২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ইন্দোনেশিয়ায় হিজড়া নারীদের যেভাবে সহায়তা করছে ইসলামিক কেন্দ্র

ইয়োগিয়াকার্তার আল ফাতাহ ইসলামিক সেন্টার, যার ৬৩ জন সদস্যের সবাই হিজড়া - ছবি : বিবিসি

ইন্দোনেশিয়ায় ট্রান্সজেন্ডার বা হিজড়া নারীদের জন্য যে একটিই মাত্র ইসলামিক কমিউনিটি সেন্টার আছে, তার ভবিষ্যৎ এখন বিপন্ন।

একটা কারণ এর নেতা শিনতা রাত্রি ফেব্রুয়ারি মাসে মারা গেছেন। তার ওপর সরকার বলছে, তারা একে সমর্থন যোগাতে পারবে না।

আল-ফাতাহ নামে এই কমিউনিটি সেন্টারটিতে নিয়মিত আসেন ৬৩ জন ট্রান্সজেন্ডার নারী অর্থাৎ যারা লিঙ্গ পরিবর্তন করে নারীতে পরিণত হয়েছেন। এই কমিউনিটি সেন্টারটিই ছিল তাদের জন্য এমন একটি জায়গা- যেখানে তারা নামাজ পড়তেন, কোরআন শিখতেন, নতুন কোনো কাজের প্রশিক্ষণ নিতেন বা এমনি একে অপরের সাথে দেখা-সাক্ষাত করতেন।

এটা ছিল এমন একটি জায়গা, যেখানে তাদেরকে তাদের জেন্ডার পরিচয় নিয়ে কোনো প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হতো না।

প্রতি দিন সকালে উঠে তিনি মেকআপ করেন, মাথায় দেন তার প্রিয় কালো পরচুলাটি। তার পর হ্যান্ডব্যাগটি নিয়ে বেরিয়ে পড়েন ইন্দোনেশিয়ার ঐতিহাসিক শহর ইয়োগিয়াকার্তার পথে।

তিনি হচ্ছেন একজন ‘বাস্কার’, যারা শহরের পথে পথে গান গেয়ে বা বাজনা বাজিয়ে অর্থ উপার্জন করে।

রিনি প্রতি দিন মাইলের পর মাইল হাঁটেন। তার ব্লুটুথ স্পিকার থেকে বাজতে থাকে মিউজিক আর তার সাথে গলা মিলিয়ে তিনি গাইতে থাকেন গান। এই গান শুনে লোকে যে পয়সাকড়ি দেয়। তাই তার উপার্জন।

কিন্তু রোববার এলে তার রুটিন বদলে যায়।

সেদিন তার পথ চলা শেষ হয় বিকেল বেলা আল-ফাতাহ সেন্টারে এসে। এখানে তিনি কোরআন পড়েন।

মিজ রিনি বলছেন, ‘এটা একটি নিরাপদ জায়গা, যেখানে আমরা এসে নামাজ পড়তে পারি।’ তিনি ২০১৪ সাল থেকে এই কেন্দ্রে নিয়মিত আসছেন।

ছোটবেলা থেকেই ছেলেদের চাইতে মেয়েদের সাথে খেলা করতেই বেশি ভালো লাগত রিনির।

তিনি মেয়েদের মতো পোশাক পরতেন, তার খেলনা ছিল রান্নার নানা সরঞ্জাম, আর বন্ধুদের সাথে তিনি বউ সাজতেন।

এক সময় তিনি ঘোষণা করেন যে তিনি একজন ‘ট্রান্সজেন্ডার’ বা হিজড়া নারী। তার বাবা-মা এবং নয় ভাই-বোন তার এই পরিচয়কে মেনে নিয়েছেন। আর এখন রাস্তায় নেমে নাচগান করার জন্য পথচারীদের মধ্যেও তিনি পরিচিত হয়ে উঠেছেন।

তিনি হেসে বলেন, ‘আপনি বলতে পারেন আমি একজন সেলিব্রিটি, বিখ্যাত লোক।’

