২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ইতিহাস ঐতিহ্যে ৬৭ বছর পার করল রাবি

-

১৯৫৩ সালের ৬ জুলাই প্রতিষ্ঠা লাভ করে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বিদ্যাপিঠ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। রাজশাহীর বড়কুঠিতে মাত্র ১৬১ জন শিক্ষার্থী নিয়ে যাত্রা শুরু করে। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের ৯টি অনুষদের অধীনে ৫৯টি বিভাগ আর ছয়টি ইনস্টিটিউটে ১২৬০ শিক্ষক আর প্রায় ৩৮ হাজার শিক্ষার্থী নিয়ে আলোর প্রদীপ ছড়াচ্ছে। যার ফল স্বরূপ হাঁটি-হাঁটি পা পা করে ইতিহাস আর ঐতিহ্যে ৬৭ বছর পেরিয়ে ৬৮ তে পা দিয়েছে বিশ^বিদ্যালয়টি।
ষাটের দশক থেকে শুরু করে দেশের বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে এ বিশ^বিদ্যালয়ের রয়েছে অনেক অবদান। ৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন, ৬৬-এর ছয় দফা, ৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান, ৭০ সালের সাধারণ নির্বাচন, ৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধ, ৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী গণ-আন্দোলনে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসমাজ অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। শিক্ষার্থীরা স্বাধিকার চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে অত্যাচার আর শোষণের বিরুদ্ধে। সেই স্বাধিকার সংগ্রামের ইতিহাসে যুক্ত হয় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন প্রক্টর ড. মোহাম্মদ শামসুজ্জোহার নাম। ‘৬৯-এর গণ-আন্দোলনে তৎকালীন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে শহীদ হন তিনি।
৬৭ বছরের এই দিনটিকে স্মরণ করতে কিছু কর্মসূচি হাতে নিলেও করোনাভাইরাসের কারণে সীমিত পরিসরে কর্মসূচি পালন করা হয়। এর মধ্যে জাতীয় পতাকা উত্তোলন, বিশ^বিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের নিকটে বৃক্ষরোপণ করেন বিশ^বিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক এম আব্দুস সোবহান। এ সময় উপস্থিত ছিলেন প্রোভিসি অধ্যাপক ড. আনন্দ কুমার সাহা, অধ্যাপক চৌধুরী মো: জাকারিয়া, প্রক্টর ও ছাত্র-উপদেষ্টা (চলতি দায়িত্ব) অধ্যাপক ড. মো: লুৎফর রহমান প্রমুখ। পরে অনলাইনে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে বক্তব্য দেন।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় স্যাডলার কমিশনের ভূমিকা তুলনাবিহীন। ১৯৫৩ সালে ৬ জুলাই প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর আনুষ্ঠানিকভাবে কার্যক্রম শুরু হয় ১৯৫৪ সালে পদ্মার তীরের বড় কুঠিতে। পরে ১৯৬১ সালে শিক্ষাকার্যক্রম স্থানান্তর করা হয় মতিহারের সবুজ চত্বরে। যার স্থাপত্য পরিকল্পনায় ছিলেন অস্ট্রেলিয়ান স্থপতি ড. সোয়ানি টমাস।
শুরুতে দর্শন, ইতিহাস, বাংলা, ইংরেজি, অর্থনীতি, গণিত ও আইন বিষয়ে স্নাতকোত্তর কোর্স দিয়ে যাত্রা শুরু হলেও বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের ৯টি অনুষদের অধীনে ৫৯টি বিভাগ। উচ্চতর গবেষণার জন্য রয়েছে ছয়টি ইনস্টিটিউট।
বড় কুঠির সেই বিদ্যাপিঠটির আয়তনও বেড়ে ৩০৩ দশমিক ৮০ হেক্টরের। ১২৬০ শিক্ষক আর শিক্ষার্থীর সংখ্যা ধীরে ধীরে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৮ হাজারে। অর্থাৎ সেই ১৬১ শিক্ষার্থীর বিদ্যাপিঠে পদচারণা এখন ৩৮ হাজারের বেশি শিক্ষার্থীর। রয়েছে বেশকিছু বিদেশী শিক্ষার্থীও। এ ছাড়া বেড়েছে অবকাঠামো। ১২টি অ্যাকাডেমিক ভবনসহ বর্তমানে রাবির ছাত্রদের থাকার জন্য আবাসিক হল রয়েছে মোট ১১টি ও ছাত্রীদের জন্য রয়েছে ছয়টি হল এবং একটি ডরমিটরি।
১৯৫৩ সালের ৩১ মার্চ প্রাদেশিক পরিষদে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় আইন পাস হয়। একই বছরের ৬ জুলাই ড. ইৎরাত হোসেন জুবেরীকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি করে আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে। সেই সময় পদ্মাপাড়ের বড় কুঠি ও রাজশাহী কলেজের বিভিন্ন ভবনে বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম শুরু হয়। ১৯৬১ সালে বড় কুঠি থেকে নয়নাভিরাম মতিহারের এ সবুজ চত্বরে আসে বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম।
৬৭ বছরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস জড়িত হয়েছে বেশ কিছু প্রথিতযশা ব্যক্তিত্ব। যারা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা নিয়ে অনেকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে অবদান রেখেছেন। দীর্ঘ এ সময়ে রাবি তৈরি করেছে ভাষাবিজ্ঞানী ও সাহিত্যিক ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, ড. মুহাম্মদ এনামুল হক, কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক, সেলিনা হোসেন, ইতিহাসবিদ আব্দুল করিম, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক প্রধান উপদেষ্টা প্রয়াত বিচারপতি হাবিবুর রহমান, খ্যাতনামা ঐতিহাসিক ডেভিড কফ, তাত্ত্বিক ও সমালোচক বদরুদ্দীন উমর, সাংস্কৃতিতে ক্ষেত্রে সঙ্গীত শিল্পী এন্ড্রু কিশোর, এহসান রাহি, ক্রিকেটে আল-আমিন ও ক্রিকেটার মুশফিক বাবু অন্যতম। এ ছাড়া চলচ্চিত্র পরিচালক গিয়াসউদ্দিন সেলিম, নাট্যকার মলয় ভৌমিক প্রমুখ রয়েছেন।
প্রায় ৩৮ হাজার শিক্ষার্থীর মিলনমেলা এই ক্যাম্পাস। টুকিটাকি চত্বর, সাগর ক্যান্টিন, পুরনো ফোকলোর মাঠ আর মনিরের চায়ের দোকান ঘিরে আড্ডা কিংবা পশ্চিম পাড়া মেয়েদের হলের সামনে সন্ধ্যা হলে সময় কাটানো যেন একটা নেশা হয়ে দাঁড়ায়। অ্যাকাডেমিক পড়াশুনার পাশাপাশি বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনসহ সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো কার্যক্রম অব্যাহত রাখে।
তা ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিদিন খবর হয় বিভিন্ন গণমাধ্যমে। বিভিন্ন ছাত্ররাজনীতি সংগঠনের তৎপরতা আছে। আর সেই সুবাদে আছে লবিং-গ্রুপিং। স্বাধীনতা উত্তরকালে এই পরিস্থিতি ভয়ানক আকার ধারণ করে। মেধার ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতির ঘাড়ে চেপে এসেছে অস্ত্র। ক্যাম্পসে অস্ত্রের ঝনঝনানি, গুলির আর বোমার শব্দ। ছাত্ররাজনীতির কবলে হারিয়েছে অনেক মেধাবী শিক্ষার্থীর জীবন। পঙ্গুত্ব বরণ করেছে অনেকে।
পুরনোদের স্মৃতিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের আগে জৌলুুুুুুস কম ছিল। কিন্তু ভালো ফল ছিল। দলবাজি কম ছিল। দলীয় বিবেচনায় শিক্ষক নিয়োগ ও প্রথম শ্রেণী প্রদানও কম ছিল। এ জন্য বিশ্ববিদ্যালয় ছিল মেধাবীদের শিক্ষকদের জায়গা। কিন্তু এখন আর সেটি নেই। ‘তেল’ এখানে প্রথম হওয়া ও শিক্ষক হওয়ার অন্যতম শর্ত!
দীর্ঘ সময়ে আওয়ামী লীগ ক্ষমতার থাকায় বর্তমানে ছাত্রলীগ ক্যাম্পাসে একক কর্তৃত্ব খাটাচ্ছে। অন্য দিকে অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলো ঝিমিয়ে পড়েছে। ছাত্রলীগের রাজনীতিতে সাধারণ শিক্ষার্থীদের অনেক সময় হল ছাড়তে হয়েছে, শিবির সন্দেহে মারধর করেছে, অনেকের কাছ থেকে আবার চাঁদাবাজি করেছে। তবে ক্যাম্পাস এবং হলগুলোতে ছাত্রলীগ তাদের একক কর্তৃত্বে রেখেছে। দলীয় লেজুড়বৃত্তি রাজনীতি, তেলবাজি বাদ দিয়ে মেধাবীদের নিয়োগ প্রদান, মারামারি, কাটাকাটি, আধিপত্য বাদ দিয়ে শিক্ষা ও গবেষণার মাধ্যমে এই বিশ^বিদ্যালয় বিশে^র সাথে পাল্লা দিয়ে অনেক এগিয়ে যাবেÑ এমনটাই প্রত্যাশা শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের।


আরো সংবাদ



premium cement