২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

সাহিত্য ও জীবনের অন্তর্নিহিত তাৎপর্য

-

মানুষের জীবন একটি সামগ্রিক ও বহুমাত্রিক সত্তা। তার অসংখ্য দিক ও বিভাগ এবং অগণিত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ রয়েছে। অপরিমেয় কার্যকারণ মানবজীবনে প্রতিনিয়ত কর্মরত। সাহিত্য এই পর্যায়েরই একটি বিষয় মাত্র। কিন্তু মানবজীবনে সাহিত্যের প্রকৃত অবস্থান কোথায়, তা সন্ধান করে দেখা আবশ্যক। খুঁজে দেখা দরকার যে, জীবনের সাথে সাহিত্যের সম্পর্ক কতটা ওতপ্রোতে, সাহিত্য কিভাবে লালিত-পালিত হয়, উন্নতি ও উৎকর্ষ লাভ করে এবং তখন তা কিরূপ পরিগ্রহ করে। সাহিত্যের সাথে কোন কোন দিক সম্পর্কিত, তার কল্যাণের দিকগুলো থেকে বেশি বেশি ফায়দা লাভ কিভাবে সম্ভব হতে পারে তার ক্ষতির দিকগুলো থেকে আত্মরক্ষা করা ইত্যাদি বিষয়ও খতিয়ে দেখা প্রয়োজন।
হৃদয়-মনের অনুভূতির ভাষাগত রূপায়ণকেই বলা হয় সাহিত্য। আবেগ ও চেতনাকে সুন্দর ও চিত্তাকর্ষক শব্দের বিন্যাসের মাধ্যমে ব্যক্ত করাই সাহিত্য। তা যেমন বক্তৃতা ও ভাষণরূপে প্রকাশিত হতে পারে, তেমনি কাব্য ও কবিতার ছন্দময় পরিচ্ছদেও সজ্জিত হতে পারে। গদ্য রচনার সম্ভারে বিভিন্ন রূপ নিয়েও আসতে পারে তা জনগণের সম্মুখে।
মানব সমাজের সাতে সাহিত্যের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। জীবনের মূল্যমান নির্ধারণ ও বিনির্মাণের তার ভূমিকা অত্যন্ত প্রবল। মানুষের অন্তর্নিহিত সৌন্দর্যবোধ ও সৌন্দর্যচেতনাকে তা উজ্জীবিত, উচ্ছ্বসিত ও উদ্ভাসিত করে তুলতে সক্ষম। সৌন্দর্য চেতনাকে ভারসাম্যময় এবং জীবনের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ বানাতে এবং উচ্চ মানসম্মত লালিত্য ও সুধাময় করে তোলাও সাহিত্যেরই অবদান। মানুষের মধ্যে নৈতিক চেতনা জাগ্রতকরণ এবং তার লালন ও উৎকর্ষ সাধন সাহিত্যেরই কীর্তি। কুপ্রবৃত্তির ওপর সুস্থ বিবেকবুদ্ধির বিজয় অর্জন এবং পরিশীলিত রুচিবোধ সৃষ্টি ও তাকে সৌন্দর্যমণ্ডিত করার ক্ষেত্রে সাহিত্যের দায়িত্ব ও কর্তব্য অসামান্য। সভ্যতা ও সংস্কৃতির মানকে উন্নত করার দায়িত্বও তারই ওপর অর্পিত। মানব চিত্তের চেতন, অবচেতন ও অচেতন অবস্থার মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করে দুর্বলতাগুলোকে সুস্পষ্টরূপে দেখিয়ে দেয়াও সাহিত্যেরই কাজ।
সাহিত্য আমাদের জীবনের প্রতিটি কোণ ও প্রতিটি দিকের ওপর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। তা আমাদের আনন্দের সামগ্রী পরিবেশন করে এবং দুঃখ ও দুশ্চিন্তায় ভেঙে পড়া মনকে হাত ধরে ঊর্ধ্বে তুলে দেয়। দরিদ্র ও সর্বহারার পর্ণকুটিরে যেমন তার স্থান, তেমনি ধনবান ও ক্ষমতাসীনদের বিলাসবহুল প্রাসাদেও তার অবাধ গতি। সাহিত্য মূলত আমাদের হৃদয় স্পন্দনের ক্ষীণতম প্রতিধ্বনি; শব্দের চাকচিক্যময় পোশাক পরে তা আমাদের সামনে শরীরী হয়ে দেখা দেয়। সামগ্রিক দৃষ্টিতে সাহিত্য সভ্যতা ও সংস্কৃতির এমন একটা অংশ, যাকে উপেক্ষা করা যায় নাÑ বিচ্ছিন্ন ও অপ্রয়োজনীয় মনে করাও সম্ভব নয়।
সাহিত্য জীবন ও জীবন প্রেক্ষিতের প্রতিবিম্ব। এ কারণেই প্রতিটি স্বতন্ত্র জনগোষ্ঠী ও সমাজের সৃষ্ট সাহিত্য কিছু না কিছু ভিন্নধর্মী বিশেষত্বের ধারক হয়ে থাকে, এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়। সমাজের এমন কিছু ঐতিহ্য গড়ে ওঠে যা তার সাহিত্যের জীবনদায়িনী রস হয়ে থাকে। পরিবেশগত স্বাতন্ত্র্য, ঐতিহ্যের বিশেষত্ব এবং চিন্তা ও বিশ্বাসগত সাযুজ্য ও অভিন্নতা সম্মিলিত হয়ে এক একটি বিশেষ ধরনের চিন্তা-পদ্ধতি দৃষ্টিভঙ্গি ও মূল্যবোধ সৃষ্টি করে, যা ভিন্নতার সমাজ ও সংস্কৃতির সাথে কখনোই সাদৃশ্যপূর্ণ হয় না। দৃষ্টিকোণ ও চিন্তা-পদ্ধতির স্বাতন্ত্র্য প্রকাশভঙ্গিতে স্বতঃই একটা বিশেষত্ব এনে দেয়। তাই বিশ্বের সব সাহিত্যই এক ও অভিন্ন কিছু সংখ্যক চিন্তাবিদ ও সাহিত্য দার্শনিকের এই কথা আদৌ সত্য নয়। বৈষয়িক জীবনের মৌলিক সমস্যা অভিন্ন হওয়া অসম্ভব নয়। কিন্তু সে সমস্যার বিশ্লেষণ মূল্যায়ন ও নীতিগতভাবে তার সমাধান বের করা এবং বাস্তবে সে সমস্যার সমাধান করা, সর্বোপরি তার ফলাফল দ্বারা প্রভাবিত হওয়ার পন্থা, পদ্ধতি ও ধরন কখনোই অভিন্ন হতে পারে না। এ কারণে বিশ্বাসী সমাজের সাহিত্য অবিশ্বাসী সমাজের সাহিত্য থেকে স¤পূর্ণ ভিন্নতর হওয়া অবধারিত।
জীবনের জন্য কোনো আদর্শ ও নীতির প্রয়োজনীয়তা প্রশ্নাতীত। এমন একটা আদর্শ জীবনের জন্য অবশ্যই গ্রহণ করতে হবে, যা বিশ্বালোকে এই অগণিত সৃষ্টির মধ্যে মানুষের প্রকৃত অবস্থানকে সুনির্ধারিত করবে। মানুষ তো বৃক্ষ, গুল্মলতা বা ঝরনা-নদী-সমুদ্র নয় যে, তা স্বাভাবিক নিয়মে চলবে। মানুষ পশু নয়; তাই পাশব-বৃত্তিই তার চালিকাশক্তি হতে পারে না। মানুষ বিবেক বুদ্ধি ও ন্যায়-অন্যায়ের পার্থক্যবোধসম্পন্ন সত্তা। তাই তার জীবন এসবের সুস্পষ্ট নির্ধারণকারী এক পূর্ণাঙ্গ ও সর্বজনগ্রাহ্য আদর্শ ছাড়া চলতেই পারে না। সে আদর্শই বলে দেবে, এই জীবনে মানুষের দায়িত্বের পরিসীমা কতদূর। তাই নির্ধারণ করবে প্রত্যেকের অধিকার ও কর্তব্য। পারস্পরিক বিরোধ-বিসম্ব^াদ ও মত-বৈষম্যের মীমাংসা করা সেই সর্বজনীন আদর্শের ভিত্তিতেই সম্ভব। আমাদের আলোচ্য সাহিত্যের দর্শন ও রূপরেখাও তারই আলোকে নির্ধারণ করতে হবে অবশ্যম্ভাবীরূপে।
ক্রোধ, লোভ ইত্যাকার প্রবৃত্তি মানব সত্তায় নিহিত বিভিন্ন গুণ। এই গুণগুলোর শক্তি অদম্য। তাই সঠিক নির্দেশনা হচ্ছেÑ এই গুণ ও তার শক্তিকে একটি নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে সংযত রাখা, তাকে কোনোক্রমেই বলগাহীন না করা, বলগাহীন হতে না দেয়া বরং নির্দেশিত পথে ও নিয়মে তাকে চরিতার্থ করা। এগুলোর উৎপাদন ও নির্মূল সাধন বৈষ্ণব বা বৈরাগ্যবাদের শিক্ষা। সুস্থতায় তা সম্পূর্ণরূপে অসমর্থিত।
ক্রোধকে সংযত করা এবং অপরাধীকে ক্ষমা করা কুরআনের শিক্ষা। মানুষের জন্য তা এক অতীব উচ্চমানের নৈতিকতা। যারা ক্রোধকে সংযত রাখে এবং অপরাধীকে ক্ষমা করে, তারা মহান স্রষ্টার প্রিয়জন। সাহিত্যের সাহায্যে মানুষে মানুষে, শ্রেণীতে শ্রেণীতে হিংসার আগুন জ্বালানো মানব সমাজের জন্য ক্ষতিকর এবং এই গুণটিরও চরম অপব্যবহার। জাহেলি যুগে কবি-সাহিত্যিকরা তাদের কাব্য ও সাহিত্য দিয়ে গোত্রগুলোর পরস্পরের মধ্যে শত্রুতার আগুন উৎক্ষিপ্ত করে তুলত; প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য পরস্পরকে উদ্বুদ্ধ করত। অপরাধকে যে ক্ষমা করা যায় তা ছিল তখনকার মানুষের কল্পনারও অতীত। ইসলাম কাব্য ও সাহিত্যের এই অপব্যবহার বন্ধ করে দেয় এবং মানুষে মানুষে বন্ধুতা-ভালোবাসা ও সদ্ভাব-সম্প্রীতি সৃষ্টির কাজে তার ব্যাপক ব্যবহারের শিক্ষা দেয়। মানুষের জীবনকে তা সম্মানিত ও সম্মানার্হ করে তোলে। এহেন মানুষের প্রতি অশ্রদ্ধা, অপমান এবং তার ওপর অত্যাচার ও নিপীড়ন চালানোর প্রতি সমর্থন জানানো হয় যে সাহিত্যে কিংবা যে সাহিত্য মানুষকে এই কাজে প্রলুব্ধ করে, সে সাহিত্য মানুষের জন্য কিছুমাত্র কল্যাণকর নয়।
লোভ মানুষকে অন্যায়ভাবে সম্পদ আহরণে প্রবৃত্ত করে। শোষণ ও বঞ্চনার মূলে সর্বাধিক কাজ করে এই লোভ। তাই মানুষকে লোভাতুর, শোষক ও বঞ্চনাকারী বানানো সাহিত্যের কাজ হতে পারে না। সাহিত্যকে এ কাজে ব্যবহার করা হলে তা যে মানবতার জন্যে চরম দুঃখের কারণ হবে তাতে কোনো সন্দেহ থাকতে পারে না।
আদর্শহীন জনগণকে আদর্শবাহী বানানো, অজ্ঞ-মূর্খ লোকদের প্রয়োজনীয় নির্ভুল জ্ঞান পরিবেশন এবং সাহস ও হিম্মতহীন মানুষকে সাহসী ও নির্র্ভীক করে গড়ে তোলা সাহিত্যেরই কাজ। সাহিত্যকে এই কাজে ব্যবহার করা কবি-সাহিত্যিকদের মানবিক দায়িত্ব। আদর্শহীন ও বিশৃঙ্খল চিন্তার কুহেলিকা সৃষ্টি করে জনগণকে বিভ্রান্ত করা ও তাদের নিরুদ্দেশের যাত্রী বানানোর কোনো অধিকার কবি বা সাহিত্যিকদের থাকতে পারে না। কবি-সাহিত্যিকরা জাতির মেধা ও মননের প্রতিনিধি। জাতির সামগ্রিক কল্যাণের প্রতি তারা অঙ্গীকারাবদ্ধ থাকবেন, এটাই একান্তভাবে কাম্য। মহাকবি রুমি, জামি, সাদী ও ইকবালের অসামান্য কথা স্মরণ করা যেতে পারে। বর্তমানে নানা ভ্রান্ত মতবাদ, জীবন-দর্শন ও জীবনাচরণ আমাদের বংশধরদের ব্যাপকভাবে বিভ্রান্ত ও কলুষিত করে চলছে। কবি-সাহিত্যিকদের কর্তব্যÑ তাদের এ অবস্থা থেকে মুক্ত করা এবং নির্ভুল চিন্তা-দর্শন, মতবাদ ও আচার-আচরণে উজ্জীবিত করার লক্ষ্যে সাহিত্য সৃষ্টি করা, তা নির্দ্বিধায় বলতে চাই। সর্ব প্রকার নীচত-হীনতা, ক্ষুদ্রতা, কাপুরুষতা ও সাহসহীনতা থেকে এ জাতিকে রক্ষা করতে পারে আদর্শবাদী কাব্য ও সাহিত্য, এতে কোনো সন্দেহ নেই। জীবনীশক্তিরহিত ও ভীতসন্ত্রস্ত এ জনতার দেহে জীবনবাদের বলিষ্ঠ ভাবধারা সৃষ্টি করা হলেই এর পক্ষে বেঁচে থাকা সম্ভব। অন্যথায় ইতিহাসের নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া জাতিগুলোর পরিণতি আমাদেরও নিয়তি হয়ে দাঁড়াবে, তা রোধ করার শক্তি কারোরই নেই। প্রবল শক্তি-সামর্থ্য ও বলিষ্ঠ মন-মানসিকতা এক একটি জাতির প্রাণশক্তি বা আত্মা স্বরূপ এবং তা মৃতপ্রায় এ জাতির দেহে নতুন করে ফুঁকতে হবে আমাদের লেখক, কবি, সাহিত্যিকদেরই। আজ যে জুলুম, পীড়ন, শোষণ, অপচয়, দুর্নীতি, লুটপাট, অশ্লীলতা ও ব্যভিচারের সয়লাবে গোটা জাতি ভেসে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে, কবি-সাহিত্যিকদেরই কর্তব্য হচ্ছেÑ তার মুখে বাঁধ নির্মাণ, পানি সেচা ও গঠনমূলক ভূমিকা রাখা বর্তমান যুগ চিন্তা, দর্শন ও মতবাদের যুগ। বিশ্বাসী কবি সাহিত্যিকদের এ ব্যাপারে সচেতন করে তুলতে হবে এবং এ যুগের চলমান সংগ্রামে উপযুক্ত ভূমিকা পালন করার জন্য তাদের প্রস্তুত করে তুলতে হবে। ভুল চিন্তা ও বিশ্বাস দর্শনকে খণ্ডন করতে হবে, ভ্রান্ত মতাদর্শের সৃষ্টি বিভ্রান্তির মোকাবেলা করতে হবে নির্ভুল চিন্তা-বিশ্বাস ও সত্যভিত্তিক মতাদর্শ দ্বারা। এই কাজ মূলত ও প্রধানত সাহিত্যের। এর বিপরীত কাজে সাহিত্যকে ব্যবহার করা হলে তা হবে আত্মবিধ্বংসী ব্যাপার।
সাহিত্য চিরকালই প্রগতিশীল। প্রগতি সাহিত্যের মৌল ধর্ম-স্বাভাবিক প্রবণতা। সাহিত্যের ক্ষেত্রে একেক সময় একেকজন দিকপালের আবির্ভাব ঘটে, যিনি সাহিত্যকে নবধারায় প্রবাহিত করেন। ফলে সাহিত্যে যেমন গতানুগতিকতা টিকতে পারে না, তেমনি থাকে না স্থবিরতা ও অনগ্রসরতা। সাহিত্যে সৃষ্ট হয় নবতর রস ও প্রবাহ। কেননা, কোনো সাহিত্যিকই সাধারণভাবে প্রগতিবিরোধী হন না। কাল ও প্রেক্ষিতের পরিবর্তনের সাথে সাথে সমাজ-বিকাশের সাথে তাল রেখে নিত্য-নব উন্মেষিত ভাবধারাকে সম্বল করে তিনি সৃষ্টি করেন নবতর সাহিত্য। পদ্ধতি, স্টাইল ও দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রে ব্যক্তিতে-ব্যক্তিতে ভিন্নতা ও পার্থক্য সাহিত্যের ভাণ্ডারকে পরিপূর্ণ করে তোলে। ফলে সাহিত্য অতীতকে অনেক পশ্চাতে ফেলে সম্মুখের দিকে এগিয়ে যায় দ্রুত গতিতে। তাই সাহিত্যে প্রগতি অনস্বীকার্য।
তবে প্রগতি সম্পর্কিত ধারণা সবসময় একইভাবে অনড় ও স্থিতিশীল থাকে না। তা চিরকালই পরিবর্তিত হয়ে এসেছে এবং ভবিষ্যতেও পরিবর্তিত হতে থাকবে।
সাহিত্যের ক্ষেত্রে আজ যেসব মূল্যমানের প্রশংসায় সমাজ উচ্চকণ্ঠ, আগামীকালই তা হতে পারে পরিত্যক্ত। সাহিত্যে যৌনতার চর্চা অতি প্রাচীন; কিন্তু তার সীমা লঙ্ঘনমূলক বা অত্যধিক প্রয়োগ সুস্থ মন-মানসিকতায় অনিবার্যভাবে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে; ফলে ক্রমে তা সাহিত্যের অঙ্গন থেকে বিলীন হয়ে যায়, যেমন ফাল্গুনের ছোঁয়ায় গাছ থেকে ঝরে পড়ে পুরনো পত্রপল্পব। তা কোনো স্থায়ী মূল্যমানের ধারক হয় না বলে শ্রেয়বোধের তাড়নায় আপনা আপনি খসে পড়তে বাধ্য হয়।
এককালে শিল্পের জন্যই শিল্প’ এই দৃষ্টিভঙ্গিই ছিল সাধারণভাবে কবি-সাহিত্যিকের মটো। পরবর্তীকালে তা হয় শিল্প জীবনের জন্য। কোনো পাঠকই ঘটনার যথাযথ প্রতিবেদনকে সাহিত্যের যথাযথ মানে উন্নীত বলে স্বীকার করতে রাজি হবে না যতক্ষণ না তাতে সাহিত্যস্রষ্টার কল্পনার চিত্তাকর্ষক রঙমিশ্রিত হয়। একজন সুসাহিত্যিক শুধু এটুকু বলেই ক্ষান্ত হতে পারেন না যে, ‘বস্তুটি কি’ বরং কী হওয়া উচিত বা কী হতে পারত তা বলাও তার দায়িত্ব বলে মনে করেন। এটা তার গভীর মননশীলতা ও চিন্তাশীলতার বিশেষত্ব। অন্য কথায় সাহিত্য জীবনের শুধু দর্পণই নয়, তা জীবনকাফেলার পথপ্রদর্শকও। জীবনের গতির সাথে তাল রেখে চলাই তাঁর ধর্ম নয়, জীবনকে নির্দিষ্ট লক্ষ্যপারে এগিয়ে নেয়ার দায়িত্বও তারই। নিছক বস্তুনিষ্ঠ রচনার প্রাচীরের ওপর আসীন হয়েই প্রগতি বিপ্লব বা পশ্চাৎপদতার ছবি তোলা যেতে পারে না। সমাজের পরিবর্তনকামী সাহিত্যই জীবন্ত ও শাশ্বত।
ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য, সৌন্দর্যবোধ, কল্পনাপ্রবণতা, ব্যবহারিকতা, বাস্তবতা ও সামষ্টিকতা একই সত্যের বিভিন্ন প্রকাশ মাত্র। এগুলোর সাযুজ্যই শিল্প বা সাহিত্যকে পূর্ণ রূপে ও উচ্চমানে উন্নীত করতে পারঙ্গম। একজন সফল সাহিত্যিক বা শিল্পী আমাদের সৌন্দর্যবোধকেই শুধু চরিতার্থ করেন না, আমাদের চিন্তার রুচিশীলতা ও কর্মের প্রেরণাকেও গতিশীল রাখেন। আমরা যেমন ‘কাল’কে প্রভাবিত করি, তেমনি কালও প্রভাবিত হয় আমাদের দিয়ে। সফল সাহিত্যিক কাল-স্রোতে ভেসে যাওয়াতেই মনুষ্যত্বের সার্থকতা নিহিত বলে মনে করেন না; বরং কাল স্রোতের গতি পরিবর্তন করে তাকে স্বনির্ধারিত লক্ষ্যপানে প্রবাহিত করাকে নিজের একটা বড় কর্তব্য বলেও মনে করেন।
চিন্তা ও কর্মের স্বাধীনতা নিঃসন্দেহে অতিশয় গুরুত্বের অধিকারী। স্বাধীনতা ব্যক্তির জন্মগত অধিকার, তাও কেউ অস্বীকার করতে পারে না। কিন্তু স্বাধীনতার যথার্থ তাৎপর্য অনুধাবন এবং তার নীতিমালা ও রূপরেখা নির্ধারণ যার তার কর্ম নয়। ঋৎববফড়স সবধহং ৎবংঢ়ড়হংরনরষরঃু বা ‘স্বাধীনতার অর্থ দায়িত্ববোধ ও বর্তব্যপরায়ণতা’ এ কথা অবশ্যই স্বীকৃত ।
