২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

দায়ভার

-

পানিতে ফুলের প্রতিচ্ছবি ভেসে উঠেছে। ঘন সবুজের ছায়ায় দীঘির পানিতে যেন একরাশ স্বচ্ছতা। শিশুপার্কের এক কোণায় ছোট্ট দীঘিটার পাড়ে প্রায় সময়ই দেখা যায় স্বপনকে। একটা কোমলতর আকর্ষণ এখানে টেনে নিয়ে আসে তাকে। অনেকগুলো কষ্ট আর তৃপ্তিকর কিছু সুখ মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় এই দীঘিটার আলো ছায়ায় এসে। পৌষের পাখিরাও কুয়াশায় সাঁতার কাটতে আসে এখানে। ফাগুনের অপেক্ষায় তারা সাজিয়ে রাখে গায়ের পালক। স্বপন এখানে বসেই কথা বলে প্রকৃতির সাথে, বাবার সাথে, মায়ের সাথে, দাদুর সাথে। পাখিরা তার গল্প শুনে আর দুই চোখ দিয়ে আনন্দাশ্রু ঝরায়। স্বপ্নের বাংলাকে সাজানোর প্রচেষ্টায় মুক্তিযোদ্ধা দাদুর শেষ বয়সের পরিণতি গাছের সাথে গল্প করে শোনায়। স্বপনের চোখ দুটো অনেক কিছুই দেখেছে, সয়েছে। আজ তার ২৫ বছর পূর্ণ হলো।
২০ বছর আগেকার ঘটনা। তখন সে এতিমখানায় বড় হচ্ছে। বড় হুজুরের কাছ থেকে শুনেছে তার বাবা-মা নাকি ভিক্ষা করত সিরাজগঞ্জ রেলস্টেশনের আশপাশে। একদিন প্রচণ্ড অসুস্থ হয়ে পড়ে স্বপন। ছেলের চিকিৎসার জন্য সামান্য কয়েকটি টাকা জোগাড় করাও ছিল কষ্টকর। দুই দিন পার হয়ে যায়। পথে পথে ঘুরে শেষমেশ ক্লান্ত হয়ে বাবা অরুচিকর একটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে বাধ্য হয়। ট্রেনের টিকিট কাটতে যাওয়া এক ভদ্রলোকের পকেট থেকে বিশ টাকা চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়ে। অপরাধের বিচারে এক হাত কেটে দেয়ার রায়ও কার্যকর হয়ে যায়। সম্মানের শেষটুকুন হারিয়ে একদিন মনোকষ্টে পরিবারকে ফেলে স্টেশন ছেড়ে চলে যায় দূরে কোথাও। শেষ অবধি তার ঠিকানা আর মেলেনি কখনো। স্বামীর বিয়োগে সন্তানকে নিয়ে মায়ের একাকিত্ব সময় আর অনাহারে কাটানো একেকটি দিন যেন অমাবস্যার রাতের মতো। প্রচণ্ড অসুস্থ হয়ে কোনো এক গভীর রাতে মা তার সন্তানের মাথায় হাত বুলিয়ে দোয়া করেছিল আল্লাহর কাছে, যেন আদরের টুকরাটি অনাহারে না মরে যায়, সত্যিকারের একজন বড় মনের মানুষ হয়ে বেঁচে থাকে। সেই রাতেই কষ্টের এই পৃথিবী ছেড়ে মা ডানা মেলে উড়াল দেয় দূর আকাশে। বসন্তের ফুলগুলোও সে দিন ঝরে পড়েছিল স্বপনের কান্নায়। স্টেশন মাস্টার দয়া দেখিয়ে শিশুটাকে নিয়ে যায় এতিমখানায় এবং সেখানেই একটা বন্দোবস্ত করে দিয়ে আসে। স্বপন বড় হতে থাকে সেখানেই।
প্রায় তিন বছর পর তার বয়স যখন ছয় তখন সে একটি হোটেলে কাজ পায়। ছোট দু’টি হাত দিয়ে রুটি বানানো থেকে শুরু করে থালা, বাটি, টেবিল, চেয়ার পরিষ্কার; হোটেল ঝাড়ু দেয়াসহ সব কাজই করত। একদিন কাজ শেষে শিশুপার্কের পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় এক বৃদ্ধ লোককে দীঘিরপাড়ে পড়ে থাকতে দেখে স্বপন। কাছে গিয়ে টেনে তুলতেই পানি পানি বলে গোঁঙাতে থাকেন বৃদ্ধটি। এক দৌড়ে সে পার্কের পেছনে একটা টিউবওয়েল থেকে এক বোতল পানি ভরে এনে বৃদ্ধটির মুখে দেয়। প্রাণ ফিরে পেয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে কাঁদতে শুরু করেন উনি। যেন এই নিষ্ঠুর পৃথিবীতে উনার মতো একা আর কেউ নেই। স্বপন প্রশ্ন করে, ‘আপনার কী হয়েছে দাদু? এভাবে কাঁদছেন কেন?’