রিনির এক বন্ধু ধর্ম নিয়ে পড়াশোনা করতেন। তার কাছ থেকেই এই আল-ফাতাহ ইসলামিক সেন্টারের কথা প্রথম শোনেন তিনি।

আর সেখানে গিয়ে তিনি খোঁজ পান তারই মতো আরো কিছু নারীর একটি গোটা সম্প্রদায়ের, যাদের আগ্রহের বিষয়ও এক।

এমনিতে মসজিদে নামাজ পড়তে গেলে প্রায়ই লোকজন তার দিকে বাঁকা চোখে তাকাত।

রিনি বলেন, ‘তারা আমাদেরকে ঠিক মেনে নিতে পারেনি। সেকারণেই আমি শিনতা রাত্রির কেন্দ্রে যাওয়া শুরু করি।’

শিনতা রাত্রি ছিলেন এক ‘আলোকবর্তিকা’
আল-ফাতাহর কেয়ারটেকার নূর আয়ু বলছিলেন, ‘অনেক ইসলামিক সেন্টারই ট্রান্সজেন্ডার মানুষদের মেনে নেয় না। তবে এখানে আমরা মুক্ত...নারী হিসেবেই হোক আর পুরুষ হিসেবেই হোক, যেভাবে আমাদের খুশি সেভাবেই আমরা এখানে আসতে পারি।’

আল-ফাতাহ কমিউনিটি সেন্টারের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন শিনতা রাত্রি। তিনি ছিলেন একজন নামকরা অধিকারকর্মী এবং ২০১৪ সাল থেকে এই কেন্দ্রের নেতা।

ইন্দোনেশিয়ায় হিজড়াদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আরো অনেক অলাভজনক প্রতিষ্ঠানের সাথে মিলে কাজ করতেন তিনি।

কিন্তু এ বছর মার্চ মাসে হৃদরোগে আক্রান্ত হন ৬০ বছর বয়সী শিনতা রাত্রি, তাকে হাসপাতালে নেয়ার তিন দিন পর তিনি মারা যান।

এই কেন্দ্রের সকল সদস্যের মনে তার অভাব গভীরভাবে রেখাপাত করেছে।

মিজ নূর বলছেন, মিজ শিনতা তাদের কাছে ছিলেন এক ‘আলোকবর্তিকা’ এবং পরিবারের একজনের মতো। তার বিদায়ের পর কেন্দ্রটিতে কেমন যেন একটা শূন্যতা নেমে এসেছে।

শুধু তাই নয় মিজ শিনতার মৃত্যুর পর এই কমিউনিটি সেন্টারটির ভবিষ্যৎ নিয়েই সন্দেহ দেখা দিয়েছে।

এই ভবনটির মালিক হচ্ছে মরহুম নেতার পরিবার। তারা বলেছেন ‘আল-ফাতাহকে এ বাড়ি ছেড়ে দিতে হবে।‘

মিজ নূর বলছেন, শিনতার মৃত্যুর পর এখন তাদেরকে স্বাধীনভাবে চলার সক্ষমতা গড়ে তুলতে হবে।

এই ইসলামিক কেন্দ্রটির সচিব হচ্ছেন ওয়াই এস আলবুচোরি।

তিনি ব্যাখ্যা করছেন যে তারা এ কমিউনিটির কিছু শুভাকাঙ্ক্ষী এবং স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক কিছু মানবাধিকার সংগঠনের কাছ থেকে কিছু সহায়তা পেয়েছেন।

কিন্তু ইন্দোনেশিয়ার ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে হিজড়া কমিউনিটির গ্রহণযোগ্যতা খুবই কম।

সদস্যরা বলছেন, রাষ্ট্র তাদের ব্যাপারে সরাসরি কোনো বৈরিতা প্রদর্শন করছে না এবং এ সংগঠনের অস্তিত্ব রক্ষা করতে দিয়েছে। কিন্তু তারা প্রত্যক্ষভাবে কোনো সাহায্য-সহযোগিতাও দেয় না।

ওয়ারিওনো আবদুল গফুর হলেন ইন্দোনেশিয়ার ধর্ম মন্ত্রণালয়ের ইসলামিক সেন্টার-সংক্রান্ত পরিচালক।

গফুর বলছেন, তিনি আল-ফাতাহ সেন্টারের দুর্দশা সম্পর্কে সচেতন।

কিন্তু তিনি বলছেন, রাষ্ট্রীয় নিয়ম-নীতি অনুযায়ী এই সংগঠনটি একটি আইনসম্মত ইসলামিক সেন্টার নয়, এবং সেকারণে কর্তৃপক্ষ এটিকে কোনো সহায়তা দিতে পারে না।

তিনি বলেন, বৃহত্তর অর্থে সকল ইতিবাচক কর্মকাণ্ডকেই রাষ্ট্র সমর্থন দিয়ে থাকে। লোকে নামাজ পড়তে চাইলে তাকে বাধা দেয়া হবে কেন? কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে এ সমাজ এখনো ট্রান্সজেন্ডার মানুষদের সামাজিক ও ধর্মীয় মর্যাদা দিতে রাজী নয়।

ইন্দোনেশিয়ার ধর্মমন্ত্রণালয়ের সাথে কখনো আল ফাতাহর কোনো সরাসরি যোগাযোগ হয়নি এবং এর কোনো কর্মকাণ্ডকে তারা কোনো সহায়তাও দেয়নি।

এই কেন্দ্রটির আরেকজন নেতা হচ্ছেন রুলি মাল্লাই। তিনি বলছেন, আল ফাতাহ যতটুকুই আইনি বৈধতা পেয়েছে, তার জন্য তিনি কৃতজ্ঞ।

তিনি এ ব্যাপারে নিশ্চিত যে ইন্দোনেশিয়ার মতো এত বৈচিত্র্যপূর্ণ একটি দেশে একদিন অবশ্যই হিজড়ারা আরো বেশি গ্রহণযোগ্যতা পাবে। এই আশাই তাকে এবং তার বন্ধুদেরকে এ কেন্দ্রটির কাজ চালিয়ে যেতে উদ্দীপনা যোগায়।

মিজ রুলি বলছেন, ‘কেউ যদি নিয়ম-নীতি মেনে নামাজ পড়তে চায়, তার সুযোগ তো ইসলাম ধর্মে থাকার কথা। আমার মনে হয়, রাষ্ট্র যে সুরক্ষা দিচ্ছে, তা যথেষ্ট ভালো। তাছাড়া আমরা আশাবাদী যে আমাদের দেশের মূলনীতি ‘বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য’ অনুযায়ী ভবিষ্যতে আমাদেরকেও এর অংশ হিসেবে মেনে নেয়া হবে।’

তবে এখন আল-ফাতাহর সামনে চ্যালেঞ্জ হচ্ছে একটি নতুন বাড়ি খুঁজে বের করা, এবং সেখানে উঠতে যে অর্থ লাগবে তা জোগাড় করা।

তাছাড়া ওই নতুন বাড়িটি এমন একটি জায়গায় হতে হবে, যেখানকার মানুষ হিজড়াদের মেনে নেবে।

ইয়োগিয়াকার্তার যে এলাকাটিতে তারা এখন আছেন, সেখানকার লোক তাদের ভালোভাবেই গ্রহণ করেছে।

তাদের একজন হচ্ছে মিজ রোসিদা। তিনি স্থানীয় বাসিন্দা, কিন্তু নিজে ট্রান্সজেন্ডার নন। এক দিন এই কেন্দ্রেরই একজন সদস্য এ বাড়িটি খুঁজে বের করতে তার সাহায্য চাইলে তিনি আল-ফাতাহর কথা জানতে পারেন।

এরপর এক বছরের বেশি সময় ধরে তিনি এখানে শিক্ষকতা করছেন।

মিস রোসিদা বললেন, ‘আমি ব্যস্ত ছিলাম। কিন্তু আমার কৌতুহল হলো। তাই আমি কেন্দ্রটা দেখতে গেলাম।’

