২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`


পাসপোর্ট পেতে ভোগান্তিতে সাধারণ মানুষ

ঢাকায় ধরনা দিচ্ছেন সেবাপ্রত্যাশীরা
-

নিয়ম মেনে নির্ধারিত সময়ে পাসপোর্ট বিতরণ করতে পারছে না ইমিগ্রেশন ও পাসপোট অধিদফতর কর্তৃপক্ষ। ফলে পাসপোর্ট পেতে ভোগান্তিতে পড়েছেন সেবাপ্রত্যাশী সাধারণ মানুষ। নির্ধারিত সময়ে পাসপোর্ট না পেয়ে অনেকের বিদেশযাত্রাও বাতিল হচ্ছে। চিকিৎসার জন্য রোগী ও ব্যবসায়ীরা বাণিজ্যিক কাজে দেশের বাইরে যেতে পারছেন না। পাসপোর্ট না থাকায় বিপাকে পড়েছেন হজ ও উমরা গমনেচ্ছু মানুষও। নবায়ন থেকে শুরু করে নতুন আবেদনকারী কমবেশি সবাই পাসেপার্ট পেতে বহুমুখী ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। গত রোববার ও সোমবার রাজধানীর আগারগাঁও পাসপোর্ট অফিস সরেজমিন পরিদর্শনে এসব তথ্য জানা গেছে। ভুক্তভোগীরা জানান, নির্ধারিত সময়ে পাসপোর্ট না পাওয়ায় আবেদনকারীদের অনেকেই দ্রুত সময়ে পাসপোর্ট পেতে ঢাকায় আগারগাঁওয়ে ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদফতরে শীর্ষ কর্তাদের কাছে ধরনা দিচ্ছেন। কেউ কেউ চেষ্টা চালিয়ে সফল হলেও বেশির ভাগই বিফল। তবে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে অনেকেই আসছেন ঢাকায় আগারগাঁওয়ে ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদফতরে। মেশিন রিডেবল পাসপোর্টের (এমআরপি) বই সঙ্কটের সুযোগে অফিস ঘিরে দৌরাত্ম্য বাড়ছে একশ্রেণীর দালাল সিন্ডিকেটের। দ্রুত পাসপোর্ট পাওয়ার আশায় দালালদের খপ্পরে পড়ছেন সেবাপ্রত্যাশীরা। সম্প্রতি আবেদনকারীরা আরো নতুন ভোগান্তিতে পড়েছেন। এ ছাড়া ওয়েবসাইট থেকে পাসপোর্টের আবেদন ফরম ডাউনলোডের পর হাতে লিখে পূরণ করে জমা দিলে তা গ্রহণ করছে না পাসপোর্ট অধিদফতর। সেখান থেকে বলা হয় অনলাইনে পূরণ করে আবেদনকারীকে ফরম জমা দিতে হবে। নতুন আবেদনকারীর ক্ষেত্রে পুলিশ রিপোর্ট পেতেও বিড়ম্বনায় পড়তে হচ্ছে। তদন্তের জন্য বেশির ভাগ আবেদনকারী সংশ্লিষ্ট তদন্তকারীকে টাকা ঘুষ দিতে হয়। অবশ্য সেবাপ্রত্যাশীদের জন্য অনুসন্ধান ও সহায়তা কেন্দ্র চালু করা হয়েছে। যেখানে শত শত আবেদনকারী ভিড় জমাচ্ছেন।
জানা যায়, ‘ইলেক্ট্রনিক পাসপোর্ট (ই-পাসপোর্ট) চালু করলে মেশিন রিডেবল পাসপোর্টের (এমআরপি) চাহিদা কমবে’ এমন ধারণা থেকে চলতি বছর এমআরপি বইয়ের মজুদ কম রেখেছিল ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদফতর। অথচ ঢাকার বাইরে বিভাগীয় ও আঞ্চলিক অফিসগুলোতে ই-পাসপোর্টের আবেদন প্রক্রিয়া শুরুই হয়নি। ফলে সেসব কার্যালয়ে এমআরপির জমা পড়া আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে পাসপোর্ট ছাড় করতে হিমশিম খাচ্ছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। এমআরপির বই সঙ্কটের কারণে জরুরি ফি দিয়ে আবেদনের পরও নির্ধারিত সময়ে পাসপোর্ট মিলছে না। অথচ ১১ কার্যদিবসের মধ্যে পাসপোর্ট ছাড়ের নিয়ম হলেও অপেক্ষা করতে হচ্ছে চার থেকে ছয় মাস পর্যন্ত। ফলে চিকিৎসা ছাড়াও নানা কাজে বিদেশগামী মানুষ বিপাকে পড়েছেন।
ভুক্তভোগীরা বলছেন, নিয়ম অনুযায়ী জরুরি ফি দিলে ১১ এবং সাধারণ ফি দিলে ২১ কার্যদিবসের মধ্যে পাসপোর্ট পাওয়ার কথা। কিন্তু বর্তমানে জরুরি বা সাধারণ ফির মাঝে কোনো পার্থক্যই নেই। নির্ধারিত সময়ের পর নিয়মিত পাসপোর্ট অফিসে সকাল-দুপুর ধরনা দিতে হচ্ছে। আর আঞ্চলিক কার্যালয়গুলোতে যারা আবেদন করেছেন তাদের ভোগান্তি আরো বেশি। কেননা আঞ্চলিক কার্যালয় থেকে কাগজপত্র সঠিকভাবে যাচাইয়ে বেশি সময় লাগছে। তারপর ঢাকায় পাঠানো হলেও দিনের পর দিন ঝুলে থাকে পাসপোর্টের আবেদন। ফলে ঢাকা থেকে দ্রুত পাসপোর্ট প্রিন্ট হওয়ায় আঞ্চলিক কার্যালয়ে যথাসময়ে পৌঁছায় না পাসপোর্ট। বেশকিছু বিভাগীয় অফিসে প্রায়দিনই গড়ে ১৫০ থেকে ২০০টি নতুন আবেদন জমা পড়ছে। ঢাকায় প্রধান কার্যালয়ে এই সংখ্যা কয়েক গুণ বেশি। কিন্তু সেই অনুযায়ী পাসপোর্ট সরবরাহ করতে ব্যর্থ হচ্ছে কর্তৃপক্ষ।
গত সোমবার ঢাকার আগারগাঁওয়ের কেন্দ্রীয় পাসপোর্ট অফিসে কথা হয় কয়েকজন ভুক্তভোগীর সাথে। তাদেরই একজন চট্টগ্রামের বাসিন্দা মো: দুলাল উদ্দিন। দীর্ঘদিন ধরে ওমানের রাজধানী মাসকাটে থাকেন তিনি। চট্টগ্রাম পাসপোর্ট অফিসে আবেদন জমা দিয়েছেন ২০১৯ সালের ২৬ ডিসেম্বর। গত ১৬ জানুয়ারি তার পাসপোর্ট পাওয়ার কথা। কিন্তু এখনো পাননি। ভিসার মেয়াদও শেষের দিকে। বেসরকারি চাকরিজীবী হারুন অর রশিদ নামে একজন নতুন পাসপোর্টের জন্য ঠাকুরগাঁও আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে আবেদন জমা দিয়েছেন গত ৫ জানুয়ারি। ২৬ জানুয়ারি তার পাসপোর্ট পাওয়ার কথা। কিন্তু ফেব্রুয়ারি শেষ হতে চললেও তা পায়নি। আগারগাঁওয়ে প্রধান কার্যালয়ে সংশ্লিষ্ট শীর্ষ কর্তাদের কাছে ধরনা দিয়েও কোনো সুরাহা করতে পারেননি এই ভুক্তভোগী। দুই-একদিনের মধ্যে পাসপোর্ট না পেলে তার বিদেশযাত্রা বাতিলও হতে পারে বলে তিনি জানান।
সেবাপ্রত্যাশীদের ভোগান্তির বিষয়ে জানতে চাইলে ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদফতরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল সাকিল আহমেদের টিঅ্যান্ডটি নম্বরে একাধিকবার ফোন করলেও তিনি রিসিভ করেননি। তা ছাড়া তার দাফতরিক মেইলে কয়েকটি লিখিত প্রশ্ন পাঠালেও তার জবাব পাওয়া যায়নি। অবশ্য আগারগাঁওয়ে ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদফতরে কর্মরত কয়েকজন আনসার সদস্যের সাথে আলাপকালে জানান, এমআরপির বই সঙ্কটের কারণেই আবেদনকারীরা ঠিক সময়ে পাসপোর্ট পাচ্ছেন না। তা ছাড়া ই-পাসপোর্ট চালু ও এমআরপির মধ্যবর্তী সময় হওয়ায় কিছুটা সমস্যা হচ্ছে।
