০২ মে ২০২৪, ১৯ বৈশাখ ১৪৩১, ২২ শাওয়াল ১৪৪৫
`


রোহিতপুরী ও জয়পাড়া লুঙ্গি হারিয়ে যাচ্ছে

লকডাউনে নিঃস্ব কেরানীগঞ্জ ও দোহারের ১০ হাজার তাঁতি
-

কেরানীগঞ্জের রোহিতপুর এবং দোহারের জয়পাড়া তাঁত শিল্পের জন্ম ইতিহাস খুঁজে পাওয়া কঠিন। তবে গান্ধীর স্বদেশী আন্দোলনের সময় বিদেশী বস্ত্র পরিহার করে দেশী বস্ত্র ব্যবহারের লক্ষ্যে তাঁত শিল্পের উৎপত্তি ঘটে বলে অনেকের ধারণা। এরই অংশ হিসেবে কেরানীগঞ্জের রোহিতপুর ও দোহার এলাকার জয়পাড়ায় লুঙ্গি বুনন শুরু হয় ২০০ বছর আগে। সুপ্রাচীন জয়পাড়া ও রোহিতপুরের লুঙ্গি এখন বিলুপ্ত প্রায়। ২০ হাজার তাঁতের মধ্যে এখন টিকে আছে চার হাজার। জয়পাড়া লুঙ্গি এখন হারিয়ে যাওয়ার দশা। উপকরণের মূল্যবৃদ্ধি, লুঙ্গির অবাধ অনুপ্রবেশ, রঙসুতা, মোম, তেলসহ কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধি ও যথাযথ পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে কেরানীগঞ্জ ও দোহারের তাঁত শিল্পে চরম নৈরাজ্য বিরাজ করছে। তাঁতশিল্পীরা এ পেশায় মন্দা দেখে অন্য পেশায় চলে যাচ্ছেন। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে ভৈরব, পাবনায় ভুয়া তাঁতিরা জয়পাড়ার সিল ব্যবহার করে জমজমাট ব্যবসা করছেন। অন্যদিকে লকডাউনের কারণে তাঁত শিল্প বন্ধ ও তাঁতিদের কাজ না থাকায় সব হারিয়ে প্রায় নিঃস্ব হওয়ার পথে এই দুই উপজেলার প্রায় ১০ হাজার তাঁতি।
অনুসন্ধানে জানা যায়, কেরানীগঞ্জ উপজেলার রোহিতপুর এবং দোহার উপজেলার জয়পাড়া এক সময় বিখ্যাত হয়েছিল লুঙ্গির জন্য। রোহিতপুর ও জয়পাড়া সড়কের বিভিন্ন অলি-গলিতে ঢুকতেই কানে ভেসে আসত কাঠ, লোহা, বাঁশ দিয়ে তৈরি তাঁত মেশিনে কাপড় বুননের শব্দ। এ সড়কের দু’পাশে ছোট ছোট টিনের ঘরেই ছিল তাঁতশিল্পীদের স্বপ্নের ভুবন। তবে এখন এসব গ্রামে তাঁত শিল্প খুঁজে পাওয়া যাবে না। সবই বিলীন হয়ে গেছে। শুধু পড়ে আছে তাঁত মেশিনের ধ্বংসাবশেষ। অনেকেই তাঁত বন্ধ করে অন্য পেশায় চলে গেছেন। এভাবে চলতে থাকলে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে তাঁত শিল্পের কোনো ধারণাই থাকবে না। তারা জানবে না চুঙ্গা, নাইল, নথি, সানা, বও, হরমুয়াবাসিসহ তাঁতের বিভিন্ন যন্ত্রাংশের নাম। অনেক প্রতিকূলতার পরও টিকে থাকা তাঁতিদের অভিযোগ, জয়পাড়া এখন ভুয়া তাঁতিতে সয়লাব। উপকরণের মূল্যবৃদ্ধিসহ, বিভিন্ন কারণে যখন তাঁতিরা এ পেশা ছেড়ে দিয়ে অন্য পেশায় চলে যাচ্ছে, তখন