পরে এক দিন শিনতা রাত্রি তাকে জিজ্ঞেস করলেন, তিনি একজন স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে এখানে নিয়মিত একজন শিক্ষক হিসেবে কাজ করবেন কিনা। পরিবারের অনুমতি নিয়ে তাতে রাজি হলেন মিজ রোসিদা।

তিনি বললেন, ‘প্রথমে আমার একটু ভয় ভয় লাগত। কিন্তু কিছু দিন পড়ানোর পর দেখলাম, এখানকার লোকগুলো খুবই ধীরস্থির, বিশেষ করে শিনতা। তাদের অনেক ধৈর্য, তারা কখনো রেগে যায় না, সব সময় হাসিমুখ।’

এই কেন্দ্রের আরেকজন স্বেচ্ছাসেবী তেগুহ রিধো।

তিনি এখানে ইকরা শেখান, যা ধর্মগ্রস্থ পাঠের প্রাথমিক স্তর। এখানকার ছাত্ররা যে এত দূর থেকে কষ্ট করে আসে, ওই ঐকান্তিকতা দেখে তিনি মুগ্ধ হয়েছেন।

‘এখানে আমরা মাত্র এক ঘণ্টার জন্য কোরআন শিক্ষা দেই। তারপরও তারা অনেক দূর থেকে আসে।’

এই এলাকার স্থানীয় লোকদের মন জয় করতে তাদের অনেকটা সময় লেগেছিল।

মিজ আলবুচোরির মনে আছে, ২০১৬ সালের একটি ঘটনার কথা। একটি উগ্রপন্থী ইসলামিক গোষ্ঠী জোর করে তাদের কেন্দ্রে ঢুকে তাদেরকে হুমকি দিয়েছিল।

তারা বলেছিল, তোমরা যেখানেই যাও না কেন, আমরা তোমাদের পিছু ধাওয়া করব, যত দিন তোমরা তওবা করে আবার পুরুষ না হও।’

ওই সময় শিনতা রাত্রি অনেক লড়াই করে, আরো কয়েকটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠানের সহায়তা নিয়ে, কেন্দ্রটিকে খোলা রেখেছিলেন। শেষ পর্যন্ত স্থানীয় পুলিশ বাহিনী তাদের নিরাপত্তা দেবার গ্যারান্টি দেয়।

মিজ আলবুচোরি বলেন, এখানে যোগ দেয়ার পর থেকে হিজড়া নারীদের জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে। তারা এখন ধর্মীয় শিক্ষা পেয়ে নৈতিক দায়িত্ব নিচ্ছে।

তিনি বলেন, এই স্কুলে যোগ দেবার পর আল্লাহ সম্পর্কে জানতে পেরে আমাদের জীবন আরো সুশৃঙ্খল হয়েছে। এই কমিউনিটি এখন আমাদের দ্বিতীয় পরিবার হয়ে গেছে।

এ কারণেই মিজ আলবুচোরি আশা করছেন যে এই কমিউনিটি সেন্টার তারই মতো অন্য আরো ট্রান্সজেন্ডার নারীকে ধর্মীয় শিক্ষা দেয়া অব্যাহত রাখবে, যে নারীরা নিজেদেরকে আল্লাহর আরো কাছাকাছি নিয়ে যেতে চান।

মিজ আলবুচোরি বলেন, ‘আমি এখনো আল্লাহকে চাই। আমি নামাজ না পড়ে থাকতে পারি না। আমি নিশ্চিত যে অন্য ট্রান্সজেন্ডার বন্ধুদেরও নামাজ পড়ার পেছনে তাদের নিজস্ব কিছু কারণ আছে। আল্লাহর সৃষ্টি হিসেবে আমি এটা চাই না যে আমি শুধুই একজন ট্রান্স নারী হিসেবে বেঁচে থাকব বা কাজ করব।

তিনি বিশ্বাস করেন, তার জীবনের একটা উচ্চতর উদ্দেশ্য আছে।

সূত্র : বিবিসি


আরো সংবাদ



premium cement