এই দৃষ্টিতে বলা যায়, নিজস্ব চিন্তাভাবনা ও হৃদয়াবেগ প্রকাশের পূর্ণ স্বাধীনতা প্রত্যেক সাহিত্যিকেরই মৌলিক অধিকার বিশেষ, এ কথা সত্য; কিন্তু তা একটা নিয়মতান্ত্রিকতা ও নৈতিকতার বিধান দিয়ে অবশ্যই নিয়ন্ত্রিত হতে হবে। মানবজীবনে এমন সব অভিজ্ঞতা অনেক ক্ষেত্রে ঘটে, যা পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করা হলে আমাদের সৌন্দর্যবোধ ও সূক্ষ্ম হৃদয়াবেগ নিঃসন্দেহে ক্ষুণœ ও আহত হবে। অতএব যে বক্তব্য কেবল পাশবিক কামনা-বাসনাকেই উত্তেজিত করে, তা কখনোই সার্থক ও স্থায়ী মূল্যমানসংবলিত সাহিত্য পদবাচ্য হতে পারে না। কিন্তু তাই বলে সাহিত্যে যৌন-সম্পর্কের একদম প্রবেশাধিকার থাকবে না, এমন কথা নয়। অনেক সময় রোমান্টিক গল্প, উপন্যাস বা কবিতায় যৌন-সম্পর্কের প্রয়োগ অপরিহার্য হয়ে ওঠে। কেননা, আমাদের জীবন বৃক্ষের শিকড় যৌন কামনার মৃত্তিকা গভীরে বিস্তীর্ণ হয়ে আছে। কিন্তু সাহিত্যে যৌন-সম্পর্ককে উপস্থাপন করতে হবে শালীন শৈল্পিক ও রুচিসম্মতভাবে, তার অশ্লীল ও নগ্নভাবে উপস্থাপন সাহিত্যের মান সংরক্ষণে কখনোই সহায়ক হতে পারে না।
আসলে মানব জীবনের অন্য সব দিকের মতো সাহিত্যের ক্ষেত্রেও ঐতিহ্যের গুরুত্ব অপরিসীম। ঐতিহ্যকে বাদ দিয়ে যে সাহিত্য, তা যেমন কালজয়ী হয় না, তেমনি তা মানুষের কোনোরূপ কল্যাণ সাধনে কিংবা মানব মনে কোনো মহৎ প্রেরণা ও কর্মচাঞ্চল্য সৃষ্টি করতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হতে বাধ্য। মানুষের ঐতিহ্য তার অস্তিত্ব ও ইতিহাসের মূল দর্শন থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। তার অস্তিত্বের মূল দর্শন হলোÑ মানুষ এই বিশ্বলোকে উদ্দেশ্যমূলক তার বিশেষ সৃষ্টি। এখানে তার বিশেষ মর্যাদা তার এই বিশেষ জন্ম সত্যেরই স্বাভাবিক ফসল। কাজেই বিশেষ উদ্দেশ্যমূলক সৃষ্টি হওয়ার কারণে সে উদ্দেশ্যের বাস্তবায়নে তার গোটা জীবনই নিবেদিত হওয়া বাঞ্ছনীয়। তার সাহিত্য যখন সে উদ্দেশ্যের পরিপূরক হয়ে দেখা দেবে, তখনই মানব সমাজে তা সাগ্রহে গৃহীত ও আদৃত হবে এবং গণমানুষের জন্য অফুরন্ত কল্যাণ বয়ে আনবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু যে সাহিত্য মানুষের এ ভাবধারার পরিপোষক নয়, যে সাহিত্য মানুষকে হিংস্রতা, পাশবিকতা, লালসার প্রতিমূর্তি হিসেবে উপস্থাপন করে, সমাজে নিয়ম-শৃঙ্খলার পরিবর্তে উচ্ছৃঙ্খলতা ও বিপর্যয়ের ইন্ধন জোগায়, তা মানবোপযোগী সাহিত্য হতে পারে না। হ

 


আরো সংবাদ



premium cement