চিকিৎসার জন্য ভারতে যাওয়ার জন্য নিজের পাসপোর্টের জন্য ঢাকার একটি আঞ্চলিক কার্যালয়ে আবেদন করেছেন ঢাকার বাসিন্দা হারুন অর রশিদ। গত ৫ ফেব্রুয়ারি তার পাসপোর্ট হাতে পাওয়ার কথা ছিল। পুলিশি তদন্তের জন্য গুনতে হয়েছে ঘুষ। কিন্তু অদ্যাবধি তিনি পাসপোর্ট পাননি। এরকম অসংখ্য মানুষ নির্ধারিত সময়ে পাসপোর্ট না পেয়ে আঞ্চলিক ও ঢাকায় প্রধান কার্যালয়ে ধরনা দিচ্ছেন। অনেকেই প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে ঢাকায় ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদফতরের প্রধান কার্যালয়ে যোগাযোগ করছেন দ্রুত পাসপোর্ট পাওয়ার আশায়। তিন-চার দিন ঘুরেও কোনো সুরাহা করতে পারছেন না। আবেদনকারীদের অভিযোগÑ নিয়ম অনুযায়ী প্রক্রিয়া শেষে নির্ধারিত তারিখে পাসপোর্ট সংগ্রহের জন্য মোবাইলে এসএমএস পাঠানো হয়। কিন্তু আবেদনের তিন-চার মাস পরও এসএমএস না পেয়ে তারা অফিসে এসে ধরনা দিচ্ছেন।
এ দিকে হাতে লেখা আবেদন ফরম জমা দিতে গিয়ে অনেক আবেদনকারী বিপাকে পড়ছেন। তারা ওয়েবসাইট থেকে আবেদন ফরম ডাউনলোড দিয়ে তা হাতে লিখে পূরণ করে জমা দিতে গেলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তা গ্রহণ না করে বলেছেন, অনলাইনেই ফরম পূরণ করে জমা দিতে হবে। ভোগান্তির শিকার মো: মাহিদ ভুইয়া ও সুজাদুর রহমান এই প্রতিবেদককে বলেন, আমরা নিয়ম মেনেই পাসপোর্টের আবেদন ফরম ডাউনলোড ও সংগ্রহ করে তা হাতে লিখে পূরণ করে ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদফতরে জমা দিতে যাই রোববার।
কিন্তু কর্তৃপক্ষ বলে, হাতে লেখা ফরম গ্রহণযোগ্য নয়। বাধ্য হয়েই অনলাইনে ফরম পূরণ করে জমা দিয়েছি। ফলে ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে। তাদের মতে, যদি আগে থেকেই কোনো বিজ্ঞপ্তি বা ওয়েবসাইটের মাধ্যমে বিস্তারিত জানানো হয়, হাতে লেখা আবেদন ফরম গ্রহণযোগ্য নয় তাহলে মানুষের ভোগান্তি হবে না। কিন্তু এ বিষয়ে বেশির ভাগ সাধারণ মানুষ কিছুই জানেন না। এ বিষয়ে ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদফতরে তথ্যকেন্দ্রে দায়িত্বরত একজন সেনা সদস্য জানান, হাতে লেখা আবেদন ফরম জমা না নিতে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের মৌখিক নির্দেশনা আছে।

 


আরো সংবাদ



premium cement