দাদু শব্দটি শুনে বৃদ্ধের হৃদয় যেন প্রশান্তিতে ভরে গেল। চোখের জল মুছে স্বপনের এলোমেলো চুলে কিছুক্ষণ হাত বুলিয়ে দিলেন; তারপর বললেন, ‘এমনিই দাদুভাই। আমার বুকে কষ্টের যে ঝড় বইছে তা তুমি বুঝবে না। তোমার নাম কী?’
‘স্বপন’
‘বাহ্ কী সুন্দর নাম! কিন্তু তোমার গায়ে এত ময়লা লেগে আছে কেন?’
‘হোটেলে কাজ করে ফিরছি তো তাই। পুকুরে গিয়ে কয়েকটা ডুব দিলেই পরিষ্কার হয়ে যাবে।’
‘হোটেলে কেন কাজ করতে গেছিলে?’
‘হোটেলে কাজ না করলে টাকা পাবো কোথায়? টাকা ছাড়া কি বেঁচে থাকা যায়?’
‘সত্যিই তো। কাজ করেই তো উপার্জন করতে হয়। আচ্ছা তোমার বাসা কোথায়?’
‘এতিমখানায়। সজবরখিলা যেতে হাতের পাশে যে এতিমখানাটা পড়ে ওখানেই।’ এই উত্তরটি শোনার জন্য একদমই প্রস্তুত ছিলেন না বৃদ্ধ। মুহূর্তেই চোখের জল টলমল করে উঠল। এত ছোট্ট একটি ছেলে, এ কী বলছে!
‘তোমার কি মা-বাবা নেই?’
‘নেই তো। থাকলে কি আর আমাকে কাজ করতে দিতেন? অন্যদের মতো আমিও তো এখন স্কুলে যেতাম, গান শিখতাম, মজার মজার খাবার খেতাম। কিন্তু ওনারা আমাকে রেখেই মরে গেছেন। রাতের বেলায় মাকে ডেকে বলেছি সে দিন, আমাকেও যেন সাথে নিয়ে যায়। মা কিন্তু আমার সাথে প্রতিদিন স্বপ্নে এসে কথা বলে। যারা আমাকে বকা দেয়, মারে, ধমক দেয় তাদের সবার কথা ওনাকে বলে দিই। মা আমাকে খুব ভালোবাসেন দাদু।’
বাতাসে একরাশ নিস্তব্ধতা। চড়–ই পাখিটা তখন লাফাচ্ছিল এখানেই, শিশুটার কথা শুনে ডালে বসে নীরবে অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছে। প্রকৃতিটা জানে কার কষ্টটা অধিক। বৃদ্ধ একদিন আকাশের দিকে মুখ করে বলেছিল তার মতো কষ্টে আছে এমন মানুষ পৃথিবীতে একটিও নেই। সেই উনিই স্বপনের কপালে চুমু দিয়ে স্বীকার করতে বাধ্য হলো তার কষ্ট এই শিশুটির চেয়ে নেহায়েৎ সামান্য। বুকের কাছে টেনে নিয়ে স্বপনকে বলল, ‘তুমি কি আমার সাথে থাকবে দাদুভাই? আমিও তোমার মতো একা। তবে আমার একটা পঙ্গু ছেলে আছে, সারা দিন ঘরের ভেতরেই বন্দী থাকে। তুমি আর আমি সারা দিন গল্প করব, ঘুরব, ফিরব, মজার মজার খাবার খাবো।’
‘তোমার কাছে কেন থাকব? আমি তো এতিমখানায় থাকি। আর তোমার কাছে থাকলে হোটেলে কাজ করে দিবে কে?’
‘তোমার কোনো কাজ করতে হবে না। আমি তোমাকে সব সময় দেখে রাখব। তুমি না আমাকে দাদু বলে ডেকেছো? দাদু কখনো তার দাদুভাইকে দিয়ে কাজ করাতে পারে?’
বিকেলের অগোছালো পাখিগুলো সে দিন প্রাণভরে কিচিরমিচির করে ডেকেছিল। দীঘির জলের মাছগুলো নৃত্য করেছিল বর্ষার টান ছাড়াই। বৃদ্ধ লোকটির সাহচর্য পেয়ে স্বপন এক মুহূর্তের জন্য তার দুঃখগুলো ভুলে যায়। এই প্রথম তার কাছে মনে হয়েছিল পৃথিবীটা খুব সুন্দর, তার একজন আপনজন আছে।
‘দাদুভাই, কাঁদছ কেন? চলো তোমার এতিমখানায় গিয়ে তোমাকে ছুটি করিয়ে নিয়ে আসি। তুমি এখন থেকে সব সময় আমার সাথেই থাকবে।’
এই বৃদ্ধটি ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। সোনার এই দেশটিকে নিয়ে যে স্বপ্ন আলো হৃদয়ে লালন করতেন তা ভেঙে দিয়েছে উনার একমাত্র সন্তান সম্রাট। নিজের বাবাকে অক্ষম বলে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিল। পাঠিয়ে দিয়েছিল বৃদ্ধাশ্রমে। এত্তটুকুনও বুক কাঁপেনি তাতে। হাজারো দেশপ্রেমিকের ভিড়ে যে মানুষটিকে দেশ, দেশের মাটি ও মানুষ স্মরণে রাখে সগর্বে সেই মানুষটিকেই কি না উনার নিজের ছেলে দাম দেয়নি দুই পয়সারও। কিসের জন্য তা হলে দেশ স্বাধীন? কিসের এই বৃদ্ধাশ্রম? কিসের এত অবহেলা? কী জন্য বৈষম্য? গোধূলির আভায় এক বুক ব্যথা নিয়ে পথ চলছিল বৃদ্ধটি। বুকের ভেতরটা হঠাৎ মোচড় দিয়ে ওঠে। সমগ্র দেহের রক্ত টগবগ করে আগুনের মতো জ্বলতে থাকে। রাস্তার পাশে পড়ে থাকা শক্ত একটা মোটা লাঠি হাতে তুলে নেয়। এবার বাড়ির উদ্দেশে মোড় ঘুরে। সম্রাট নেশাগ্রস্ত অবস্থায় ঘুমাচ্ছিল। বাবাকে ঘরে ঢুকতে দেখেই অসভ্য এক তরুণী বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। বাইরের গেটটা লক করে বারান্দায় ছিটকিনিটা আটকে দেন। তারপর ছেলের ঘরে ঢুকে সেখানে ছিটকিনি। শরীরে এক রাজ্যের শক্তি এসে ভর করেছিল সে দিন। ছেলেকে দেয়ালের সাথে বেঁধে পিটিয়ে পঙ্গু বানিয়ে হাসপাতালে পাঠানোর ইচ্ছে জেগেছিল মনে। সেই ইচ্ছাটা শুধু পরাধীনতার শিকল ভেঙে ফেলার জন্য, সেই ইচ্ছাটা অন্যায়ের প্রতিবাদ করার জন্য, যে ইচ্ছেতে কোনো প্রকার স্বজনপ্রীতি নেই। তারপর ভয়ঙ্কর সেই মুহূর্ত। ছেলের শরীরের এমন কোনো হাড় নেই যেটি সেদিন ভাঙেননি বাবা। বাসা থেকে হাসপাতাল, সেখানে তিন মাস, তারপর আবার বাড়িতে নিয়ে এসেছেন ছেলেকে।
সম্রাট এখন পঙ্গু হয়ে ঘরে পড়ে থাকে। ডাক্তার বলেছে বেশি বেশি সেবা যতœ করলে ভবিষ্যতে হয়তো সেরে উঠতে পারে। বাবার মনে এতে কোনো কষ্ট নেই। কষ্ট তো ভবিষ্যতের চিন্তায়। তিনি মরে গেলে তখন কী হবে? যে ছেলে বাবাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠাতেও কোনো প্রকার দ্বিধাবোধ করেনি সেই ছেলের জন্য এখনো বাবা চিন্তা করে বুড়ো থেকে আরো বুড়ো হন। হতাশায় আর দুঃখে শিশুপার্কের এই ছোট্ট দীঘিটার কাছে এসে আর হাঁটতে পারেননি। অজ্ঞান হয়ে পড়ে যান। ভাগ্যক্রমে স্বপন এসে হাজির হয়। জীবনের মোড় বাঁক নেয় অন্য দিকে।
দাদুর সাথে অনেক পথ হেঁটেছে স্বপন। বয়সের ভারে দাদুকে কখনো কাবু হতে দেয়নি। তারুণ্যের শক্তি হয়ে নিজের পিঠে বহন করেছে উনাকে। জীবনের অন্তিম মুহূর্তে দাদু নিজের সব সম্পত্তি স্বপনের নামে লিখে দিয়ে যান। মায়ের মতো মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে দোয়া করেন, স্বপন যেন এ দেশের তারুণ্যের আদর্শ হয়ে বেঁচে থাকে, এমন উঁচুতে ওঠে যে সম্মানে এখনো কেউ ভূষিত হয়নি।
সজবরখিলার পাশে সেই এতিমখানার সব শিশুর দায়ভার এখন স্বপনের কাঁধে। দাদুর পঙ্গু ছেলেটিও এখন সেই এতিমখানার শিশুদের মধ্যে একজন। স্বপন তাদেরকে নিয়ে আগামীর স্বপ্ন দেখে এবং দোয়া করে যেমনটি তার মা এবং দাদু তাকে করেছিল। হ


আরো সংবাদ



premium cement
কুষ্টিয়াতে মসজিদ কমিটি নিয়ে সংঘর্ষে আহত ৫ চেয়ারম্যান তপন ও অজিত মেম্বারকে ধরিয়ে দিতে পারলে পুরস্কার ঘোষণা নারায়ণগঞ্জে ২৪ ঘণ্টায় ১৪ ডাকাত সদস্য গ্রেফতার রাজশাহীতে মৌসুমের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪২ ডিগ্রি ছাড়াল যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশী শ্রমিকদের ভিসা সহজ করার আহ্বান প্রবাসী প্রতিমন্ত্রীর চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিদ্বন্দ্বী না হয়ে অংশীদার হওয়া উচিত : শি জিনপিং ওকাব সভাপতি নজরুল ইসলাম, সম্পাদক জুলহাস আলম পাবনায় ১০ কোটি টাকার অনিয়মে ৩ ব্যাংক কর্মকর্তা কারাগারে চুয়েট ১১ মে পর্যন্ত বন্ধ, শিক্ষার্থীদের আন্দোলন স্থগিত নরসিংদীতে হিট স্ট্রোকে শিশুর মৃত্যু হিলিতে ভটভটি-মোটরসাইকেলের সংঘর্ষে নিহত ২

সকল