গতকালের পর
বাজার: পর্যটন থেকে যেকোনো দেশই যেভাবে লাভবান হতে পারে তেমনিভাবে তীর্থযাত্রার জন্য আরবদের আসা-যাওয়ার প্রবাহ এবং কেনাকাটা থেকে উপকৃত হয়েছিল মক্কা। মক্কার প্রধান বাজারগুলো স্থায়ীভাবে একটি নির্দিষ্ট স্থানে স্থাপন করা হয়নি, বরং বিভিন্ন দিনে বিভিন্ন স্থানে বাজার বসত। সবচেয়ে বিখ্যাত বাজার ছিল মিজানা, ধু আল-মিজাজ এবং ওকাজ।
ওকাজের সৌক ছিল মক্কার সবচেয়ে বিখ্যাত বাজার (সৌক অর্থ ‘বাজার’ বা ‘মেলা’) এবং এটি কেবল একটি বাজারই ছিল না- এতে কবিতা পাঠ এবং স্থানীয় এবং আমদানিকৃত বিভিন্ন প্রকারের পণ্যের বেচাকেনার সাথে সাথে ক্রীড়াবিদদের প্রতিযোগিতা ও একটি বার্ষিক উৎসবও ছিল।।
নবী মুহাম্মদ সা: ওকাজের মেলার উৎকর্ষ সময়ে বাস করতেন এবং এতে কেনাকাটা করতেন, কিন্তু তিনি এর গানবাজনার আসর থেকে দূরত্ব বজায় রেখেছিলেন। সারা বিশ্বের অনেক জমজমাট বাজারের মতো, ওকাজের মেলার অংশ ছিল জুয়া, পতিতাবৃত্তি এবং অন্যান্য অনৈতিক আচরণও।
মুহাম্মদ সা: ওকাজের মেলার চার পাশে সতর্ক থাকার মতো যথেষ্ট স্মার্ট ছিলেন, সেখানে তিনি ব্যবসা করতে যেতেন কিন্তু ঝামেলা থেকে দূরে ছিলেন। চলুন আমরা এক শ’ শতকের আরব বাজারে দৈনন্দিন কার্যকলাপের আরো একটি ছবি আঁকি।
ওকাজের মেলা
ওকাজের মেলা অবিশ্বাস্য পরিসরের বিচিত্র কর্মকাণ্ডে পরিপূর্ণ ছিল : সেখানে ছিল ক্রেতা ও বিক্রেতা; কবিতা এবং ক্রীড়া প্রতিযোগিতা; বিভিন্ন গোত্র সেখানে দাতব্য কাজ করতো, যার মধ্যে ছিল, গরিবদের খাওয়ানো, ভিক্ষুকদের সাহায্য দেয়া, অথবা মুক্তিপণ প্রদান ও বন্দীদের মুক্ত করা; বিরোধ নিষ্পত্তি আর চুক্তি নিয়ে আলোচনাও একটি ফোকাস ছিল।
মক্কা, তায়েফ এবং ইয়াস্রিব (মদিনা) থেকে এবং বাহরাইন, ওমান, ইয়েমেন, সিরিয়া ও ইরাক থেকে গোত্রগুলো সেখানে আসে, বাজারের উপকণ্ঠে তাদের লাল চামড়ার তাঁবু স্থাপন করে, প্রতিটি গোত্র তার নিজস্ব ব্যানার উড্ডীন করে রাখত। গোত্রগুলো তাদের সাথে বিক্রি করার জন্য পণ্য নিয়ে আসত, সেই সাথে তাদের সবচেয়ে প্রতিভাবান কবিরা আসত, যারা তাদের নিজস্ব গোত্রের প্রশংসা করার ক্ষেত্রে একে অপরকে ছাড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করত।
বাজারের ভিড়ের মধ্যে এ ছাড়া নানা ধরনের জঘন্য কাজও চলত। যৌন ছিনালিপনা বা হয়রানি উপজাতিদের মধ্যে লড়াই বাধার মতো অবস্থাও দেখা দেয়ার পরিস্থিতি সৃষ্টি হতো। যারা জুয়া বা পতিতাবৃত্তির জন্য আসত তাদের দুষ্কর্মের জন্যও যথেষ্ট সুযোগ ছিল। তারা প্রথমবারের মতো শহরে আসা প্রশস্ত চোখের বেদুইন ছেলেদের প্রলুব্ধ করতে চাইত। আর এর মধ্যে অবশ্যই চুরি, প্রতারণা ও শোষণ বাজার থেকে খুব কমই অনুপস্থিত ছিল।
বাজারে মুহাম্মদ সা: আপনি যদি সময় মতো ফিরে যেতে পারেন এবং ওকাজের মেলার মধ্যে ঘুরে বেড়াতে পারেন তবে আপনি কিছু অস্বাভাবিক আচরণ লক্ষ করবেন, যা সেই সময়ে সম্পূর্ণ স্বাভাবিক ছিল। মহিলারা তখন বোরকা পরতেন, যা কিছু দেশে এখনো বিদ্যমান। কিন্তু অনেক পুরুষও তখন মুখ ঢেকে রাখত।
এর জন্য অনেক কারণের কথা উদ্ধৃত হয়েছে। সম্ভবত এটি ছিল তাদের সুদর্শন বৈশিষ্ট্যগুলোকে আড়াল করার জন্য (যা অবশ্যই সবার ক্ষেত্রে হতে পারে না!) অথবা বিপরীতভাবে, রহস্যের আভা তৈরি করে নিজের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করাও হতে পারে।
একটি আরো বাস্তববাদী কারণ হতে পারে কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী গোত্র দ্বারা চিহ্নিত করা এবং মুক্তিপণের জন্য অপহরণ করা এড়ানো।