এলাকার কিছু সুযোগসন্ধানী অসৎ লোক ভুয়া তাঁতি সেজে ভৈরব, পাবনা, বাবুর হাটের লুঙ্গিতে জয়পাড়া ও রোহিতপুরের সিল মেরে বাজারে কম দামে বিক্রি করছে। এতে প্রকৃত তাঁতিরা যেমন ব্যবসায় লোকসান গুনছেন, তেমনি ক্রেতারা প্রতারিত হচ্ছেন। অভিযোগ রয়েছে, দোহার নবাবগঞ্জ ইউভার্স কো-অপারেটিভ ইন্ডাস্ট্রিজ সমবায় সমিতির বিরুদ্ধে। তাঁতিদের শ্রম আর ঘামের উপার্জিত অর্থ দিয়ে কোটি কোটি টাকার সম্পদ করা হলেও তাঁতিদের ভাগ্যোন্নয়নে সমিতির কর্মকর্তারা কিছুই করছেন না বলে অভিযোগ পাওয়া যায়। তাদের দাবি দেশে লকডাউন শুরু হওয়ার পর থেকে তাঁতপল্লীর কাপড় বুনন ও বেচাকেনা কমে গেছে। সরকার বা সমিতির লোকজন তাদের দুর্দিনে এগিয়ে আসেনি। পায়নি কোনো প্রণোদনা বা সহজ শর্তে ঋণসুবিধা। এ কারণে অনেক তাঁতি বিগত দিনে তাদের অর্জিত সব সম্পদ শেষ করে লাগাতার লকডাউনে এখন নিঃস্ব।
জয়পাড়া ও রোহিতপুরী লুঙ্গি তৈরির ইতিহাস : জয়পাড়া ও রোহিতপুরী লুঙ্গি তৈরির ইতিহাস সম্পর্কে কারো কোনো ধারণা নেই। সবাই বলছে তাদের পূর্বপুরুষগণ লুঙ্গি বানাতেন তাই তারাও বানিয়েছেন। তবে এ পেশার প্রসার ঘটে ৭১-৭২ সালে। সে সময়ে দুই উপজেলায় ২৫-৩০টি তাঁত নিয়ে লুঙ্গি তৈরিতে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন উদ্যোক্তারা। তখন তারা চাটগাঁয়ের বহর কমের শক্ত লুঙ্গি পরতেন। যাদের অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো শুধু তারাই কেবল ধুতি ব্যবহার করতেন। নিম্ন আয় ও বংশের সাধারণ মানুষ লুঙ্গি ব্যবহার করত। চাটগাঁয়ের শক্ত লুঙ্গি খাটো ও বহর ছোট হওয়ায় তারা স্থানীয় প্রযুক্তি দিয়ে লুঙ্গি বানানো শুরু করেন। তবে এর আগেও এখানে লুঙ্গি তৈরি হয়ে থাকতে পারে বলে ধারণা করা হয়। তখন মাত্র ১৫টি তাঁত ছিল। আস্তে আস্তে মানুষ বৃদ্ধির সাথে সাথে তাঁত শিল্পের বিস্তার ঘটে।
লুঙ্গির বিস্তার : ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় মানুষের মধ্যে দেশাত্মবোধ বৃদ্ধি পায়। তখন তারা বিদেশী বস্ত্র পরিহার করে দেশী বস্ত্র ব্যবহার করতে শুরু করে। ১৯৮২-৮৩ সালে এরশাদ সরকার এ শিল্পকে উৎসাহ প্রদান এবং বিস্তার ঘটানোর লক্ষ্যে সহজ শর্তে তাঁতিদের মধ্যে তাঁতপ্রতি তিন হাজার থেকে ছয় হাজার টাকা পর্যন্ত ক্ষুদ্র ঋণ দেয়। এ ঋণের আওতায় তখন জয়পাড়ায় ১৫ হাজার এবং রোহিতপুরে ৮-১০ হাজার তাঁত শিল্প গড়ে ওঠে এবং তাঁত শিল্পের বিস্তার ঘটে।
আধুনিকায়নের ছোঁয়া : ১৯৮৫ সালে কেরানীগঞ্জ, দোহার-নবাবগঞ্জের তাঁত শিল্পে আধুনিকায়নের ছোঁয়া লাগে। তখন বস্ত্র তৈরিতে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু হয়। এ পরিবর্তনের ফলে দু’জন লোক একসাথে ১০-১২টি তাঁত চালাতে সক্ষম হয়। এর আগে দু’জন লোক একটি মাত্র তাঁত চালাতে পারতেন। তখন প্রায় ১৫-২০ হাজার শ্রমিক এ শিল্পে কাজ করতেন। শ্রমিকদের অভাব থাকায় কুমিল্লা থেকে শ্রমিক এনে তাদেরকে শিখিয়ে তারপর কাজে লাগানো হতো।
সুতার ব্যবহার : স্বাধীনতার আগে জয়পাড়ার তাঁত শিল্পে জাপানি ও আমেরিকার সুতা ব্যবহার হতো। স্বাধীনতার পর একচেটিয়া ভারতের সুতা ব্যবহার হতে থাকে। তখন বাজার চলে যায় ভারতের দখলে। এ সময় তাঁত বস্ত্র তৈরিতে সুতার লাইসেন্স প্রথা চালু হয়। তখন লাইসেন্সধারীরা কম দামে সুতা কিনে বেশি দামে সুতা বিক্রি করে শিল্পের ব্যাপক ক্ষতি করে। তখন সুতার মূল্যবৃদ্ধিতে অনেকে কাপড় তৈরি করা বন্ধ রাখেন। পরে জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে সরকারি ও ব্যক্তি মালিকানাধীন সুতার দাম একই মানে নিয়ে আসায় এ খাতে সমতা আসে।
রোহিতপুরী ও জয়পাড়ার লুঙ্গি বিলুপ্তির পথে : রোহিতপুরী ও জয়পাড়ার লুঙ্গি কেন বিলুপ্তির পথে? এ প্রশ্নের জবাবে মুন্সীগঞ্জ টেক্সটাইল ভোকেশনাল ইনস্টিটিউটের সাবেক সুপারিনটেনডেন্ট আলাউদ্দিন জানান, ২০০ বছর আগে যে শ্রমিক মজুরি পেতেন ৮০-৯০ টাকা বর্তমানে তার মজুরি ২০০-৩০০ টাকা। তখন যেসব তাঁতি এ কাজ করতেন তাদের ছেলেমেয়েরা এ কাজ শেখেনি। এ পেশার চেয়ে অন্য পেশায় জীবনের মান ভালো। এ শিল্পের শ্রমিকদের বেতন বা মানোন্নয়ন হয়নি। তাছাড়া যত্রতত্র গার্মেন্টশিল্প হওয়ায় এ শিল্পের চেয়ে গার্মেন্টশিল্পে বেতন বেশি ও প্রমোশনের ব্যবস্থা থাকা, ভারতীয় লুঙ্গির অবাধ প্রবেশ, সুতা সংগ্রহ করতে ব্যয় বেশি হওয়াসহ বিভিন্ন সমস্যায় জর্জরিত তাঁতিরা। তিনি বলেন ১২-১৫ বছর আগেও তার ৩০ খানা তাঁত ছিল। এখন একখানাও নেই। তার কথা থেকে জানা যায় আগের ২০ হাজার তাঁতের মধ্য এখন টিকে আছে দুই হাজার। এ শিল্প বর্তমানে কোনো লাভজনক ব্যবসা নয়। তাই এ পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় চলে যাচ্ছে লোক।
লকডাউনে নিঃস্ব তিন উপজেলায় ১০ হাজার তাঁতি : টাকা লকডাউনের কারণে ঢাকার কেরানীগঞ্জ, দোহার-নবাবগঞ্জের তাঁত শিল্প বন্ধ এবং তাঁতিদের কাজ না থাকায় সব হারিয়ে প্রায় নিঃস্ব হওয়ার পথে এই তিন উপজেলার প্রায় ১০ হাজার তাঁতি। তাঁতি মনির হোসেন, আ: কাদের, আ: বারেক, ইয়াছিন, আশ্রাফ, ইমামউদ্দিন, হেলালউদ্দিন, শাহী ও আলাউদ্দিন এবং রোহিতপুর ইউনিয়নের সাবেক অস্থায়ী চেয়ারম্যান মিয়া আব্দুল হান্নান বলেন, করোনার পর থেকে দেশে কয়েক দফা লকডাউনে শতাধিক ব্যক্তি তাঁত শিল্প ছেড়ে অন্য পেশায় চলে গেছেন। তাঁত শিল্প ছেড়ে শাহাজামাল, আশ্রাফ, ফরিদ উদ্দিন এখন কাপড় কিনে গ্রামে-গঞ্জে কাপড় বিক্রি করে। রিকশা, ভ্যান, পানের দোকানসহ অন্যান্য পেশায় চলে গেছে অর্ধশত তাঁতি। কেউ আবার কৃষিজমিতে বর্গা চাষ করছে। তবে এ শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে হলে সরকারের পাশাপাশি ব্যবসায়ীদের এগিয়ে আসতে হবে। তা না হলে এ শিল্পটি হারিয়ে যাবে। তাঁতি ইয়াসিন বলেন, দেশে লকডাউন শুরু হওয়ার পর থেকে তাঁতপল্লীর কাপড় বুনন ও বেচাকেনা কমে গেছে। সরকার বা সমিতির লোকজন তাদের দুর্দিনে এগিয়ে আসেনি। পায়নি কোনো সরকারি প্রণোদনা বা সহজ শর্তে ঋণসুবিধা। এ কারণে অনেক তাঁতি বিগত দিনে তাদের অর্জিত সব সম্পদ শেষ করে লাগাতার লকডাউনে এখন নিঃস্ব। তিনি বলেন, তাঁতিদের সার্বিক উন্নয়নে দোহার নবাবগঞ্জ ইউভার্স কো-অপারেটিভ ইন্ডাস্ট্রিজ সমবায় সমিতি গঠন করা হলেও তারা তাঁতিদের জন্য কিছু না করে উল্টো তারা তাঁতিদের শ্রম আর ঘামের উপার্জিত অর্থ দিয়ে কোটি কোটি টাকার সম্পদ করেছেন। এ ব্যাপারে দোহার নবাবগঞ্জ ইউভার্স সমবায় সমিতির আবদুর রহমান আকনকে কয়েক দফা ফোন করেও পাওয়া যায়নি। বাংলাদেশ তাঁত বোর্ড কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত দোহার বেসিক সেন্টারের লিয়াজোঁ অফিসার অশিষ কুমার পাল নয়া দিগন্তকে বলেন, তাঁতিরা সরকার থেকে কোনো ঋণসুবিধা বা প্রণোদনা পায়নি তবে তারা সমিতি থেকে ৩৫ জনকে তাঁত প্রতি ৩০ হাজার টাকা করে মোট ২৬ লাখ ৪০ হাজার টাকা ঋণসুবিধা দিয়েছেন। সরকারি প্রণোদনা এলে তাঁতিদের দেয়া হবে। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ তাঁত বোর্ডের মহাব্যবস্থাপক (এসসিআর) ও প্রকল্প পরিচালক কামনাশীষ দাস নয়া দিগন্তকে বলেন, আমরা সারা বাংলাদেশে তাঁতিদের মধ্যে ২৪ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছি। বর্তমানে জেলা প্রশাসকদের মাধ্যমে তাঁতিদের তালিকা তৈরি করা হচ্ছে। এই তালিকা ত্রাণ মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে তাদেরকে সরকারি প্রণোদনার আওতায় এনে ত্রাণ দেয়া হবে।

 


আরো সংবাদ



premium cement