অংশগ্রহণ করত। মেয়েরা বাবার বাড়িতে বেড়াতে আসত পয়লা বৈশাখ উপলক্ষে। জামাইরা আসত শ্বশুরবাড়িতে, এটা যে কত আনন্দের একটা উৎসব ছিল তা বলে বোঝানো কঠিন। এখনকার ছেলেমেয়েদের কাছে তা রূপকথার গল্পের মতো লাগে।
কয়েক দিন আগে থেকেই চলতে থাকত মেলার প্রস্তুতি। গ্রামের একটা নির্দিষ্ট জায়গায় বসত মেলা।
মেলায় পাওয়া যেত গৃহস্থালির নানান জিনিসপত্র। সেই সাথে থাকত, মুড়ি-মুড়কি আর খেলনা। ছোট ছেলেমেয়েদের আনন্দের কোনো সীমা থাকত না। তারা মেলা থেকে, বাঁশি, মাটির তৈরি পুতুল, পালকি, খেলার হাঁড়ি-পাতিল ইত্যাদি কিনত। মেলা থেকে জিনিস কেনার জন্য পূর্বে থেকেই তারা বাঁশের পালায় (ঘরের খুঁটিতে) গর্ত করে পয়সা জমাত। চার দিকে শিশুদের কোলাহলে মুখরিত হয়ে উঠত। মেলায় আরো থাকত নাগরদোলা, পুতুলনাচ, বানরের খেলা যা দেখে সবাই খুব আনন্দ পেত। শিশু থেকে শুরু করে বড়রাও এই আনন্দ ভাগ করে নিত কার্পণ্য করত না। সন্ধ্যার পর মেলায় শুরু হতো বাউল গানের আসর। সারা দিনের কাজ শেষ করে দলে দলে লোকজন গান শোনার জন্য মেলা প্রাঙ্গণে উপস্থিত হতো। গভীর রাত পর্যন্ত চলত মেলার কার্যক্রম সেই সাথে বাউল, জারি, সারি গান। ক্ষেত্রভেদে মেলার সময়কাল এক থেকে সাত দিন পর্যন্ত দীর্ঘায়িত হতো।
অন্য দিকে কোনো কোনো বাড়িতে আয়োজন করা হতো কিচ্ছা গানের। কয়েক বাড়ির মানুষ চাঁদা উঠিয়ে এই কিচ্ছার আয়োজন করত। গায়করা দুপুরের মধ্যেই চলে আসত এবং বিকেল থেকেই শুরু হতো গান। এসব গান শোনার জন্য আর গায়কদের ভঙিমা দেখার জন্য শত শত লোক ভিড় জমাত। গায়কের বয়ানে কখনও হেসে কুটি কুটি হতো কখনওবা চোখের পানিতে ভাসত। কিচ্ছা পালাগুলো এমনই ছিল যেখানে এক পরিবারের সবাই বসে উপভোগ করতে পারত। কোনো অশ্লীলতার ছোঁয়া ছিল না, বরং শিক্ষণীয় নানান বিষয় থাকত।
কেউ কেউ আয়োজন করত লাঠিখেলার। বাহারি পোশাক পড়ে বাদ্যের তালে তালে এই লাঠি খেলা প্রদর্শন করত খেলোয়াড়রা। নানান কলাকৌশলে পরিপূর্ণ লাঠি খেলা দেখে জনগণ তৃপ্তি লাভ করত। কোথাও কোথাও আয়োজন করা হতো ষাঁড়ের লড়াই। বেশ কয়েকদিন আগে থেকেই প্রচার করা হতো ষাঁড়ের লড়াই হবে। দলে দলে লোকজন ষাঁড়ের লড়াই দেখার জন্য যেত। জয়ী ষাঁড় মালিকের জন্য থাকত পুরস্কারের ব্যবস্থাও। এ ছাড়াও সারা গ্রামজুড়ে বিভিন্ন খণ্ড খণ্ড অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে উদযাপন করা হতো পয়লা বৈশাখ বা বাংলা নববর্ষকে। এ ছাড়া আরেকটি উল্লেখযোগ্য উৎসব ছিল হালখাতা। ক্রেতারা সারা বছর দোকান থেকে বাকিতে পণ্য ক্রয় করতেন। দোকানিরাও তাদের বাকিতে পণ্য দিতেন। তবে যখন হালখাতার আয়োজন করা হতো তখন সব টাকা পরিশোধ করে দিত। তবে সে হালখাতাটাও ব্যবসায়ীরা পয়লা বৈশাখ উপলক্ষে করতেন। ব্যবসায়ীরা পুরাতন খাতার হিসাব শেষ করে নতুন খাতা খুলতেন। ক্রেতারা এদিন তাদের বাকি খাতা গুছিয়ে নতুন হিসাবের খাতা খুলতেন। হালখাতা উপলক্ষে দোকানি ক্রেতাকে মিষ্টিমুখ করাতেন। হালখাতা উপলক্ষে লাল নীল কাগজের ঝালর কেটে দোকানকে সাজানো হতো দৃষ্টিনন্দন করে। এদিন ক্রেতা-বিক্রেতার সম্পর্কটা যেন আরো কাছাকাছি চলে আসত। কোনো কোনো এলাকায় হালখাতা উপলক্ষে আয়োজন করা হতো বাউল গানের। গভীর রাত পর্যন্ত গল্প গুজবের মধ্য দিয়ে এই হালখাতা শেষ হতো।
এমনি কত ধরনের অনুষ্ঠান যে ছিল পয়লা বৈশাখকে কেন্দ্র করে তা বলে শেষ করা যাবে না। যে আয়োজনগুলোর কথা বলেছি তার অনেকগুলো আমি দেখেছি, আবার অনেকগুলোর গল্প শুনেছি। আমাদের প্রজন্মের আগেই তা হারিয়ে গেছে। বর্তমান সময়ে এসে পহেলা বৈশাখ বিস্তৃতি পেয়েছে অনেক, কিন্তু অনেক আয়োজনগুলোর সাথেই পরিচিত নন আমাদের বর্তমান প্রজন্ম। কিছু আয়োজনের কথা ছোট্ট সোনামণিদের কাছে রূপকথার গল্পের মতো মনে হয়। আমার মা-বাবা, দাদা-দাদি যখন এমন অনেক কথা বলতেন আমার কাছেও তেমন গল্পের মতো মনে হতো। বর্তমান সময়ে আমাদের সোনামণিদের কাছেও তেমন মনে হয়। আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে এই পহেলা বৈশাখ বা বাংলা নববর্ষের ঐতিহ্যবাহী আয়োজনগুলোর সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়ার দায়িত্ব আমাদেরই। পরবর্তীতে যেন এই ঐতিহ্যকে তারাও লালন করতে পারেন। হv


আরো সংবাদ



premium cement