আপনি আরো দেখতে পাবেন যে, লোকেরা চারপাশে জড়ো হয়েছে, গল্প করছে, গসিপ করছে এবং কৌতুক বলছে- সম্ভবত এসব ছিল পরিচিত দৃশ্য। অন্যত্র, পারিশ্রমিকের বিনিময়ে ভাগ্যগণনাকারীরা ডাইভিং তীর ছোড়ার মাধ্যমে ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ বা একটি নির্দিষ্ট কাজের পরামর্শ দেয়ার দৃশ্য (১৩০০ বছর আগে ম্যাজিক ৮ বলের পূর্বাভাস)। ওকাজের মেলা সত্যিই মানুষ, পণ্য এবং নানা কার্যকলাপের সমন্বয়ে হওয়া একটি রঙিন উৎসব ছিল।
মুহাম্মদ সা: মক্কার বাজারের এই যুগটিতে বসবাস করেছিলেন এবং ওকাজের মেলায় তিনি কেনাকাটা করেছিলেন। কিন্তু তাঁর জন্য যা ভালো তা বেছে নেয়ার প্রজ্ঞা ছিল তাঁর।
এমনকি যদি মনে হয় যে, প্রায় সবাই বাজারের বীভৎস দিকটি গ্রহণ করেছে, মুহাম্মদ সা: তখনো বিচক্ষণতার সাথে ঝামেলা এড়িয়ে গেছেন, তাঁর নিজের নীতি এবং বিশ্বাসের দ্বারা তাঁর সমাজের কাজ বিচার করেছেন। যদি তিনি জানতেন যে, এটি ভুল ছিল তাহলে সমাজে যা গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হবে তাতেও তিনি সাড়া দেননি।
মুহাম্মদ সা: বাজারে কেনাবেচা করতেন, তা না হলে কেবল তিনি তাঁর নিজের জীবন এবং সৃষ্টিকর্তা নিয়ে চিন্তা করার উদ্দীপক কিছুর প্রতি আকৃষ্ট হন।
আমরা হাদিস থেকে জানি যে, যখন তিনি ২০ বছর বয়সে ছিলেন, মুহাম্মদ ওকাজের মেলায় ধর্মপ্রচারক কিস ইবনে সাদার প্রদত্ত বিখ্যাত ভাষণটি শুনেছিলেন, যিনি জনসাধারণকে সতর্ক করেছিলেন যে, তারা সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের প্রতি অমনোযোগী। সত্য এই যে পথচারীরা যেমন ভিড় করেছিল তেমনি মুহাম্মদ সা: দাঁড়িয়ে ছিলেন এবং মনোযোগসহকারে প্রচারকের কথা শুনেছিলেন। এটি, ধর্মের প্রতি তার প্রথম দিকের আগ্রহের চিত্রই তুলে ধরে।
ধর্মপ্রচারক কিস তার ঘোষণার মধ্যে বলেছেন : ‘যিনি বেঁচে ছিলেন তিনি মারা গেছেন, আর যিনি মারা গেছেন তিনি তার সুযোগ হারিয়েছেন... মানুষ কি মনে করে যে, তারা যাবেন আর কখনো ফিরে আসবেন না? তারা কি তাদের কবর নিয়ে এত খুশি যে, তারা সেখানে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন? নাকি তাদের সেখানে ঘুমানোর জন্য রেখে দেয়া হয়েছে? গাফিলতিহীন শাসক, মরুভূমির জাতিগুলো এবং বহুকাল চলে যাওয়া শতাব্দীর অভিশাপ... কোথায় তারা যারা নির্মাণ ও তৈরি করেছিলেন, যারা সাজসজ্জা ও পরিত্রাণ বানিয়েছিলেন? ... তারা কি আপনাদের চেয়ে ধনী ছিলেন না এবং আপনার চেয়ে বেশি দিন বেঁচে ছিলেন না? ... এখন এমনকি তাদের হাড় ক্ষয়ে গেছে এবং তাদের বাড়িগুলো পরিত্যক্ত, বেওয়ারিশ কুকুররা সেখানে বসবাস করে। একমাত্র ঈশ্বরই চিরস্থায়ী। তিনি এক এবং একমাত্র, তাঁরই উপাসনা করতে হবে। তিনি কারো পিতা নন, তিনি জন্মগ্রহণকারীও নন।’
প্রায় দুই দশক পর নবী হিসেবে অভিষিক্ত হওয়া পর্যন্ত মুহাম্মদ সা: কিসের এই উপদেশটি মনে রেখেছিলেন। কিসের কথায় তিনি এতটাই অভিভূত ছিলেন যে তাঁর কাছে এসব কথা বেশ তাৎপর্যপূর্ণ মনে হয়েছে।
এটি সাধারণ কোনো কিছু ছিল না যাতে ২০ বছরের কেউ বাজারের প্রলোভনকে উপেক্ষা করবে উপদেশ শোনার জন্য।
পর্বটি ব্যাখ্যা করে যে কীভাবে লোকেরা- বিশেষ করে তরুণরা সঠিক পথ বেছে নেয়ার ক্ষমতা রাখে, এমনকি যারা তাদের বিপথে চালিত করার চেষ্টা করে তারা চার পাশে থাকা সত্ত্বেও।
চলবে
অনুবাদ : ফারাহ মাসুম
`
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা