অর্ধশতাধিক ডায়িংসহ প্রায় দুই শ’ কারখানার বিষাক্ত বর্জ্য ও বালু ব্যবসায়ীদের তাণ্ডবে ময়মনসিংহের ভালুকার খিরু নদীটি এখন বিষের নহরে পরিণত হয়েছে। স্থানীয় প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদফতরের রহস্যজনক নীরবতার কারণে এবং যথাযথ তদারকি না থাকায় অধিকাংশ কারখানার বিরুদ্ধে ইটিপি বন্ধ রাখার অভিযোগ উঠেছে। ফলে এই নদীতে প্রবহমান বর্জ্য আলকাতরার মতো কালো বর্ণ ধারণ করে সর্বত্র দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। পেটের পীড়া ও চর্মরোগসহ নানা ব্যাধিতে রোগে আক্রান্ত হচ্ছে জীবজন্তু ও মানুষ।
নব্বই দশকের আগে পর্যন্ত এই খিরু নদী দিয়ে বড় বড় বজরা নৌকা ও লঞ্চ চলত। হাজারো মানুষ ও জেলে পরিবারের লোকেরা এই নদীতে মাছ শিকার করত। আশপাশের এলাকার মানুষ নৌকায় এই নদীপথ দিয়েই দূর-দূরান্তে চলাচল করত। পরবর্তী সময়ে ভালুকার বিভিন্ন এলাকায় অপরিকল্পিত মিলকারখানা স্থাপিত হওয়ায় খরস্রোতা নদীটি ক্রমান্বয়ে মরা খালে পরিণত হয়। এর তলদেশে কারখানার বিষাক্ত বর্জ্য ও আবর্জনা জমে এবং কিছু অসাধু বালু ব্যবসায়ীর কারণে নদীটি এখন হয়ে উঠেছে এক বিষের নহর।
বর্তমানে এ অঞ্চলের অর্ধশতাধিক ডায়িং ফ্যাক্টরিতে বর্জ্য শোধন যন্ত্র (ইটিপি) বন্ধ রয়েছে। ফলে ওই সব ফ্যাক্টরির বিষাক্ত বর্র্জ্য এখন লাউতি ও বিলাইজুড়িসহ বিভিন্ন খাল দিয়ে এই খিরু নদীতে এসে পড়ছে। সেই সাথে বেশ কয়েক বছর ধরে প্রভাবশালী ব্যক্তিরা নদীর দু’পাড়ে স্তূপাকারে বালু রেখে ব্যবসা করার কারণে নদীটি ভরাট হয়ে যাচ্ছে।
খিরু ব্রিজের দক্ষিণ পাড়ে ১৫ বছর আগে গড়ে ওঠা শেফার্ড ডায়িং ফ্যাক্টরির বিষাক্ত বর্জ্য দিয়ে দূষণ শুরু হয় খিরু নদীর। তাদের বর্জ্যরে পাইপ মাটির নিচ দিয়ে সরাসরি খিরু নদীতে এসে পড়ে। সম্প্রতি গজারিয়া খালপাড়ে গড়ে ওঠা গ্লোরী ডায়িং ফ্যাক্টরিটির বর্জ্যও এসে পড়ছে নদীতে। পরিবেশ অধিদফতরের সাথে ফ্যাক্টরি কর্তৃপক্ষের সুসম্পর্ক থাকায় তারা সরাসরি মোটা পাইপের মাধ্যমে বর্জ্য নদীতে ফেলছে। এসব ব্যাপারে এলাকার কেউ প্রতিবাদ করলে কারখানার পালিত গুণ্ডাদের মাধ্যমে মিথ্যা মামলা দিয়ে ভয়ভীতি দেখানো হয়। গ্লোরী ডায়িং মিলের জেনারেল ম্যানেজার (জিএম) আফছার উদ্দিন ও প্রজেক্ট ম্যানেজার অনিক দাস অবশ্য জানান, তাদের ফ্যাক্টরিতে ইটিপি রয়েছে এবং তা দিয়ে বর্জ্য শোধনের পর খিরু নদীতে ফেলা হয়।
হাজীর বাজার এলাকায় তাইপে বাংলো, মাস্টারবাড়ি এলাকায় কালার মাস্টার (এসকিউ), বেলী ডায়িং, পিএ নিট, স্কয়ার নিট ফেব্রিক্স, স্কয়ার নিট ফ্যাশন, হাওয়া ওয়েল টেক্সটাইল, এনআরজি কম্পোজিট, এফএম ইয়ার্ন ডায়িং, শাহাব ফেব্রিক্স, টিএম টেক্সটাইলস, এনভয় টেক্সটাইলস, এমএল ডায়িং, এসএমসি, প্যাসিফিক কটন, ভরাডোবা এলাকায় এক্সপেরিয়েন্স টেক্সটাইলস, কনজিউমার নিটেক্স, মেদুয়ারীতে গ্রীন টেক্সটাইলসহ আরো অর্ধশতাধিক ডায়িং, ক্যামিক্যাল ও কীটনাশক ফ্যাক্টরি রয়েছে এ নদীর পাড়ে। এসব মিলকারখানার কালো বর্জ্য লাউতি খালসহ বিভিন্ন খাল দিয়ে প্রতিনিয়তই খিরু নদীতে এসে পড়ছে।
বেশ কিছু ফ্যাক্টরিতে ইটিপি থাকা সত্ত্বেও তা বন্ধ থাকে বলে এলাকার লোকজন জানায়। ছোট ছোট খাল দিয়ে বর্জ্য-পানি নেমে আসায় এসব মাটি পুড়ে কালো বর্ণ হয়ে গেছে। এ ছাড়া কিছু কিছু এলাকায় আরো নানা রকম মিলের দূষিত বর্জ্য ভূগর্ভের পানির স্তরে মিশে যাওয়ায় টিউবওয়েলের পানিও দূষিত হয়ে যাচ্ছে। কিছু কিছু টিউবওয়েলের দূষিত পানির কারণে ওই সব এলাকার মানুষ ডায়রিয়া ও চর্মরোগসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) ভালুকা আঞ্চলিক শাখার সদস্যসচিব কামরুল হাসান পাঠান কামাল জানান, পরিবেশ অধিদফতরের অসাধু কর্মকর্তাদের রহস্যজনক নীরবতার কারণে ডায়িং ফ্যাক্টরিগুলো ইটিপি ব্যবহার না করে বিষাক্ত বর্জ্য খাল, বিল ও খিরু নদীতে ফেলছে। পরিবেশ রক্ষায় বাপা’র পক্ষ থেকে ইতোমধ্যে মানববন্ধন ও স্মারকলিপিসহ বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে।
উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আবুল কালাম আজাদ জানান, উপজেলা পরিষদের পক্ষ থেকে সবসময়ই এ বিষয়ে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সালমা খাতুন জানান, পরিবেশ রক্ষায় যা করণীয় উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তা করা হবে।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা